মার্চে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান
আবার এসেছে মার্চ, অগ্নিঝরা মার্চ। একাত্তরের মার্চ ছিল অন্যরকম। শুরু থেকেই দেশ ছিল উত্তাল। ৭ মার্চ তখনকার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না হলেও বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার পরই আসলে বাঙালি প্রস্তুতি শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের। আলোচনার ছলে সময় নষ্ট করে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে চালায় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে, তারই নেতৃত্বে নয় মাসের কঠিন মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আসে ‘বিজয়’। মার্চ তাই আমাদের জন্য অন্যরকম আবেগের; শোকের, বেদনার, ভালোবাসার। তবে এবারের মার্চ একটু অন্যরকম। বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এবার।
একাত্তরে অল্পকিছু স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর স্বাধীনতাবিরোধীরা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়েই স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যেই জাতি বিভক্ত হয় স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের শক্তি হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির নেতৃত্ব যায় ‘বীরউত্তম’ খেতাব পাওয়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দল বিএনপির হাতে। সেই ধারা এখনও চলছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামী এখনও রাজনীতিতে বিএনপির জোট সঙ্গী।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে নানা মত থাকবে, পথ থাকবে, নানা দল থাকবে। কিন্তু সবাইকে হতে হবে স্বাধীনতার পক্ষের। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি আছে এবং তারা প্রকাশ্যে রাজনীতিও করছে। এ বড় বেদনাদায়ক।
পঁচাত্তরের পর স্বাধীনতাবিরোধীরা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়েই স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নেয়...
তবে সুখের কথা হলো, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনে মাসব্যাপী কর্মসূচি নিয়েছে বিএনপি। এই কর্মসূচিতে ৭ মার্চ তাদের কর্মসূচি আছে, আছে ২৫ মার্চ কালরাত উদ্যাপনের কর্মসূচিও। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতার দায় গা থেকে ঝেড়ে ফেলে বিএনপি স্বাধীনতার মাস উদযাপনে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করতে চাইছে, এ বড় সুখের খবর।
৫০ বছর পর এখন আসলে আমাদের সময় এসেছে, ইতিহাসের অস্পষ্ট অধ্যায়গুলো পরিষ্কার করার। রাজনীতিতে নিজ নিজ মত, আদর্শ থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুই ২৩ বছরের মুক্তির সংগ্রামে জাতিকে স্বাধীনতার মোহনায় ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তারই নেতৃত্বে। এখানে সবাইকে একমত হতেই হবে। এখানে বিতর্কের কিছু নেই। প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী। অন্য সব সেক্টর কমান্ডারদের মতো মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদানও অনস্বীকার্য। তবে তিনি অন্য সেক্টর কমান্ডারদের থেকে আলাদা ছিলেন, মানতে হবে সেটাও। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তখন সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী ছিল। সমস্যা হলো বিএনপি যখন জিয়াউর রহমানের অবদানকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমান মর্যাদার আসন দিতে চান তখন। আবার আওয়ামী লীগও যখন বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা, আইএসআইয়ের এজেন্ট বানাতে চায়; তখন সমস্যাটা আরও জটিল হয়। বঙ্গবন্ধু যাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দিয়েছেন, সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান বানিয়েছেন; স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যখন আওয়ামী লীগ সেই খেতাব কেড়ে নিতে চায়, দূরত্বটা তখন অলঙ্ঘনীয় হয়ে যায়। তবে বিএনপিকে ধন্যবাদ তারা সেই দূরত্বকে আরও না বাড়িয়ে, বরং বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে। গত শনিবার বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গিয়ে তাদের স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানান, তখন রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক বার্তা ছড়ায়।
বাংলাদেশটা আওয়ামী লীগের নয়, বাংলাদেশটা বিএনপির নয়; দেশটা আমাদের সবার। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সবাই উদ্যাপন করবে। অবশ্যই উদ্যাপনটা হবে যার যার অবস্থান থেকে। শনিবার এক মতবিনিময় সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ একটা ইতিহাস, সেটাকে সম্মান দিতে হবে।’ আওয়ামী লীগও বিএনপির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপির ৭ মার্চ পালনের প্রচেষ্টা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে ইতিবাচক আবহ তৈরি করবে।’
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাজপথে সমান্তরাল কর্মসূচি পালন করেছে। সেই বাংলাদেশে এই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপির রাজপথে নামার অধিকার থাকবে না, এ কেমন কথা...
তবে রাত পার হতেই রাজনীতির এই ইতিবাচক আবহ পিটিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে পুলিশ। কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছিল। কিন্তু পুলিশ ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের রাস্তায় দাঁড়াতেই দেয়নি। পিটিয়ে, কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। গত সপ্তাহেও প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপির আরেকটি সমাবেশ পুলিশ পিটিয়ে পণ্ড করে দিয়েছিল। পুলিশের অভিযোগ, বিএনপি বা ছাত্রদল সমাবেশ করার অনুমতি নেয়নি। সমস্যা হলো, চাইলেও পুলিশ বিএনপি বা এর অঙ্গ-সংগঠনকে সমাবেশ করার অনুমতি দেয় না। বাংলাদেশে এই আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর রাজপথে সংগ্রাম করেছে, মিছিল করেছে, সমাবেশ করেছে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাজপথে সমান্তরাল কর্মসূচি পালন করেছে। সেই বাংলাদেশে এই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপির রাজপথে নামার অধিকার থাকবে না, এ কেমন কথা।
মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বিভিন্ন সংগঠন রাজপথে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে। অন্যদের ব্যাপারে নমনীয় হলেও বিএনপির ব্যাপারে পুলিশ ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে মাঠে নামে। বিএনপি কি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ দল? রাজপথে মিছিল-সমাবেশ করলে যানজট হয়, মানুষের ভোগান্তি হয়; সেটা আমরা জানি। তারপরও আমরা বছরের পর বছর সেটা করেছি। এখন যদি আমরা সব রাজনৈতিক দল মিলে সিদ্ধান্ত নেই, রাজপথে আর কোনো কর্মসূচি হবে না; সেটাও আলোচনার ভিত্তিতে হতে হবে। প্রতিবাদ-বিক্ষোভের বিকল্প স্থান বের করতে হবে। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে বিক্ষোভ দমন করা গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। শনিবার রাতে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে বিএনপি যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল, রোববার সকালে পুলিশের লাঠিতে তার জবাব গণতান্ত্রিক শোভনীয় হলো না।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি কখনও মিলবে না। রাজনৈতিক বিরোধ থাকবেই। যার যার অবস্থান থেকে তারা রাজনীতি করবে, কর্মসূচি পালন করবে। তবে রাজনীতিতে ইতিবাচকতা, সহিষ্ণুতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, পারস্পরিক মর্যাদার বিষয়টিও থাকতে হবে। বিএনপি যেটুকু ইতিবাচকতা দেখিয়েছে, আওয়ামী লীগ যেন তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেয়।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ