সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ : পুরুষতন্ত্রকেও হারাতে হয়েছে নারী ফুটবলারদের
সাফে বাংলাদেশের নারীদের সাফল্য দেশজ ফুটবলে নতুন এক আলোক রশ্মির প্রতিফলন। কিন্তু সেই আলো সরলরেখার মতো সোজাসুজি এসে পৌঁছায়নি। বেঁকেচুরে, দুমড়ে মুচড়ে এসেছে। তারপরও সেই ফুটবলীয় আলোয় আলোকিত হবে ফুটবল মহল।
কিন্তু নারী ফুটবলারদের জন্য কোনো আলোকিত বৃত্ত তৈরি হবে কী! কারণ, জাতীয় দলের এই ফুটবলারদের ওপরও এখন আলো অন্ধকারের ছায়া! কোথাও অন্ধকার। কোথাও হঠাৎ আলোর ছটা! এই সমাজেও তাই।
ভয়ঙ্কর সব কালো এসে ঘুরিয়ে দেয় সমাজের আলোর গতিপথ। নারী ফুটবলাররা পিছিয়ে থাকা এক সমাজ থেকে উঠে এসেছেন। তারা যতই আলো ছড়ান, যতই সাফল্য বয়ে আনুন দিনশেষে এই সমাজ তাদের গায়ে পরিচিত স্টিকার লাগিয়ে দেয়—‘এই মেয়ে হাফ প্যান্ট পরে ফুটবল খেলে!’
আরও পড়ুন : নারী ক্রিকেটার : ৫০০ টাকার ম্যাচ ফি থেকে আজ বিশ্বকাপে!
এই কথাগুলো শুনলে বাঙালির ফুটবল প্রেমও হোঁচট খায়! দিন পাল্টেছে, সময় পাল্টেছে। কিন্তু বাঙালির মনন বদলায়নি। ফুটবল নিয়ে তাদের আবেগের যে লাভাস্রোত বয়ে যায় বিশ্বকাপ এলে, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না নারী ফুটবল নিয়ে।
সেই আবেগ খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিলেন সানজিদা আখতার নামের এক ফুটবলার। তাও ঠিক নেপালের বিপক্ষে ফাইনালের আগের দিন। তার ফেসবুকের এক স্ট্যাটাস নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশ।
সানজিদার সেই স্ট্যাটাসে প্রতিশ্রুতি ছিল। অঙ্গীকার ছিল। না পাওয়ার আক্ষেপ ছিল। সমাজের উপেক্ষার কথা ছিল। অভাব-অনাটনের সাথে চিরন্তন লড়াইয়ের কথা ছিল। আবার সেখানেই প্রতিজ্ঞা ছিল।
নারী ফুটবলাররা পিছিয়ে থাকা এক সমাজ থেকে উঠে এসেছেন। তারা যতই আলো ছড়ান, যতই সাফল্য বয়ে আনুন দিনশেষে এই সমাজ তাদের গায়ে পরিচিত স্টিকার লাগিয়ে দেয়—‘এই মেয়ে হাফ প্যান্ট পরে ফুটবল খেলে!’
স্বাগতিক পাহাড়ি-কন্যাদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করার সংকল্প ছিল। সেগুলোই হয়তো বেশি চোখে পড়েছে আমাদের। আর আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে দেশের নারী ফুটবলে সমস্যার গর্তগুলো!
অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ, আমরা কার্পেটের নিচে আগুন লুকাতে চাই। সমস্যার গর্ত দেখতে চাইব কেন? বরং বলব গর্ত যেখানে আছে দরকার কী সেই পথে হাঁটার! কিন্তু সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন মেয়েরা শুধু বন্ধুর সেই পথে হাঁটেননি। রীতিমতো দৌড়েছেন।
দৌড়াতে দৌড়াতেই তারা বিজয় মঞ্চে উঠে পড়েলন। সানিজদা-সাবিনা-কৃষ্ণারা নিজেদের অদম্য ইচ্ছে দিয়েই জয় করলেন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। এই দৌড়ে তারা পাশে পেয়েছেন প্রায় পিতৃসম এক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনকে।
যিনি বাঙালির ক্রীড়া উপন্যাসের অমর চরিত্র 'কোনি'-র ক্ষিদিদার মতো, ‘ডাগ আউটে’ বসে বারবার বলে গেছেন, ‘ফাইট….! ফাইট…!’ শুধু মতি নন্দীর সৃষ্টি 'কোনি' নামটার জায়গায় আপনি বসিয়ে দিতে পারেন, সাবিনা, সানজিদা, কৃষ্ণাদের নাম।
আরও পড়ুন : শেখ কামালের শেষ ছোঁয়াটুকুও থাকবে না!
কিন্তু আন্তর্জাতিক ফুটবলে এগিয়ে যেতে হলে শুধু ফুটবলারদের মনোবল, ইচ্ছেশক্তি, শিরোপা জয়ের উদ্রেক বাসনাই যথেষ্ট নয়। দরকার আরও অনেক কিছু। প্রয়োজন পরিকাঠামো গড়ে তোলা। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। তার আগে দরকার সেইসব প্রতিভা খুঁজে বের করা। আর ছুঁড়ে ফেলতে হবে কাজ-চালানো অপেশাদারি ভাবনা-চিন্তাগুলো।
আনতে হবে পেশাদারি মানসিকতা। এই সব শুধু ভেবে বসে থাকলে চলেব না। তার প্রয়োগও দরকার। এই জায়গায় দায় এড়ানোর সুযোগ আর নেই। কারণ, মেয়েরা প্রমাণ করেছেন তারা পারেন। এখন দায়িত্ব দেশ, সরকার, ফুটবল ফেডারেশন, সবার।
এই মেয়েদের স্বপ্নের পরিধি আরও বেড়ে গেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন জয়ের পথ মসৃণ করে দিতে হবে সবাই মিলে। পাবলিক- প্রাইভেট-পিপল সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এগিয়ে যেতে পারে আমাদের নারী ফুটবল।
সত্যি কথা হচ্ছে, নারীদের খেলাধুলা এত বছর ধরে অর্থনৈতিক ভিত্তি পেতে লড়াই করছে। আর বেশিরভাগ নারী ক্রীড়াবিদের অর্থনৈতিক লড়াই শুরু হয় বাড়িতেই। এদের বেশিরভাগ ক্রীড়াবিদ উঠে আসছেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার এবং গ্রামাঞ্চল থেকে।
সানজিদার সেই স্ট্যাটাসে প্রতিশ্রুতি ছিল। অঙ্গীকার ছিল। না পাওয়ার আক্ষেপ ছিল। সমাজের উপেক্ষার কথা ছিল। অভাব-অনাটনের সাথে চিরন্তন লড়াইয়ের কথা ছিল। আবার সেখানেই প্রতিজ্ঞা ছিল।
তাদের জন্য খেলাধুলা একটা জীবিকার প্রতিশ্রুতি বহন করে। কিন্তু ক'জন পেয়েছেন? যাদের সেই ধরনের কোনো চাকরি জোটেনি, তারা ভবিষ্যতের বেকার! আর সামাজিক বৈষম্যের পাশাপাশি আর্থিক বৈষম্য আরও প্রকট। যা জন্ম দেয় অন্যরকম এক কষ্টের।
একটু সাফল্য পেলে হয়তো কিছু প্রতিশ্রুতি মেলে। এবারও হয়তো মিলেছ। কিন্তু আমরা কীভাবে ভুলে যাব, এই নারীদেরই ঈদের ছুটিতে গ্রামে পাঠানো হয়েছে গণপরিবহনে! এই সাফল্যে কী ঢাকা পড়ে যাবে হাজার অপমান আর লাঞ্ছনার ইতিহাস!
আরও পড়ুন : পাকিস্তানপ্রেমী বাংলাদেশি!
সাবিনা-সানজিদারা জানেন, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে জিতে গলায় পরা এই একটা মেডেল দেখিয়ে হয়তো আগামীতে কিছু লোককে বলতে পারবেন, দেশের জন্য তারাও একদিন সাফল্য বয়ে এনে ছিলেন। সেই কারণেই হয়তো কিছু মানুষ তাদের চিনবে। কিন্তু এই সমাজের বঞ্ছনা, অব্যবস্থা, দারিদ্র্য, রাজনীতি ইত্যাদির সঙ্গে দু’টি অতিরিক্ত বাধাও অতিক্রম করতে হয়েছে তাদের এবই সাফল্যের জন্য।
তার নাম—পুরুষতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্রের বাধা। ‘মেয়েদের খেলা’ আমাদের দেশে, আমাদের সমাজ এখনো পুরুষের খেলার মতো ‘সিরিয়াস ব্যাপার’ হিসেব নিতে পারেনি।
পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অনেক বাধা পেরিয়ে মেয়েরা খেলায় আসে। সবকিছুর আগে দরকার আমাদের এই মানসিকতার পরিবর্তন।
তারপরও অভিনন্দন বাংলাদেশের সাফ জয়ী নারী ফুটবলারদের। কারণ, বহুশ্রুত, বহু পুরোনো কথাটা ওরা উপলব্ধি করেছিলেন, ‘ওয়ান ক্যান নট উইন অ্যা সিলভার। ওয়ান ক্যান ওনলি লুজ অ্যা গোল্ড।' সাবিনা-সানজিদা-কৃষ্ণা, আপনারা স্বর্ণ জিতেছেন। আপনাদের অভিনন্দন।
অঘোর মন্ডল ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক