সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী : নেতৃত্বের নেত্রী
একটা গল্প দিয়েই লেখাটা শুরু করছি। দেশে তখন স্বৈরাচার বিরোধী তুমুল আন্দোলন। এক ভদ্রলোক তার শিশু সন্তানকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গিয়েছেন। তখন বক্তব্য রাখছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
শিশুটি বারবার তার বাবাকে বলছিল, সে বক্তাকে দেখবে। বাবা তার সন্তানকে কাঁধে তুলে নিলেন। বক্তাকে দেখার পর সেই শিশুর বিস্ময়, বাবা উনি তো নারী। সেই শিশু কল্পনাও করতে পারেনি, কোনো নারী এমন বজ্রকণ্ঠে এসব জ্বালাময়ী বক্তৃতা করতে পারেন।
আসলে বিস্ময়টা শুধু সেই শিশুর নয়, গোটা জাতির—স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একজন নারী রাজপথে এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন, তা ছিল বিস্ময়কর।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী-পুরুষ ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব যে ক’জন নারীর, তাদের নেত্রী ছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের প্রসঙ্গ এলেই আমরা শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়ার নাম বলি। এই দুইজনই রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। কিন্তু সাজেদা চৌধুরীরা রাজনীতিতে এসেছেন তৃণমূল থেকে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়।
আরও পড়ুন : সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন : শক্তিমান রাজনৈতিক সংগঠক
আওয়ামী লীগ দলটার শিকড় যে এত গভীরে তার অন্যতম কারণ সাজেদা চৌধুরীর মতো নেত্রীরা। দলের দুঃসময়ে কখনো আমিনা আহমেদ, কখনো সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, কখনো সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীরা প্রয়োজনে দলের হাল ধরেছেন।
বাংলাদেশে তখনকার বাস্তবতা বিবেচনায় পঞ্চাশের দশকে একজন নারীর রাজনীতিতে আসা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। পুরুষ কর্মীদের জন্য পথ যতটা সহজ ছিল, নারীদের জন্য ছিল ততটাই বন্ধুর, কণ্টক।
সাজেদা চৌধুরী সেই কণ্টক পথ পাড়ি দিয়ে শীর্ষে উঠেছেন। আমৃত্যু তিনি আওয়ামী রাজনীতির সাথেই সম্পৃক্ত ছিলেন, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ায় তিনি ছিলেন আপসহীন।
আওয়ামী লীগ দলটার শিকড় যে এত গভীরে তার অন্যতম কারণ সাজেদা চৌধুরীর মতো নেত্রীরা। দলের দুঃসময়ে কখনো আমিনা আহমেদ, কখনো সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, কখনো সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীরা প্রয়োজনে দলের হাল ধরেছেন।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সাজেদা চৌধুরী মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা যখন খন্দকার মোশতাক আহমেদের সাথে হাত মেলান অথবা পালিয়ে যান, তখনো অকুতোভয় সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে সক্রিয়ভাবে মাঠে ছিলেন। ১৯৭৬ সালে সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
তবে সাজেদা চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ১৯৮১ পরবর্তী সময়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করে দেশে ফিরিয়ে আনার মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং তার স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরীর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন : আওয়ামী লীগ : বহুত্ববাদ ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল
১৭ মে ১৯৮১। শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন। তারপর থেকে সাজেদা চৌধুরী ছিলেন তার ছায়াসঙ্গী। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দেশের রাজনীতির এক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে সাজেদা চৌধুরী ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
সাজেদা চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেছেন। আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই নারী, বিষয়টি মেনে নিতে অনেকের কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজের যোগ্যতায় সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। মাঠের লড়াইয়ে তার দৃঢ় ভূমিকা সাহসী করেছে কোটি মানুষকে। তিনি ছিলেন কর্মীবান্ধব, জনসম্পৃক্ত নেতা। দলের কর্মীদের মায়ের মমতায় সাহস জুগিয়েছেন, আবার দেশের প্রয়োজনে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় লড়াই করেছেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি গার্ল গাইড আন্দোলনেরও অন্যতম সংগঠক ছিলেন। নারীদের মূলধারার রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।
শেখ হাসিনা তাকে ফুফু ডাকতেন। কিন্তু মর্যাদা দিতেন মায়ের। সাজেদা চৌধুরীও মায়ের মমতায় শেখ হাসিনাকে আগলে রেখেছেন শত সঙ্কটে, রাজনীতির নানা কূটচাল, ষড়যন্ত্র থেকে...
২১ বছর পর, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তখন তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি। তবে তিনি টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ছিলেন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে।
২০০৯ সালের নবম সংসদে তিনি সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পান। এরপর দশম ও একাদশ সংসদেও তিনি উপনেতার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমৃত্যু ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।
আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
উপনেতার দায়িত্ব পাওয়ায় সংসদে তার আসন ছিল সংসদ নেতা শেখ হাসিনার পাশে। সবাই ভাবতেন প্রতীকী, আসলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পাশে থেকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আমৃত্যু শেখ হাসিনার পাশেই থেকেছেন। শেখ হাসিনা তাকে ফুফু ডাকতেন। কিন্তু মর্যাদা দিতেন মায়ের। সাজেদা চৌধুরীও মায়ের মমতায় শেখ হাসিনাকে আগলে রেখেছেন শত সঙ্কটে, রাজনীতির নানা কূটচাল, ষড়যন্ত্র থেকে।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে শেখ হাসিনা হারালেন অভিভাবক; জাতি হারালো একজন দেশপ্রেমিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহসী ও আপসহীন নেতা।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ