আইন মানুষের জন্য নাকি আইনের জন্য মানুষ?
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনের কাজ চলছে। এজন্য আইন সংশোধনের খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে সবার মতামত চেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সবারই মতামত দেওয়া প্রয়োজন। তবে মতামত বা পরামর্শ দেওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন অনেকে। আইনের পক্ষে বললে অনেকে তকমা দেবেন তামাকবিরোধী হিসেবে।
আবার খসড়া আইনের বিপক্ষে মতামত দিলে অনেকে তামাকপণ্যের দালাল বলে আখ্যা দেবেন। তামাক ভালো না খারাপ সেটি সবাই জানেন। কিন্তু আলোচনা করা দরকার আইন নিয়ে। কারণ রাষ্ট্র আইন করে জনগণের কল্যাণের জন্য। তা অবশ্যই বাস্তবতার সাথে মিল রেখেই করা হয়। যেমন—সৌদি আরবে চুরির অপরাধে হাত কেটে দেওয়া হয়। সেটি নিশ্চয় আমাদের বাস্তবতায় সম্ভব নয়। তাই আইন হবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে যা ইচ্ছে তাই আইন বানানো হবে আর সেটি জনগণ মানতে বাধ্য হবে, তা হতে পারে না।
সরকার শুধু তামাক খাত থেকেই গত অর্থ-বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। এই অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আনীত প্রস্তাবগুলো যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য কি না তা আরও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া আইন পুনরায় সংশোধনের জন্য যে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে, সেখানে কয়েকটি এনজিও ছাড়া এই খাতের অংশীজনদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা তৈরি হওয়ায় ত্রুটিপূর্ণ আইন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ সালের। সর্বশেষ ২০১৩ সালে তা সংশোধিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে এই আইন বিধি চূড়ান্ত হয়। এবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই আইনের অধিকার সংশোধনের জন্য সব মানুষের মত জানতে একটা খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। টিসিআরসি’র গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমান আইনই এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি তখন কি উদ্দেশ্যে নতুন করে এই সংশোধন তা প্রশ্নবিদ্ধ।
এর মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির জন্য আলাদা লাইসেন্স নেওয়া, ফেরি করে তামাকজাত পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা, সিগারেটের শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট (ভ্যাপিং) নিষিদ্ধ, তামাক কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি নিষিদ্ধ করাসহ বেশকিছু অবাস্তব প্রস্তাবনা রয়েছে।
তামাক ভালো না খারাপ সেটি সবাই জানেন। কিন্তু আলোচনা করা দরকার আইন নিয়ে। কারণ রাষ্ট্র আইন করে জনগণের কল্যাণের জন্য...
প্রস্তাবিত খসড়ার ৬-গ ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলাধুলার স্থান, ইত্যাদি সীমানার মধ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ।
(১) কোনো ব্যক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলাধুলার স্থান ও শিশু পার্কের সীমানার ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবেন না।
(২) সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত সীমানার পরিধি বৃদ্ধি করিতে পারবে। (৩) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরনের অপরাধ সংঘটন করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ হারে দণ্ডনীয় হবেন।
এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে কোনো ১০০ মিটার জায়গা আছে? এই আইন যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে রাজধানীর কোথাও তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করার সুযোগ থাকবে না।
আরও পড়ুন : তামাক কেন ক্ষতিকারক?
পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, এরপরও আইন অমান্য করে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি হবে। প্রথমে কিছুদিন অভিযান চলবে, জরিমানা আদায় করা হবে, দণ্ড দেওয়া হবে। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে আইন ভাঙার। বাস্তবতার সাথে যদি আইন না করা হয়, তা মানতে মানুষ কেন বাধ্য হবে? যদি সত্যিই তামাকমুক্ত দেশ করতে চান, তাহলে তামাকপণ্য নিষিদ্ধ করুন।
তামাক থেকে রাজস্ব নিয়ে নিজেদের বেতন নিবেন আবার মানুষকে আইনের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেবেন এটা হতে পারে না। আইন মানুষের জন্য নাকি আইনের জন্য মানুষ। সরকার তামাক পণ্য নিষিদ্ধ করেনি। এই খাত থেকে অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রায় ১৩ শতাংশ অবদান রাখে। অর্থাৎ সরকারের এই রাজস্ব প্রয়োজন বলেই এখনো তামাকপণ্য নিষিদ্ধ হয়নি। এখন আইনের নামে মানুষের মাথায় বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধারা বাস্তবসম্মত নয়।
প্রস্তাবিত খসড়ায় ১০-ক (১) বলা হয়েছে, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির উপর বিধি নিষেধ—
(১) কোনো ব্যক্তি সম্পূর্ণ প্যাকেট, মোড়ক বা কৌটা ব্যতীত খুচরা বা খোলা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করবেন না বা করাবেন না।
(২) তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক ও কৌটার আকার আয়তন ও ওজন এবং এর তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের সংখ্যা ও পরিমাণ বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।
(৩) কোনো ব্যক্তি—(ক) (তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী কোম্পানি) এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করিলে উক্ত কোম্পানি অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
(খ) (তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কারী দোকানদার) এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
(গ) দফা (ক) ও (খ)-এ উল্লিখিত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই ধরনের অপরাধ সংঘটন করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ হারে দণ্ডনীয় হবেন।
আইন যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে রাজধানীর কোথাও তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করার সুযোগ থাকবে না....
সাধারণভাবে বাংলাদেশে যারা তামাকপণ্য ব্যবহার করেন তাদের বেশিরভাগই খুচরা কিনে থাকেন। এখন প্যাকেট বা কৌটা তামাক কেনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভব? এই আইনের কারণে ভাসমান ফেরিওয়ালাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবিকাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। এমনিতেই কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দ্রব্যমূল্যের দামই আকাশচুম্বী। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করতে কম আয়ের মানুষেরা হিমশিম খাচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও নাজুক। এই সময় এমন আইন মানুষের কতটা মঙ্গল বয়ে আনবে? মানুষ বাধ্য হয়ে আইন ভাঙবে। আবার কেউ কেউ এই আইনের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আখের গোছাবে। নীতিনির্ধারকদের উচিত বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সারাবিশ্বে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, সেখান থেকে বাংলাদেশ রক্ষা করতে হবে। করোনা মহামারি থেকে বের হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, এরপর যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংকশন। এর ধাক্কায় পড়েছে বাংলাদেশও।
আরও পড়ুন : স্বাস্থ্যের অব্যবস্থাপনা, দায়দায়িত্ব কার?
এখন যদি আইনের মারপ্যাচে ৮০ লাখের বেশি মানুষের জীবিকাকে প্রভাবিত করে, তাহলে এর দায় কে নেবে? ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। কিছুদিন কয়েকটা স্থানে আইন কার্যকর থাকলেও এখন কেউ তা মানেন না। আইন মানাতে প্রশাসনের কোনো উদ্যোগও নেই। এবারের খসড়া আইনে আরও কিছু এলাকা সংযোজন করা হয়েছে।
খসড়া আইনের (চ) ধারায় বলা হয়েছে—‘পাবলিক প্লেস’ অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌ-বন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্নিমাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণী ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোনো স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা, সময় সময় ঘোষিত অন্য যেকোনো বা সকল স্থান।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে চায়ের দোকানগুলো ভাসমান এবং অস্থায়ী হওয়ায় এই ধারা কতটা বাস্তবসম্মত তা ভাবার দরকার আছে। প্রায় ১৫ লক্ষ প্রান্তিক আয়ের জনগোষ্ঠীর মানুষ অধিকাংশই চা দোকানি। যদি পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞার আওতায় চায়ের দোকান আনা হয়, তাহলে তাদের জীবিকা ও আয়ের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। কারণ চায়ের দোকানে বিক্রি বেশি হওয়ার অন্যতম হাতিয়ার তামাক পণ্য। এতে যেমন বেকারত্ব বাড়বে পাশাপাশি আইনের অপপ্রয়োগে সাধারণ মানুষ হয়রানি শিকার হতে পারে।
তাছাড়া তামাক পণ্য বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়। অথচ প্রায় সব স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্দিষ্ট ধূমপান এলাকা থাকলে ধূমপায়ীরা নির্দিষ্ট স্থানে ধূমপান করতে বাধ্য হবে। তাছাড়া যেখান সেখানে ধূমপান করার প্রবণতা বাড়বে। তৈরি হতে পারে বিশৃঙ্খলা। এছাড়া ধূমপায়ীরা নির্দিষ্ট স্থানে ধূমপান করলে অন্যান্য অধূমপায়ী, নারী ও শিশুরা পরোক্ষ ধূমপান থেকে নিরাপদ থাকবে। বর্তমান আইনের আওতায় নির্দিষ্ট ধূমপান এলাকা থাকায়, ধূমপায়ীরা নির্দিষ্ট স্থানে ধূমপান করতে বাধ্য।
তামাক থেকে রাজস্ব নিয়ে নিজেদের বেতন নিবেন আবার মানুষকে আইনের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেবেন এটা হতে পারে না। আইন মানুষের জন্য নাকি আইনের জন্য মানুষ।
আইনের খসড়ার (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত বা লভ্য ও প্রচারিত, বিদেশে প্রস্তুতকৃত কোনো সিনেমা, নাটক বা প্রামাণ্য চিত্রে তামাকজাত দ্রব্য ও ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ব্যবহারের দৃশ্য টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান বা অন্য কোনো গণমাধ্যমে প্রচার, প্রদর্শন বা বর্ণনা করবেন না বা করাবেন না।
এই আইনের কারণে চলচ্চিত্র, নাটক, তথ্যচিত্রে কোথাও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার দেখানো যাবে না। তাহলে শিল্প নির্মাণে এই আইন বাধা দেবে না?
খসড়া আইনের ৬ (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ই-সিগারেট (ভ্যাপিং) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ই-সিগারেটের ভেতরে নিকোটিন, প্রোপাইলিন গ্লাইকল অথবা ভেজিটেবল গ্লিসারিন এবং সুগন্ধি মিশ্রিত থাকে। কিন্তু তামাকের ভেতর থাকা অনেক বিষাক্ত রাসায়নিকের তুলনায় (যেমন টার এবং কার্বন মনোক্সাইড) নিকোটিন তুলনামূলক কম ক্ষতি করে।
আরও পড়ুন : স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?
নিকোটিনের কারণে ক্যান্সার হয় না, কিন্তু সাধারণ সিগারেটের ভেতরে থাকা তামাকের কারণে ক্যান্সার হতে পারে। এই কারণেই ধূমপান বন্ধ করতে নিকোটিন গ্রহণের মাধ্যম পরিবর্তনের জন্য অনেক বছর ধরে পরামর্শ দিয়ে আসছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। যার মধ্যে রয়েছে গাম, স্কিন প্যাচেস বা মুখে স্প্রে করা।
চিকিৎসক, স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞ, ক্যান্সার নিয়ে কাজ করা দাতব্য সংস্থা বা যুক্তরাজ্যের সরকার, সবাই একমত হয়েছে যে, বর্তমানে যেসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেট সামান্যই ঝুঁকি বহন করে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সিগারেট বা ধূমপানের তুলনায় এভাবে ধোঁয়া নেওয়া ৯৫ শতাংশ কম ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা একমত যে, প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেটে ঝুঁকির মাত্রা অনেক কম।
পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড (পিএইচই) এক গবেষণায় দাবি করা হয়, ধোঁয়ার চেয়ে বাষ্প অনেক বেশি নিরাপদ। তামাক সিগারেটের চেয়ে ই-সিগারেটে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ কম।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, সৌদি আরব, ইউএই, ফিলিপিনসহ বিভিন্ন দেশ যারা ধূমপানমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে এরই মধ্যে বেশকিছু বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা সব তামাক পরিত্যাগ সহায়ক পণ্যগুলো স্বতন্ত্র অধ্যায়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের আওতায় এনে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করছে। অথচ বাংলাদেশে তার কোনো উদ্যোগ নেই।
উপধারা (৩)-এর পরিবর্তে নতুনভাবে উপ-ধারা (৩) যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়-(৩) অন্য কোনো আইন, বিধি, সার্কুলার বা প্রজ্ঞাপনে যা কিছুই থাকুক না কেন, তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী ও ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যক্তি সরাসরি বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচিতে (সিএসআর) অংশগ্রহণ করিতে পারবেন না।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ। ২০১৩ সালের দূরদর্শী সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২২ সালে এসে সরকার এই সংখ্যা সাফল্যের সাথে ৩৪ শতাংশ নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
অথচ কয়েক দশক ধরে তামাক কোম্পানি সিএসআর প্রকল্পগুলো দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। এরমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ, আর্সেনিক রোগ ও বিশুদ্ধ পানি সংকট মোকাবিলায় নিরাপদ খাবার পানির প্লান্ট স্থাপন এবং জীবাশ্ম জ্বালানি দ্বারা প্রস্তুত বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এই প্রকল্পগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছে।
আমাদের মনে রাখা জরুরি, সিএসআর মানে কোনো পরোপকার নয়। দয়া বা করুণা তো নয়ই। ব্যবসার নৈতিকতা আছে, যে সমাজের মধ্যে ব্যবসা হবে, সেই সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান সমাজের জন্য কিছু করছে, তারা কিন্তু অন্যদের থেকে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে।
সমাজ ও ব্যবসায়ীদের এই বিষয় বুঝতে হবে। ইউরোপ-আমেরিকাতে অনেক আগেই এই কাজটি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যেন উল্টো চিত্র। আইন করে তামাক কোম্পানির জন্য সিএসআর বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে কার লাভ হবে? যেসব মানুষ সিএসআর প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করছিলেন তাদের কী দোষ?
আরও পড়ুন : সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন কেন জরুরি
কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, যুদ্ধসহ সব ধরনের সংঘাতে পৃথিবীতে প্রতি বছর মানুষের আয়ু যতটা কমে, তার চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি গড় আয়ু কমে বায়ু দূষণের কারণে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর মৃত্যুর হার ধূমপানের ফলে হওয়া মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে। এজন্য ২০১৫ সালে মানুষের গড় আয়ু ও মৃত্যুর হার গণনা করেন এবং তারা দেখতে পেয়েছেন, বায়ু দূষণের কারণে পৃথিবীতে প্রতিবছর ৮৮ লাখ মানুষ মারা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, ধূমপানের কারণে প্রতি বছর ৮২ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় বিশ্ব জুড়ে। এর মধ্যে ৭০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় সরাসরি সিগারেট এবং তামাকজাত পণ্যের ব্যবহারের কারণে। বায়ু দূষণ যে নতুন ধূমপান এতো আর গোপন কথা নয়। গবেষকেরা মনে করেন, কয়েক দশকে ধূমপানের তুলনায় বায়ু দূষণের দিকে অনেক কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
বায়ু দূষণ রোধে বাংলাদেশ খুব বেশি কিছু করতে না পারলেও ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার রোধে অনেকটা এগিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ। ২০১৩ সালের দূরদর্শী সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২২ সালে এসে সরকার এই সংখ্যা সাফল্যের সাথে ৩৪ শতাংশ নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে ধূমপানমুক্ত দেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়েছে, তা অবশ্যই সফল হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে করোনা মহামারির সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করেছিলেন। বিশ্বে টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি অনেক বছর থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন গবেষকেরা। তাই এমন আইন করা উচিত নয়, যার কারণে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর প্রভাব পড়ে।
বিপ্লব কুমার পাল ।। গণমাধ্যমকর্মী