মুশতাক কেন কারাগারে গেল?
সাংবাদিক শওকত হোসেন মাসুম প্রশ্ন করেছেন― ‘কারাগারে কীভাবে মৃত্যু হলো, সে তদন্তের আগে জরুরি হচ্ছে মুশতাক কীভাবে কারাগারে গেল, কার কারণে গেল, কেন জামিন হলো না, সেটা জানা।’
আমার কাছেও মনে হয়েছে এই প্রশ্নটার উত্তর খোঁজা যেমন জরুরি, তেমনি দরকারি এই প্রশ্নটা তোলাও। মুশতাক কি তাহলে ‘কারো জন্য’ গ্রেফতার হয়েছিলেন? সেই ‘কারোটা’ কারা? যারা পুরো রাষ্ট্রকেই নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে, তারা? আমাদের প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা এমনকি পুরো রাষ্ট্র ‘কারো কারো’ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইঙ্গিতটা তাদের দিকেই যায়।
মাসুমের এই প্রশ্নটার সঙ্গে আমি আরও একটু যোগ করতে চাই, কারাগারে আসলে কারা যায়?
দিনেদুপুরে অস্ত্র তাক করে গুলি করতে উদ্যত হওয়া কোনো কোনো তরুণ, গ্রেফতার হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জামিন পেয়ে যায়, মুশতাকের জামিন হয় না ৯ মাসেও, অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও না।
হ্যাঁ, সবাই কিন্তু কারাগারে যায় না। এই যে ধরেন, দেশের হাজার কোটি টাকা যারা লুটপাট করে পাচার করে দিয়েছে, তারা কি সহজে জেলে যায়? তারা কি গ্রেফতার হয়? তাদের জন্য কি জামিন-অযোগ্য কোনো আইন আছে? তাদের কেউ কোনো কারণে জেলে ঢুকে গেলে কি অসুস্থ হয়ে মারা যায়? খুন করে জেলে গিয়েও অনেকে পিজি হাসপাতালে মাসের পর মাস নিজ বাড়ির চেয়েও আরাম-আয়েশে থাকেন। মুশতাক, কিশোররা সেই অর্থে চিকিৎসাই পায়নি। দিনদুপুরে অস্ত্র তাক করে গুলি করতে উদ্যত হওয়া কোনো কোনো তরুণ, গ্রেফতার হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জামিন পেয়ে যায়, মুশতাকের জামিন হয় না ৯ মাসেও, অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও না।
সরকারের বিরুদ্ধে কেউ যে কথা বলেন না, তা তো না। মুশতাক কি এমন ‘ভয়ানক’ কথা লিখে ফেলেছিলেন, তা পরিষ্কার না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে দুটি লেখাকে তার গ্রেফতারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, তার চেয়েও শক্ত লেখা ঢাকার পত্রিকায় হরহামেশাই প্রকাশিত হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। তাহলে মুশতাককেই কেন গ্রেফতার করা হয়েছিল? কেন ৯ মাস ধরে বারবার তার জামিন নাকচ করে দেয়া হয়েছিল? কার জন্য?
মুশতাকের মৃত্যুর পর সবাই বেশ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। এই প্রতিক্রিয়া জানানোটা জরুরি। আমাদের তারুণ্যে আমরা এই ধরনের যেকোনো হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উচ্চারণ করতাম― ‘খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনি তোদের রক্ষা নাই।’
মুশতাকের মৃত্যুর পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে সবাই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি। আমরা কি সব ঘটনায় এ রকম সোচ্চার থাকি? কখনো কখনো আমরা কি এই আইনের পক্ষে সরব হয়ে উঠি না?
সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এক তরুণকে গ্রেফতার করা হয়। তরুণটি মহল্লায় মসজিদ না বানিয়ে কিছু খেলার মাঠ নির্মাণের প্রস্তাব করেছিল। বিস্ময়কর তথ্য হলো, তাকে গ্রেফতারের পক্ষে অসংখ্য মানুষ সমর্থন দিয়েছেন। এ রকম অসংখ্য গ্রেফতারের পক্ষে আমরা প্রতিনিয়ত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি।
মুশতাকের মৃত্যুর পর সবাই বেশ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। এই প্রতিক্রিয়া জানানোটা জরুরি। আমাদের তারুণ্যে আমরা এই ধরনের যেকোনো হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উচ্চারণ করতাম― ‘খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনি তোদের রক্ষা নাই।’
আমাদের যৌবনের, তারুণ্যের প্রিয় পঙ্ক্তি ছিল এই লাইনগুলো। অনেক বছর এই পঙ্ক্তিগুলো শুনিনি। কাল যখন ফেসবুকে বাঘ বিশেষজ্ঞ, লেখক খসরু চৌধুরী লিখলেন, ‘নতুন প্রজন্ম, অন্তত একবার বলুন, খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনি তোদের রক্ষা নাই।’ তখন বুকের ভেতরটা আনচান করে উঠল। আহা! আমাদের তারুণ্যের সেই প্রিয় কবিতাটি! আমিও বলি, কেবল নতুন প্রজন্মই নয়, সব প্রজন্মই বলুক, ‘খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনি তোদের রক্ষা নাই।’
সরকারকে বলি, ঢাকার রাস্তায় যারা মনের বেদনাকে, ক্ষোভকে প্রকাশ করতে চাইছে, তাদের সেটি করতে দিন। বরং তাদের ক্ষোভ প্রকাশে সহায়তা করুণ মানুষের মনের ভেতর পুঞ্জীভূত হয়ে জমে থাকা ক্ষোভ কিংবা বেদনা― দুটোকেই প্রকাশ করতে দিতে হয়।
একই সঙ্গে আমাদের, নাগরিকদের এই প্রশ্নটার উত্তর জানতে দিন, মুশতাক কীভাবে কারাগারে গেল? কার কারণে গেল? কেন জামিন হলো না?
শওগাত আলী সাগর ।। প্রধান সম্পাদক, নতুনদেশ (কানাডা ভিত্তিক বাংলা পত্রিকা)