সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম : লিঙ্গ বৈষম্য প্রবল কেন?
বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী। জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত এই ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৬২ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৫৮.৪ ভাগ।
বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা গড়ে দৈনিক ২ ঘণ্টা ২৭ মিনিট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেন (স্টাটিস্টা রিপোর্ট, ২০২২)। বাংলাদেশও বৈশ্বিক এই ধারার বাইরে নয়। জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ (ডেটা রিপোর্টাল)। ফেসবুকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩০ ভাগ নারী এবং ৭০ ভাগ পুরুষ ব্যবহারকারী।
মানুষ এখন তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপর নির্ভরশীল। নির্ভরশীল বলা পুরোপুরি সঠিক না হলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেই ব্যবহারকারীরা অনেক তথ্য প্রথম জানতে পারেন।
আরও পড়ুন : সাইবার বুলিংয়ের শিকার শিশু থেকে তারকা : সমাধান কোথায়?
ব্রেকিং নিউজ হলে সেটা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই আগে চলে আসে। একটি কারণ হতে পারে, সংবাদ মাধ্যমগুলোর যেমন খবরের সত্যতা যাচাই করার দায়িত্ব থাকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সেই দায়ভার নেই।
এটিই এই মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য এবং ক্ষেত্র বিশেষ দুর্বলতা। তবে, দিনশেষে মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জানানোর জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোই।
ফেসবুকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩০ ভাগ নারী এবং ৭০ ভাগ পুরুষ ব্যবহারকারী...
যেহেতু এই নতুন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই পাওয়া যাচ্ছে, সেহেতু এটি বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চাকরির বিজ্ঞাপন, ব্যবহারকারীরা তাদের ইমোশন থেকে শুরু করে প্রমোশন সবকিছু প্রকাশের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই।
সেটি করা কতটুকু উচিত আর কতটুকু অনুচিত, সেটি অন্য আলোচনা। কিন্তু, আমাদের বর্তমান সমাজ বাস্তবতার অনেকাংশই যেহেতু উঠে আসে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেহেতু সেই মাধ্যমে চেতনে বা অবচেতনে কতটুকু বৈষম্য চলে আসছে, ইতিমধ্যে সেটি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন : মুঠোফোনে আসক্তি বাড়ার কারণ কী?
বিভিন্ন ধরনের গবেষণা ও রিপোর্ট অনুযায়ী, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ইতিমধ্যে ফুটে উঠতে শুরু করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪৫টি দেশের প্রায় ৪৫০০ জন নারী অংশগ্রহণকারীর ডেটা নিয়ে ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের করা সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শতকরা ৩৫ ভাগ নারী নিজেই অনলাইন নির্যাতনে শিকার হয়েছেন, শতকরা ৬৫ ভাগ নিজেদের আশপাশের অন্য কাউকে নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছেন। শতকরা ৮৫ ভাগ নারী নিজেদের চেনা হোক আর অচেনা হোক কাউকে না কাউকে নির্যাতিত হতে দেখেছেন।
এই চিত্র যদিও অনলাইনের ক্ষেত্রে তুলে ধরা হয়েছে, তবুও বলার অপেক্ষা রাখে না, অনলাইন বলতে অনেকের ক্ষেত্রেই সেটি কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপস্থিতিই নির্দেশ করবে। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, প্রতি তিনজনে একজন নারী অনলাইনে পোস্ট করার আগে অন্তত দুইবার চিন্তা করেন।
আরও পড়ুন : পাবজি : অনলাইন গেইমের রীতিনীতি ও অর্থনীতি
প্রতি দশ জনে নয়জন নারী তাদের অনলাইন কার্যক্রম সীমিত করে রাখে যেটি তাদেরকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা কিংবা চাকরি সংশ্লিষ্ট নানান রকম সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন।
শুধু ব্যবহারকারীদের আচরণের মাধ্যমেই নয়, সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে যে, এই মাধ্যমগুলো ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা ও সমতার অধিকার নিশ্চিত করার চেয়ে অধিক পরিমাণ মুনাফা করার দিকেই বেশি মনোযোগী।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০০ জন নারী আইন প্রণেতা, ২০২১ সালে ফেসবুকে লেখা একটি চিঠির মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক বিভ্রান্তির পরিবর্ধন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
নারীদের প্রতি নির্দেশিত বেশিরভাগ ঘৃণ্য বিষয়বস্তু ফেসবুক অ্যালগরিদম দ্বারা পরিবর্ধিত হয় বলেও বিভিন্ন তথ্যসূত্র দিয়ে, অন্যান্যদের সাথে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি (Nancy Pelosi) সই করা, সেই চিঠিতে দাবি করা হয়েছিল।
শতকরা ৩৫ ভাগ নারী নিজেই অনলাইন নির্যাতনে শিকার হয়েছেন, শতকরা ৬৫ ভাগ নিজেদের আশপাশের অন্য কাউকে নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছেন...
সম্প্রতি ইউকে ভিত্তিক গ্লোবাল উইটনেসের করা এক নিরীক্ষায় চাকরির বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদে করা ফেসবুকের বৈষম্য আপত্তিকরভাবে ফুটে উঠেছে। গ্লোবাল উইটনেসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, তারা মেকানিক, নার্স, পাইলট এবং মনোবিজ্ঞানী, এই চার ধরনের চাকরির জন্য ফেসবুকে বিজ্ঞাপন প্রদান করেন।
আরও পড়ুন : টিকটক, লাইকি, পাবজিরই কি সব দোষ?
ফেসবুকের অ্যালগরিদম মেকানিকের চাকরির বিজ্ঞাপন যাদেরকে প্রদর্শন করে তাদের মধ্যে শতকরা ৯৬ ভাগ পুরুষ এবং নার্সের চাকরির বিজ্ঞাপন যাদেরকে প্রদর্শন করে তাদের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ নারী। ৭৫ ভাগ পাইলটের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়েছে পুরুষ ব্যবহারকারীদেরকে এবং ৭৭ ভাগ মনোবিজ্ঞানীর বিজ্ঞাপন দেখানো হয়েছে নারী ব্যবহারকারীদেরকে।
সাম্প্রতিক গবেষণার (B Imana, 2022) দাবি অনুযায়ীও দেখা যায়, ফেসবুক চাকরির বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পরিষ্কারভাবে লিঙ্গভেদে বৈষম্য করে, যেটির সাথে যোগ্যতার কোনো সম্পর্ক নেই।
আরেকটি গবেষণা (E Sivak, 2019) প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্য দিয়ে শেষ করি। রাশিয়ার এক সোশ্যাল মিডিয়া সাইটের প্রায় ৬ কোটি পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অভিভাবকেরা কন্যা সন্তানের তুলনায় পুত্র সন্তনাকে নিয়ে শতকরা ২০ ভাগ বেশি পোস্ট করে।
আরও পড়ুন : সাইবার অপরাধ : নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ ও আইন
আরও দেখা গেছে, পুত্র সন্তান নিয়ে করা পোস্ট অন্তত দেড়গুণ বেশি লাইক পেয়ে থাকে সামাজিক মাধ্যমে। এই ধরনের ডেটা আসলে এই সংকেতই দিয়ে থাকে যে, মানুষ এখনো কন্যা সন্তান অপেক্ষা পুত্র সন্তানের দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়ে বসে আছে। সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে যেটি আসলে কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বস্তুত, এইসব বৈষম্য দূরীকরণে ব্যবহারকারী এবং প্ল্যাটফর্ম সকল পক্ষেরই ভূমিকা রাখার প্রয়োজন আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে, সেখানে যৌক্তিক এবং আইনি দিকগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
শুধু ডেটা থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে হবে না। অন্যদিকে, ব্যবহারকারীদের আচরণ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, আইনগত বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি নিয়েও ভাববার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
ড. বি এম মইনুল হোসেন ।। সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]