আইয়ুব বাচ্চু : রুপালি গিটার ফেলে
বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৬ সালে অবসকিওরের প্রথম অ্যালবামের সময়। সারগাম-এ দেখা, পরিচয় আর হৃদ্যতা। আমাদের অ্যালবামের পর সারগামে প্রায় প্রতিদিন যেতাম, নানা রঙের নানা বর্ণের মানুষের সাথে দেখা হতো।
সময়ে কেউ কেউ অনেক রঙ বদলেছেন আর কেউ কেউ সেই একই রকম আছেন এখনো। বাদল ভাই সারাদিন হাতে একটা অ্যাকুস্টিক গিটার নিয়ে তিরিং বিরিং টাইপের আওয়াজ করে যেতেন। গিটার শিখছেন উনি তখন।
একদিন সারগামে ঢুকেছি, বাচ্চু ভাই আমাকে দেখে বললেন, ‘তোকেই খুঁজছি। চিটাগাং-এ শো করবি একটা? দশ হাজার টাকা পাবি।’ অবসকিওরের জীবনের প্রথম শো যেটাতে আমরা টাকা পাব। আমি সাথে সাথে রাজি। চিটাগাং-এ যাওয়ার ট্রেন ভাড়া আর যন্ত্রপাতি ভাড়াতেই প্রায় সব টাকা চলে যাবে, তাতে কী? জীবনের প্রথম শো।
আরও পড়ুন : আজম খান : আসি আসি বলে তুমি আর এলে না
কমলাপুর পৌঁছে আমরা সেই ভারী ভারী এসপি ২, ড্রামস, কিবোর্ড, গিটার সব নিজেদের ঘাড়ে করে নিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে ট্রেনে উঠেছিলাম কারণ কুলির ভাড়া দিলে কোনো টাকাই আর থাকে না। এখন অবশ্য মনে নেই, তবে শো করে কিছু টাকাও বাঁচিয়েছিলাম আমরা।
আমাদের দ্বিতীয় অ্যালবামের রেকর্ডিং প্রায় শেষ পর্যায়ে। সারগামে প্রতিদিনের যাতায়াত আমার, অন্য কারো শিফট থাকলে স্টুডিওর বাইরে বসার জায়গায় আড্ডা চলে বিভিন্ন মানুষের। দিনে একবার হলেও মিউজিশিয়ানদের সারগামে ঢুঁ মারা চাই।
একদিন সন্ধ্যায় ঢুকেছি, শুনলাম বাচ্চু ভাই ভেতরে। দরজায় নক করে ভেতরে গেলাম। স্টুডিওর অনেকগুলো লাইট বন্ধ করা, বেশ একটা চাইনিজ হোটেলের মতো আবহ। আমাকে দেখে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করার ইশারা করলেন তিনি।
বাচ্চু ভাইয়ের সামনে কাগজ কলম, গুনগুন করছেন আর লিখছেন আবার কাটছেন, এভাবে শেষ করলেন লেখা। শুনলাম আর ভালো লাগায় মন ভরে উঠল। এক অনবদ্য সৃষ্টির সাক্ষী হলাম...
গিটার বাজিয়ে একটা গানের সুর গুনগুন করছেন, কী গান বুঝতে পারছি না। বুঝলাম নতুন কিছু, আর শুনতে ভারী মিষ্টি লাগছিল। পান্না ভাই, বাদল ভাই ভেতরে, আর কে কে ছিল, মনে নেই। লিরিক্স পুরো হয়নি, বাজিয়ে বাজিয়ে সেটা লেখালেখি চলছে।
আরও পড়ুন : সংস্কৃতি খাতে বাজেট এত কম কেন?
বাচ্চু ভাইয়ের সামনে কাগজ কলম, গুনগুন করছেন আর লিখছেন আবার কাটছেন, এভাবে শেষ করলেন লেখা। শুনলাম আর ভালো লাগায় মন ভরে উঠল। এক অনবদ্য সৃষ্টির সাক্ষী হলাম যেটা এখনো আমার প্রিয় গানের তালিকায় থেকে গেছে—
‘ও বন্ধু তোমায় যখনই মনে পড়ে যায়,
বুকেরই মাঝে বড় বেশি ব্যথা বাজে,
আমার ইচ্ছে করে প্রাণ ভরে তোমায় দেখি,
আমায় কথা দাও কখনো ছেড়ে চলে যাবে না...’
বাচ্চু ভাইয়ের শো ঢাকায় পাবলিক লাইব্রেরিতে। দেখতে গেছি। যাওয়ার পর জানা গেল ওনার গিটার নেই, কী সমস্যা জানি না। মিরপুরে তখন আমার খুব কাছের বন্ধু ফাহিম থাকে। ও উইনিং ব্যান্ডে বাজায়। এই সেই ফাহিম যার কারণে আমি গানে এসেছি আর এখনো গেয়ে যাচ্ছি।
আরও পড়ুন : ফকির আলমগীর: গণসংগীত যার সম্বল
ওর কাছে তখন বাংলাদেশের প্রথম ‘Flying V’ গিটার আছে একটা। বুলেটের মতো স্কুটার নিয়ে ফাহিমের কাছে গেলাম। ও কিছু না জিজ্ঞেস করে গিটারটা আমাকে দিয়ে দিল। ফিরে এসে বাচ্চু ভাইকে গিটার দিলাম। শো চলল আর এই প্রথম ওনার গলায় Bee Gees-এর ‘ট্র্যাজেডি’ গানটা শুনলাম। যে শুনেছে সেই জানে কত কাছাকাছি যেতে পারতেন উনি।
শামসুন নাহার হলের পাশে আমাদের প্র্যাকটিস প্যাড। প্রতিদিন ওখানেই চলছে আমাদের আড্ডা আর অনুশীলন। এর মাঝে আমাদের নতুন সব যন্ত্রপাতি আমি নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছি। যন্ত্রে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ তখন। বাচ্চু ভাই একদিন বললেন, ‘টিপুরে, নতুন ব্যান্ড করেছি, তোদের প্যাডটা প্র্যাকটিসের জন্য দিবি?’ মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বললাম। এলআরবি প্র্যাকটিস শুরু করল আমাদের ওখানে।
এলআরবি'র কোনো এক বর্ষপূর্তির আগে বাচ্চু ভাই ফোন দিলেন। বললেন, ‘গুলশানে রেস্তোরাঁয় চলে আসিস, শাওনকে অবশ্যই আনবি।’ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে শাওন ওনার ভীষণ আদরের ছিল। দেখা হলেই বুকে টেনে নিতেন। গেলাম একটু দেরি করে, অনেক মানুষ। আমাকে দেখেই বগলদাবা করে চেঁচালেন, ‘সবাই একটু চুপ করো।’ সব চুপ। বলা শুরু করলেন এই যে টিপু যার কারণে এলআরবি আজ এখানে।
আরও পড়ুন : সঞ্জীব চৌধুরী : শহরের নাম না জানা এক মাস্তান
আমি আর এলআরবি কৃতজ্ঞতা জানতে চাই ওকে। লজ্জায় আমি মাটিতে মিশে যাই। এলআরবি সারা বাংলাদেশে সবার অন্তরে জায়গা করে নিয়েছিল কিন্তু এই মানুষটা অতীত কখনো ভুলে যাননি। এলআরবি’র জন্য সবার অবদান মনে রেখেছিলেন।
একদিন নটরডেম কলেজের উল্টো পাশে বাচ্চু ভাইয়ের শো। কী একটা কাজে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। বাচ্চু ভাই স্টেজে ডাকলেন, ‘তোর মাঝরাতটা গা তো।’ বললাম, ‘আপনাদের সাথে তো তোলা নেই।’ বলল, ‘তুই গা, আমি বাজাচ্ছি।’
এই জীবনে মাঝরাতে চাঁদ তো অনেকবার গেয়েছি, কিন্তু ওইদিন আমার সাথে উনি যা বাজিয়েছিলেন সেটা এখন পর্যন্ত আর কোনো গিটারিস্টের হাত থেকে বের হয়নি।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন
সিলেটে যাচ্ছেন বাচ্চু ভাই, আমাকে বললেন, ‘তুই চল আমার সাথে।’ আমি বললাম, ‘কেন বাচ্চু ভাই?’ তিনি বললেন, ‘ওখানে অনেক গান গাইতে হবে তুই সাপোর্ট দিবি, হারমনি করবি।’ গেলাম। শো'র সময় ভুল করে হারমনিসহ মেইন লাইনও গাইতে থাকলাম। বিরতিতে দিলেন বকা, ‘তুই সব গাইলে আমি গাইবো কী করে?’
অনেক পরে আমরা মগবাজারে একই গলিতে থাকতাম। গাড়ি নিয়ে ঢুকতে বা বেরোতে দেখা হয়ে যেত মাঝে মাঝে। কাঁচ নামিয়ে চেঁচাতেন, ‘আসিস না কেন?’
একদিন আমাকে ফোন করলেন, ‘তুই না পালিয়ে বিয়ে করেছিস? কোথায় গেলে করা যায়?’ বললাম, ‘মগবাজার কাজি অফিস, আমাকে লাগবে না আপনি গেলেই হবে। টাকা-পয়সা পেলেই ওরা বিয়ে দিয়ে দেয়।’ ওখানেই গিয়েছিলেন কি না জানি না তবে বিয়েটা উনি সেরে ফেলেছিলেন।
বাচ্চু ভাই একদিন বললেন, ‘টিপুরে, নতুন ব্যান্ড করেছি, তোদের প্যাডটা প্র্যাকটিসের জন্য দিবি?’ মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বললাম। এলআরবি প্র্যাকটিস শুরু করল আমাদের ওখানে।
এলআরবি তখন আমাদের প্যাডে প্র্যাকটিস করছে। আড্ডা, গান নিয়ে ভালোই কাটছে সময়। আমরা তখন গোটা দেশে অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছি। গায়ে হলুদ, জন্মদিনও বাদ পরছে না বনিবনা হলে।
আরও পড়ুন : লতা মঙ্গেশকর : না যেও না
একদিন বাচ্চু ভাই বললেন, ‘গুলশানে একটা গায়ে হলুদের শো নিয়েছি, আমরা তো হিন্দি গান তুলি নাই তোরা পুরো ব্যান্ড নিয়ে এসে পর, জ্যাম করা যাবে আর আমাদের পাশাপাশি তোরা হিন্দিও গাইবি।’
ব্যান্ডের সবাইকে নিয়ে রাতে হাজির হয়ে গেলাম ওখানে। বাচ্চু ভাই গাইছেন তখন, আমাদের দেখে ইশারায় বসতে বললেন। বেশ কয়েকটা গান গাওয়ার পর উনি আমাদের ডাকলেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে। বললেন, ‘আজকে যদিও এলআরবি'র বাজানোর কথা কিন্তু আমরা দুটো ব্যান্ডই বাজাবো সবার জন্য।’
আমরা শুরু করলাম, একটা বাংলা একটা হিন্দি এভাবে চলছে। ঘণ্টাখানেক বাজাবার পর নামলাম, বাচ্চু ভাই শুরু করলেন আবার, এবার শুরু হলো BoneyM দিয়ে, চিরচেনা Rivers of Babylon, Holiday ইত্যাদি চলতে থাকল।
আরও পড়ুন : অঞ্জন দত্ত : তুমি আসবে বলে তাই
গায়ে হলুদে আসা মানুষজন ঠাঁই বসা, বাড়ি ফেরার তাড়া নেই কারো। রাত বাড়ছে, সামনে বসা মানুষের কেউ নড়ছে না, গান চলবে। বাচ্চু ভাই আমাকে বললেন, ‘আমরা গেলাম, তোরা শেষ করে তারপর যাস।’ আমাদের সবাইকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে গেলেন, আমরা বাজিয়েই যাচ্ছি। শেষ করলাম রাত প্রায় তিনটার দিকে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠছি, মেয়ের মা আমাকে ডাকলেন। সামনে যেতেই হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা খাম। আমার চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখে বললেন, ‘বাবা তোমাদের তো আসার কথা ছিল না, আমরা অনেক উপভোগ করেছি পুরোটা সময়, এটা তোমাদের জন্য আমাদের উপহার।’
ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম, গাড়িতে উঠে খামটা খুলে দেখি ওখানে পঁচিশ হাজার টাকা, মুগ্ধ হলাম মহিলার ভদ্রতায়, এখনকার সময় হলে পঁচিশ টাকা কেউ দিতো কি না সন্দেহ আছে আমার। আমরা দিন দিন আধুনিক হয়ে যাচ্ছি আর ভুলে যাচ্ছি শিষ্টাচার।
আরও পড়ুন : জর্জ হ্যারিসন : মুক্তিযুদ্ধ ও কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
চ্যানেল আইয়ের ব্যান্ড ফেস্ট, প্রথম থেকেই আমরা আছি। বাচ্চু ভাই ফোন দিলেন। বললেন, ‘সাগর ভাইয়ের কাছ থেকে এই দিনটা আমি চেয়ে নিয়েছি, তোদের থাকতে হবে।’ এই একটা মানুষ যিনি কোনোদিন আমার কোনো কথা রাখেননি তা হয়নি, আবার আমিও ওনার কোনো কথার অবাধ্য কখনো হয়েছি বলে মনে পড়ে না।
ব্যান্ড ফেস্ট-এর আগে আমি কলকাতায় যাচ্ছি। ফোন দিয়ে বললাম, ‘এবার অনেক গুছিয়ে করতে চাই বাচ্চু ভাই।’ বললেন, ‘আয় একদিন প্ল্যান করে নেব।’ ওটাই শেষ কথা ছিল ওনার সাথে। আমি ফিরে এসে ব্যস্ততার কারণে আর যোগাযোগ করিনি, প্রতিদিনই ভেবেছি যাব, যাওয়া হয়ে ওঠেনি। যদি জানতাম উনি চলে যাবেন তাহলে হয়তো গিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকতাম শক্ত করে। ব্যান্ড ফেস্ট হলো, কিন্তু বাচ্চু ভাইকে স্মরণ করে, এমন ফেস্ট আমি চাইনি ভাই, ওখানে বাজাতে ভালো লাগে না আর।
বছর ঘুরে ১৬ আগস্ট বাচ্চু ভাইয়ের জন্মদিন আসে, মানুষটা ফিরে আসে না, আসবেন না আর কোনোদিন। আমরা শুধু স্মৃতির অতল থেকে একজন বাচ্চু ভাইকে মনে করব। আমাদের একজন বাচ্চু ভাই ছিলেন, যার মতো গিটারের জাদুকর একজনও আর আসবেন না এই দেশে।
সাইদ হাসান টিপু ।। সংগীতশিল্পী