রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন সফল দার্শনিক?
অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে,
পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে।
গুরুগুরু গর্জন গুন্গুন্ স্বর
দিনরাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর।
দুঃখ সুখ দিবসরজনী
মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি।
শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ- ' পরে
ওরা কাজ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবতাকে জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। গুরুদেব বলেছিলেন, ‘যতদিন আমি বেঁচে আছি, আমি মানবতার উপর দেশপ্রেমের জয় হতে দেব না।’ গান্ধীর প্রতি ঠাকুরের অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু জাতীয়তা, দেশপ্রেম, সাংস্কৃতিক ধারণার আদান-প্রদান, যুক্তির মতো বিষয়ে তারা তার থেকে ভিন্ন ছিল।
আরও পড়ুন : রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য
প্রতিটি বিষয়ে ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অগতানুগতিক এবং যুক্তিপূর্ণ, যা বিশ্বের কল্যাণের সাথে সম্পর্কিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই গান্ধীকে 'মহাত্মা' উপাধি দিয়েছিলেন।
ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে আদিম সম্পর্ক তার সৃষ্টিতে বিভিন্ন রূপে ফুটে ওঠে। সাহিত্যের এমন কোনো ধারা কমই আছে যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।
গান, কবিতা, উপন্যাস, গল্প, নাটক, পরিচালনা, কারুকাজ, সব ধারাতেই তার রচনা বিশ্ববিখ্যাত। গীতাঞ্জলি, গীতালি, গীতিমালয়, কথা ও কাহিনি, শিশু, শিশু ভোলানাথ, কণিকা, খেয়া প্রভৃতি তার রচনায় বিশিষ্ট।
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না তিনি অনেক বই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। ইংরেজি অনুবাদের পর, তার কাজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন : অস্থির সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রাসঙ্গিক?
কবিগুরু শিয়ালদহ ছেড়ে ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে আসেন। তিনি প্রকৃতির কোলে কিছু গাছ, বাগান এবং একটি গ্রন্থাগার নিয়ে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে এখানে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বময় আরও আলো ছড়িয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে তার অনেক সাহিত্যকর্ম লিখেছেন এবং বর্তমানে তার স্থাপনা ভারতের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলে বিবেচিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় ২,২৩০টি গান রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার সঙ্গীতকে তার সাহিত্য থেকে আলাদা করা যায় না। তার বেশিরভাগ রচনাই এখন তার গানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঠুমরি শৈলী দ্বারা প্রভাবিত, এই গানগুলো মানুষের আবেগের অনেক ছায়া উপস্থাপন করে। বিভিন্ন রাগে কবিগুরুর গান এমন একটা ধারণা দেয় যেন সেগুলো সেই নির্দিষ্ট রাগের জন্যই রচিত।
আরও পড়ুন : পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলায় বেশি লিখলেও হিন্দিতেও তার জনপ্রিয়তা কম নয়। দেখা যায় বহু বছর ধরেই গুরুদেবকে শুধু বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের মানুষই দেবতা স্বরূপ মনে করেন না ভারতবর্ষে হিন্দিতেও বিভিন্নভাবে তাকে স্মরণ করা হয়।
আমি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের বাসা, বাড়ি বা অফিসে দেখেছি অনেক ঠাকুর দেবতার পাশে তার ছবিটিও পুষ্প মালায় সৌমেন স্থান পায়। সব সময়েই এই দৃশ্য বাঙালি হিসেবে নিজেকে খুব গর্বিত করে। তার লেখা, কবিতা, গান বা অন্য সবকিছুই এখন হিন্দি বা অন্য ভাষাতেও সর্বদা পাওয়া যায়।
অবাঙালিদের কাছেও তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা গুরুদেব হিসেবেই পরিচিত। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিনটি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের সাহিত্য : পঞ্চাশ পেরিয়ে
ভারতবর্ষের প্রায় সকল ভাষাতেই গুরুদেবকে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আখ্যায়িত করে তাকে বিশ্লেষণ করা হয়। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও চিত্রশিল্পী হিসেবেই বিশ্ব দরবারে বাঙালিদের যে সম্মান বা বিখ্যাত মহাকাব্য গীতাঞ্জলি সৃষ্টির জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনিই একমাত্র ভারতীয় সাহিত্যে যিনি নোবেল পেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র জীবন থেকে আমরা শুধু অনুপ্রেরণাই পাব তা নয়। তার জীবন দর্শনও সর্বদা আমাদেরকে সচেতন থাকার তাগিদ দিয়ে যায়।
তিনি সবসময় আমাদের কানের কাছে এসে যেন ফিসফিস করে বলেন—মানুষ চাইলে নিজের ইচ্ছেয় এবং স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে যেকোনো অসম্ভব কাজ করে তার সফলতা অর্জন করতে পারে। শুধু তোমার কাজটুকু করে যায়।
নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]