বিতর্কিত রবীন্দ্রনাথ?
মৃত্যুর আশি বছর পেরিয়ে গেছে; আর দুই দশক পেরুলেই পৌঁছে যাবেন একশ বছরের কোঠায়। কিন্তু তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিতর্কের বয়স আরও বেশি দীর্ঘ। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিছু ছাড়েনি বিতর্কের বাঘ! অনেকেই হামলে পড়েছেন, নখদন্ত বিকশিত করে ছড়িয়ে দিয়েছেন রক্তাক্ত অক্ষর; পরিহাস এই যে, ইতিহাসের দিগন্তে তাদের কেউ কেউ বাঘ থেকে হয়ে গেছেন বাঘডাসা, কেউ কেউ আদতেই ছিলেন কাগজের বাঘ!
রবিকরোজ্জ্বল বঙ্গদেশে তারা কেউই উজ্জ্বল হয়ে বিচ্ছুরিত হননি। কারণ তাদের তর্ক ছিল অনৈতিহাসিক; ব্যক্তিগত ঈর্ষা কাতরতায় কেউ কেউ পুড়ে গিয়েছেন আপন অঙ্গারে। তাতে করে রবির কিরণের দ্যুতি কমেনি। তাকে ঘিরে আজও বয়ে চলে বিতর্কের হল্লা।
আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে শতবর্ষ ধরে বাঙালি তৈরি করে নিয়েছে রবীন্দ্র-গুজব। সেসবের কয়েকটি নিশ্চয়ই অনেকের জানা; একটি এরকম—কাজী নজরুল ইসলামকে ধুতুরার বিষ খাইয়ে পাগল বানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। যেটি ছিল মিথ্যাচার।
আরও পড়ুন : নতুন আলোয় জেগে উঠুক শিশুসাহিত্য
১৯৪২ সালে নজরুল নির্বাক হওয়ার পেছনের দায়ও রবীন্দ্রনাথের। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ তার আগেই, অর্থাৎ ১৯৪১ সালে স্বর্গবাসী হয়েছেন। আরেকটি গুজব এইরকম—নজরুলেরই নোবেল পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নজরুলকে উন্মাদ বানিয়ে, ব্রিটিশদের বাগিয়ে নোবেল কেড়ে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। অথচ নোবেল প্রাপ্তির বছর—১৯১৩ সালে নজরুলের বয়স ছিল বড়জোর ১৪!
চৌদ্দ বছরের ‘প্রতিভাবান বালক’টি কোন প্রতিভা বলে কোন অবদানের জন্য নোবেল পাবেন—সেই বিষয়ে গুজব খেকো বাঙালির কোনো ব্যাখ্যা নেই। তাছাড়া নজরুল তখনো নির্বাক হননি। এইসব কৌতুককর রবীন্দ্র-গুজবের বাইরে বাঙালির আরও আরও মাথা ব্যথা আছে। বাংলা ও বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রে ওইসব আলাপ জরুরি।
বিপুলসংখ্যক বাঙালির ধারণা—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ; যার বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পেরেছেন বলে শুনিনি। অনেকের প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমানের জীবন নিয়ে লেখেননি? ‘হিন্দু’ রবীন্দ্রনাথের গান কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের রাষ্ট্র—বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত করা হলো?
আরেকটি গুজব এইরকম—নজরুলেরই নোবেল পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নজরুলকে উন্মাদ বানিয়ে, ব্রিটিশদের বাগিয়ে নোবেল কেড়ে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। অথচ নোবেল প্রাপ্তির বছর—১৯১৩ সালে নজরুলের বয়স ছিল বড়জোর ১৪!
কতখানি ‘দালাল’ হলে তিনটি রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত লিখতে পারেন একই ব্যক্তি? বলাবাহুল্য, একটি জাতীয় সংগীতও কোনো রাষ্ট্রের নির্দেশনা ও প্রয়োজন অনুসারে রবীন্দ্রনাথ লিখে দেননি। কারো কারো মতে, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৌলিক অবদান শূন্য।
একেবারেই নাবালক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক মন্তব্যের পাশাপাশি অনেকের দাবি, রবীন্দ্র-সাহিত্যে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার পরিচয় নেই। রবি ঠাকুর জমিদারি করেছেন আর সুদৃশ্য বজরায় ভেসে বেড়িয়েছেন পদ্মার ঢেউয়ে। তিনি ‘আসমানদারি’ করেছেন, তিনি মূলত ভাবের পূজারি। অতএব রবীন্দ্রনাথ অপাঠ্য, অদরকারি... ইত্যাদি।
আরও পড়ুন : অস্থির সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রাসঙ্গিক?
কোনো কোনো মহাত্মা এগিয়ে গিয়েছেন আরও কয়েক কাঠি ওপরে; রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তারা তৈরি করেছেন যুগ্ম বৈপরীত্য—হিন্দু / মুসলমান, লালন / রবীন্দ্রনাথ, নজরুল / রবীন্দ্রনাথ, ভাববাদ / বস্তুবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতাকে চাপিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাঁধে।
অতএব রবীন্দ্রনাথ মুসলমান বিরোধী, হিন্দুত্ববাদী, শ্রেণিবাদী চৈতন্যের পরিচয় বহন করেন এবং উচ্চবর্গ ও বুর্জোয়া। এসবের লেজুড় হিসেবে তারা বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিগঠনের সময় ইসলামী উপাদান পরিগৃহীত হয়নি। তারা এও বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির মর্মমূলে লেগে আছে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি।
এই বক্তব্যের পেছনে একটি অনুমান কাজ করছে, তা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদে ইসলামী উপাদান গৃহীত হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু কী সেই উপাদান, কোন সব উপাদান যুক্ত হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সঠিক হতো, সেই বিষয়ে মহাত্মারা নীরব।
কারো কারো বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রজাপীড়ক জমিদার। কৃষকদের ওপর খাজনা বাড়িয়েছেন। তার বিরুদ্ধে প্রজারা বিদ্রোহ করেছে। অতএব সমাজ সভ্যতার বাজারে রবীন্দ্রনাথের বাজার মূল্য অধিক হওয়া অনুচিত!
আরও পড়ুন : পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন
আহমদ শরীফের মতো পণ্ডিত গবেষকও লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ শিরোনামের একটি লেখা—যেটি নিঃসন্দেহে নির্দয় ও অবিবেচকী বক্তব্যে ভরপুর। সন্দেহজনক সূত্র ব্যবহার করে রচিত ওই লেখায় উপস্থাপিত রবীন্দ্রনাথ একজন ‘সামন্ত-জমিদার-বেণে’ মাত্র; আহমদ শরীফের ভবিষ্যৎ-বাণী, সামাজিক উপযোগহীনতার কারণে কালের হাওয়ায় তার কিছুই টিকবে না, ‘চুয়াল্লিশ বছর অপগত, ভক্ত অনুরক্তের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, শিগগিরই শূন্য হয়ে যাবে।’ চল্লিশ বছর আগে করা গণক সুলভ এই উক্তি নিষ্ফল হয়েছে।
অন্য এক মহাত্মা একবার লিখলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলমানদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (স.)-কে নিয়ে কিছু লেখেননি। বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য খুবই চমকপ্রদ, উপাদেয় ও অনুভূতি সম্পন্ন বক্তব্য। প্রশ্ন হলো, রবীন্দ্রনাথকে এসব বিষয়ে লিখতেই হবে কেন?
রবীন্দ্রনাথ কি সব কিছু লেখার দায় মাথায় নিয়ে বঙ্গদেশে আবির্ভূত হয়েছেন? কোনো লেখক কি অন্যের বাসনা মতো বক্তব্য প্রকাশের মুচলেকা দিয়ে লিখতে বসেন? উত্তর যা-ই হোক, সত্য এই যে, পয়গম্বর মুহম্মদকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। কমপক্ষে তিনটি লেখার সন্ধান দিয়েছেন অমিতাভ চৌধুরী—তিনটিই বাণী। ১৯৩৩, ১৯৩৪ ও ১৯৩৬ সালে হজরত মুহম্মদের (স.) জন্মদিন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ বাণীগুলো লিখেছিলেন।
বুদ্ধ ও যিশুকে বিষয় করে যেমন ভাবে লিখেছেন ঠিক তেমন প্রসারতায় লিপিবদ্ধ হননি নবী হজরত মুহম্মদ (স.)। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের মধ্যে একটি। এই কারণে ইহার অনুবর্তীগণের দায়িত্ব অসীম, যেহেতু আপন জীবনে এই ধর্মের মহত্ত্ব সম্বন্ধে তাহাদিগকে সাক্ষ্য দিতে হইবে।
আরও পড়ুন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : অপরাজেয় কথাশিল্পী
ভারতে যে সকল বিভিন্ন ধর্ম সমাজ আছে তাহাদের পরস্পরের প্রতি সভ্যজাতি যোগ্য মনোভাব যদি উদ্ভাবিত করিতে হয় তবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা তাহা সম্ভবপর হইবে না, তবে আমাদিগকে নির্ভর করিতে হইবে সেই অনুপ্রেরণার প্রতি, যাহা ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র ও মানবের বন্ধু সত্যদূতদিগের অমর জীবন হইতে চির-উৎসারিত। অদ্যকার এই পুণ্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে মস্লেম ভ্রাতাদের সহিত একযোগ ইসলামের মহাঋষির উদ্দেশে আমার ভক্তি-উপহার অর্পণ করিয়া উৎপীড়িত ভারতবর্ষের জন্য তাহার আশীর্বাদ ও সান্ত্বনা কামনা করি।’
আরেক মহাত্মা জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ মুসলমান শাসনকালকে বলেছেন সাড়ে পাঁচশ বছরের বিদেশি শাসন; ভারতীয় উপমহাদেশের / বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ইতিহাস স্বতন্ত্রভাবে বুঝতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। অতএব তিনি মুসলমান বিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িকতা উৎপাদনে তিনি কম দায়ী নন।
বেশিরভাগই রবীন্দ্রনাথকে বিচার করেন কেবলই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। তারা ভুলে যান, রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত সৃষ্টিশীল লেখক, গৌণত রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তি।
১৯৪৭-এর বিভাজনের দায়ভারও চাপানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাঁধে। ইসলাম ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ও রাজনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে রাবীন্দ্রিক বোঝাপড়ায় সংকট আছে, সন্দেহ নেই। যেমন সংকট আছে ব্রাহ্মধর্ম ও হিন্দু পরিচয় ঘিরে; রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো বক্তব্য মিশে গেছে পৌত্তলিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় হিন্দু পরিচয়ের সঙ্গে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক / দেশভাগের কারণ হিসেবে প্রমাণ করা চেষ্টাগুলো একেবারেই উদ্দেশ্যবাদী।
আরও পড়ুন : সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন এবং বাস্তবের ফাঁক-ফাঁকি
এই ধারার ব্যক্তিরা বোঝাতে চান, মুসলমান সমাজের প্রতি ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রবল অনীহা। আর তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে মুসলমান সমাজের সাহিত্যিক উপস্থাপনা নেই। টুকে রাখা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, প্রকৃতিবাদী ইত্যাদি ধর্মবিশ্বাস ও অনুসারীদের সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়েও রাশিরাশি সাহিত্য লিখে রেখে যাননি।
প্রশ্ন জাগে, ‘জমিদার-সামন্ত-বেনে-ভাববাদী’ ‘হিন্দু’/ ‘ব্রাহ্ম’ রবীন্দ্রনাথ মুসলমান সমাজের অন্দরমহল চিনতেন কীভাবে? মুসলমানের বিশ্বাস, সংস্কৃতির উপস্থাপনায় গলদ ঘটলে মুসলমানেরা কি ‘মানবিক ভুল’ বলে রবীন্দ্রনাথকে মাফ করে দিতেন? সেই সময়ের মুসলমান কবি-লেখকদের কত ভাগ বৌদ্ধ-হিন্দু-ব্রাহ্ম-খ্রিস্ট সমাজ ও সংস্কৃতির উপাদান সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন? উল্লেখ্য যে, কাজী নজরুল ইসলাম ‘কাফির’ তকমা পেয়েছিলেন মুসলমানদের থেকেই।
মূলত প্রেক্ষাপট-চ্যুত করে রবীন্দ্রনাথ আর সাহিত্যকে বিবেচনায় আনলে ব্যাখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হবেই। খেয়াল রাখতে হবে, বিশ শতকের প্রথম দুই-তিন দশকে ইসলাম, মুসলমান ও মুহম্মদ সম্পর্কিত বেশকিছু বিতর্কিত বই ও বক্তব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম দিয়েছিল। যেমন ১৯২৩ সালে বিতর্ক তুলেছিল রঙ্গীলা রসুল নামের একটি পুস্তিকা।
এরকম একটি প্রেক্ষাপটে লেখক রবীন্দ্রনাথের পক্ষে মুসলমানকেন্দ্রিক সৃষ্টিশীল রচনা হাজির করার উদ্যোগ ও উদ্যমে অস্বস্তি আসা কি অস্বাভাবিক? তাছাড়া অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া লেখক চাইলেই সংস্কৃতির অচেনা সীমানায় প্রবেশ করতে পারেন না; অবিশ্বস্ত উপস্থাপনা বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ।
আরও পড়ুন : বইমেলা ও প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে যারা সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি করতে চান, তাদের বেশিরভাগই রবীন্দ্রনাথকে বিচার করেন কেবলই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। তারা ভুলে যান, রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত সৃষ্টিশীল লেখক, গৌণত রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তি। তার সাহিত্য অরাজনৈতিক নয়; কিন্তু একই সঙ্গে এও মনে রাখা দরকার পেশাদার রাজনীতিক তিনি নন।
তার সাহিত্যের রাজনৈতিক পাঠ জরুরি হলেও ‘রাজনৈতিক পাঠ’ই একমাত্র পাঠ বলে গণ্য হতে পারে না। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক লেখাপত্র পড়তে গিয়ে মনে হয়, রবীন্দ্ররচনাবলী বুঝি রাজনীতির আকরগ্রন্থের সমাহার।
রবীন্দ্র-বিষয়ক বিতর্কের পরিসর একটি কিংবা দুটি নয়; বিতর্কের উৎসে আছে ধর্মীয়, নন্দনতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, জাতিক, আঞ্চলিক, শ্রেণিগত, লৈঙ্গিক মানদণ্ড। তার কালের তরুণেরা রাবীন্দ্রিক পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ থেকে খড়গহস্ত হয়েছেন, আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র-সাহিত্য বিষয়ে।
তরুণ কবিদের অনেকেই ব্যঙ্গাত্মক ইলিউশন হিসেবে ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথের উক্তি। পরিণত বয়সে তারাই আবার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্যে ভেসেছেন। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন ‘সিদ্ধিদাতা গণেশ’। বিষ্ণু দে লিখেছেন, পূর্ণাঙ্গ এক প্রবন্ধের বই। বুদ্ধদেবের আলোচনায় উঠে এসেছে প্রায় সমস্ত রবীন্দ্র রচনা। দিনেশ দাস লিখেছেন, ‘তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা’।
তরুণ কবিদের অনেকেই ব্যঙ্গাত্মক ইলিউশন হিসেবে ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথের উক্তি। পরিণত বয়সে তারাই আবার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্যে ভেসেছেন।
তিরিশ-চল্লিশের দশকে প্রলেতারিয়েত সাহিত্য, বিপ্লবী সাহিত্যতত্ত্বের জায়গা থেকে তর্ক তুলেছিলেন বাঙালি মার্কসবাদীরা। ইদানীং তোলা হয় উচ্চ সংস্কৃতির প্রসঙ্গ; অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ / রবীন্দ্রসাহিত্য একটি ‘হাই কালচারে’ পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে দোষ দিয়ে লাভ নেই; উনিশ শতকে ‘সাহিত্য’ নামক ধারণাটিই গড়ে উঠেছে ‘হাই কালচার’র মাধ্যম।
আরও পড়ুন : মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, মশাররফ কেউই উচ্চ সংস্কৃতির বাইরের লোক নন। সাহিত্য ও শিল্পকলার সাম্প্রতিক চেহারাও আদতে হাই কালচারের অংশ। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশই বোঝে না লিটিল ম্যাগাজিন কী, আর্ট ফিল্ম কী, মায়াকোভস্কি কী, কাজী নজরুল ইসলাম কী, আর্ট গ্যালারি কী!
ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন, ফিল্মের চেয়ে গণমুখী অন্য কোনো শিল্পমাধ্যম এলে ‘সিনেমাকে লাথি মেরে’ তিনি সেই শিল্পমাধ্যমের দিকে পথ হাঁটবেন; মজার ব্যাপার এই যে, ঋত্বিক ঘটকের সিনেমাও প্রকৃতপক্ষে নির্দিষ্ট শ্রেণি কাঠামোরই অংশ। অতএব রবীন্দ্রনাথ...!
এইসব তর্ক বিতর্কের বাইরে থাকা অন্য অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথ হলেন আলো, রবীন্দ্রনাথ এক ধরনের দিশা—নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। দুঃসময়ে কারো কাছে অমোঘ হয়ে ওঠে তার ‘তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর / এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’ কেউ কেউ হয়তো রবি ঠাকুরের দু-একটি কবিতা পড়েই মনের গহনে তার জন্য তৈরি করে নিয়েছেন চিরস্থায়ী আসন।
আরও পড়ুন : রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য
কারো কারো কাছে হয়তো কবিতা বা উপন্যাস নয়, গানের রবীন্দ্রনাথই শাশ্বত। এমন অনেকে আছেন গল্পগুচ্ছের পাতায় পাতায় খুঁজে পান সচল সবুজ বিচিত্র জীবনের গন্ধ। আবার এমন অনেককেই পাব, ভক্তি গদগদ চিত্তে যারা তাকে স্থান দিয়েছেন ‘গুরুদেব’র আসনে; তাকে স্মরণ করেন নানা রকম সাংস্কৃতিক কৃত্যে।
গোল বাধে তখনই, যখন রবীন্দ্রনাথ আর তার সাহিত্যকে করা হয় বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধি; গোষ্ঠীগত পরিচিতি তৈরি করতে গিয়ে যখন প্রত্যাখ্যান ও আক্রমণের অমীমাংসিত ধাঁধায় বিভিন্ন গোষ্ঠী পরস্পরকে ঘিরে ধরে, অপব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবাদিতা যখন রবীন্দ্রনাথকে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে তোলে। এইসব বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয় মিথ্যা ও অর্ধসত্যের জাল। সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে যখন সেসব মিথ্যা ও অর্ধসত্যের তথ্য ও যুক্তিগুলোকে বিনা প্রশ্নে বাকিরা গ্রহণ করে।
রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে বাঙালির মধ্যে মোটা দাগে দুটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে : রবীন্দ্ররক্ষক ও রবীন্দ্রভক্ষক। রবীন্দ্ররক্ষকরা পাহারাদারের ভূমিকা পালন করেন; প্রবহমানতায় বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথকে তারা বানাতে চান অচলায়তন।
আরও পড়ুন : অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের
রবীন্দ্রভক্ষকরা রবীন্দ্রনাথকে কামড়ে ধরেন; আধ-খাওয়া ফলের মতো ছুঁড়ে ফেলেন। এই দুইয়ের মাঝখান দিয়ে ‘রেললাইন বহে সমান্তরাল’। এই দুয়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানটিতে হয়তো আড়াল হয়ে আছেন অন্য এক রবীন্দ্রনাথ।
তাহলে রবীন্দ্রনাথ কি প্রশ্নাতীতভাবে মান্য? ঐশী শ্লোকের মতো তর্কাতীতভাবে পূজিত হবে তার সৃষ্টি? আমি শুধু বলতে চাই, সর্বজনীন কোনো রবীন্দ্রনাথ নেই, নেই কোনো সর্ববাদীসম্মত রবীন্দ্র-সাহিত্য। জাতীয় চেতনার একরঙা মিছিলে তাকে হয়তো সামনে রাখা যায়, কিন্তু অনেকেরই আছে ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ; সেটি হয়তো জাতীয় চেতনারও ঊর্ধ্বে।
আরও পড়ুন : নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা
চূড়ান্ত ব্যক্তিক স্তরে মুগ্ধ পাঠক হয়তো রবীন্দ্র-সাহিত্যের ঐতিহাসিক মূল্যায়ন করতে বসেন না; কিংবা দেখতে চান না বাঙালির নন্দনতাত্ত্বিক ইতিহাসে কতখানি নিবিড়ভাবে মিশে আছে রবীন্দ্র-সাহিত্য। বরং নিজস্ব বেদনা ও আনন্দবোধের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে মেলাতে চায় ব্যক্তিক রবীন্দ্রপাঠ; সেই পাঠে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন আনন্দ-ব্যথায় মেশানো এক মগ্ন মানুষের প্রতিনিধি, যিনি আলো চান, যিনি ভাসতে চান আনন্দধারায়।
মনে পড়ে, একবার এক ষাট ছুঁইছুঁই এক নারী এসেছিলেন আমার কাছে—রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা করতে। তার জিজ্ঞাসা ছিল, রবীন্দ্র-সাহিত্য কী করে মানুষের জন্য হয়ে ওঠে সঞ্জীবনী উপাদান? ব্যক্তিক বেদনায়, সংগ্রামে, সংরাগে কিংবা উত্তরণের অনুপম বাসনায় রবীন্দ্র-সাহিত্য কেন, কী করে মানুষকে সঙ্গ দেয়?
পুত্রপ্রতিম আমি তার চোখের গহিনে দেখতে পেয়েছিলাম আবেগের টলোমলো নদী। বলেছিলাম, স্থির হয়ে ভাবুন, যুক্তির পাল্লায় পাথর চাপিয়ে গবেষণা করবেন, নাকি থাকবেন রবীন্দ্রমগ্ন? অনেক অনেক বছর চলে গেছে; তিনি আর আসেননি। হয়তো আবেগের পাল্লাই জয়ী হয়েছে। সমস্ত বিতর্ক ছাপিয়ে আমার কাছে, এও তো এক রবীন্দ্রপাঠ!
সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়