সরকারি চাকরি কেন সবার প্রথম লক্ষ্য?
শুধু বিসিএস ক্যাডার হওয়া বা সরকারি চাকরিজীবী হওয়া তরুণদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হতে পারে না। তরুণ-তরুণীদের কেবল বিসিএস ক্যাডার হওয়া বা সরকারি চাকরিজীবী চিন্তাভাবনা বাংলাদেশের জন্য আসলেই অশনি সংকেত।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.৭৪ শতাংশ মানুষ সরকারি চাকরি করেন বা সরকারি চাকরি করার সুযোগ পান। অর্থাৎ, মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ মানুষও কিন্তু সরকারি চাকরি করতে পারেন না এবং মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশও সরকারি চাকরির সুযোগ পাবেন না। কথাটি অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য।
১৯ জানুয়ারি ২০২০। জাতীয় সংসদ। প্রশ্নোত্তর পর্ব। রাজনীতিবিদ ও শিল্পউদ্যোক্তা ব্যবসায়ী মোরশেদ আলমের প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন উত্তর দেন। তিনি বলেন, দেশে মোট ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬২ জন সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন। এছাড়াও দেশে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৮৪৮ পদ শূন্য রয়েছে বলেও জানান মো. ফরহাদ হোসেন।
আরও পড়ুন : মহামারিতে তারুণ্যের সংকট ও সমাধান
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি চাকরির জন্য মোট পদ আছে (কর্মরত ১২,১৭,০৬২ + শূন্যপদ ৩,১৩,৮৪৮) = ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৯১০টি। অর্থাৎ, সবমিলিয়ে দেশে সরকারি চাকরির পদ আছে ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৯১০টি। (বর্তমানে নতুন করে কিছু পদ বাড়তে পারে)
যারা সরকারি চাকরির চিন্তা করছেন, সেই চিন্তার পাশাপাশি বেসরকারি চাকরি, গবেষক, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী বা ফ্রিল্যান্সার হওয়ার চিন্তাও মাথায় রাখতে হবে।
ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহ গণনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। অর্থাৎ, মোট জনসংখ্যার ০.৯২৬৯ শতাংশ মানুষ সরকারি চাকরির সুযোগ পায় বা পাবে।
এতে বোঝা গেল যে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ মানুষও সরকারি চাকরি করার সুযোগ পাবেন না। ৯৯ শতাংশ মানুষকেই অন্য পেশা বেছে নিতে হবে বা অন্য পেশায় জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে হবে।
আরও পড়ুন : তারুণ্যের বাজেট, সংকট ও সমাধান
এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে কেবল সরকারি চাকরির পেছনে না ছুটে সবার উচিত বিকল্প চিন্তা করা। আর ‘চাকরি না পেলে মরে যেতে হবে’—এমন চিন্তা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।
যারা সরকারি চাকরির চিন্তা করছেন, সেই চিন্তার পাশাপাশি বেসরকারি চাকরি, গবেষক, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী বা ফ্রিল্যান্সার হওয়ার চিন্তাও মাথায় রাখতে হবে।
বিসিএস এত জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। প্রথমত, ২০১৫ সালে সরকার অষ্টম পে-স্কেল দিয়েছে। এই পে-স্কেলে সরকারি অফিসারদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : এই লজ্জা রাখব কোথায়?
এরপর শুরু হলো সরকারি চাকরির পেছনে ছোটা। বেসরকারি খাত থেকেও সবাই সরকারি চাকরির দিকে ছুটছে। এক্ষেত্রে বিসিএসকে সরকারি চাকরির মধ্যে উপরের স্তর হিসেবে ধরা হয়।
যারা সরকারি চাকরি করতে চান, তারা হয়তো বিসিএস ক্যাডার হতে চান অথবা তা না পেলে নন ক্যাডারের মাধ্যমে ভালো কোনো চাকরি পেতে চান। বেতন দ্বিগুণ করার কারণে বিসিএসের দিকে সবার আগ্রহ বেশি এবং সবাই ঝুঁকছেও বেশি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি সমাজে আলাদা একটা মূল্যায়ন আছে, এর সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশি।
আরেকটা কারণ হলো, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি সমাজে আলাদা একটা মূল্যায়ন আছে, এর সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশি। আরেকটা বড় কারণ হলো, সরকারি চাকরি নিরাপদ। সহজে কাউকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় না।
আরও পড়ুন : বেকারত্ব : স্বপ্নভঙ্গের আরেক নাম
সবাই দেখল, সামাজিক মর্যাদার পাশাপাশি এখানে আর্থিক নিরাপত্তা আছে। এছাড়া আগে পে-স্কেল কম থাকলেও এখন দ্বিগুণ স্কেলের পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে।
আরেকটা ব্যাপার হলো—সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া, এমনকি কোনো বেসরকারি খাতে রেফারেন্সে চাকরি হওয়া এই ধরনের অনেক অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে দেখা যায়। এই বিষয়গুলো দেখার পর উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা নিরুৎসাহিত হন।
দেখা যাচ্ছে, কোথাও প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, আবার কোথাও স্বজনপ্রীতি করে লোক নিয়োগ হচ্ছে। এক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) এই জায়গায় সবার আস্থা আছে। কারণ এখানে প্রশ্নফাঁস কিংবা স্বজনপ্রীতির তেমন কোনো অভিযোগ নেই।
আরও পড়ুন : শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
এসব দেখে তরুণেরা ভাবে, আমি যদি ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে থাকি, তাহলে আমার মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমে ভালো একটি চাকরি পাওয়ার সুযোগ থাকবে।
আরও একটা ফ্যাক্টর হলো—২০১০ সালে বিসিএস নন ক্যাডার বিধিমালা সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—পিএসসির কাছে যদি মন্ত্রণালয়গুলো লোকবল নিয়োগ চায় তাহলে পিএসসি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিসিএস নন ক্যাডার থেকে নিয়োগ দিতে পারবে।
এরপর ২০১২ সালে নন ক্যাডার নীতিমালা আবারও সংশোধন করা হলো। মন্ত্রণালয়ের চাহিদাপত্র সাপেক্ষে পিএসসি নন ক্যাডার থেকে ১০০ শতাংশ নিয়োগ দিতে পারবে বলে এতে বলা হয়; আমার যতটুকু মনে পড়ে। তার মানে যারা এখন বিসিএস দিচ্ছে তাদের মাথার ভেতর এইসব বিষয় কাজ করে।
প্রথমত, বেতন ভালো হয়েছে। এর পরের ব্যাপার হলো, প্রার্থীদের বিসিএস ক্যাডার হতে পারলে ভালো। আর যদি ক্যাডার হতে নাও পারে, তাহলে তিনি নন ক্যাডার থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ভালো চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে কোনো ঘুষ কিংবা স্বজনপ্রীতিও থাকছে না। ফলে সরকারি চাকরি প্রতি সবাই আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
গাজী মিজানুর রহমান ।। ৩৫তম বিসিএস ক্যাডার; লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার