মহাশ্বেতা দেবী : হাজার চুরাশির মা
কলম তরবারির চেয়েও শক্তিশালী! যখন আমরা ‘মহাশ্বেতা দেবী’ সম্পর্কে পড়ি বা তার লেখাগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি তখন এটি বেশ সঠিক বলে মনে হয়। তিনি তার কলমের মাধ্যমে জাতিভেদ, শোষণ ও উপজাতিদের সমস্যাকে মানুষের সামনে তুলে ধরেন।
বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালে নিজের লেখা লেখেননি, মাটিতে মানুষের কাছে গিয়ে তাদের দুঃখ খোদাই করেছেন। তিনি বলতেন, ‘আসল ইতিহাস সাধারণ মানুষের লেখা’। তিনি সমাজের নিম্নস্তরের কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সম্পর্কে জানা তার জন্য আকর্ষণীয় ছিল।
মহাশ্বেতা দেবী পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, বঙ্গ বিভূষণ, সাহিত্য আকাদেমি সম্মান ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কারের মতো অনেক পুরস্কারে ভূষিত একজন বিখ্যাত সামাজিক কর্মী ও লেখক ছিলেন। তার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন সুপরিচিত লেখক ও সমাজকর্মী।
আরও পড়ুন : আনিসুজ্জামান : পুরোনো বাংলা গদ্য বিষয়ে নতুন গবেষণা
২০১৬ সালের আজকের দিনে তিনি কলকাতার একটি হাসপাতালে মারা যান। মহাশ্বেতা দেবীর সুদীর্ঘ সাহিত্য-জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে সাধারণ মানুষের সান্নিধ্যে বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষিজীবী, শ্রমিক ও অরণ্যবাসী দলিত শ্রেণির নারী-পুরুষদের সাথে।
ঢাকার মেয়ে মহাশ্বেতা দেবী প্রতিবাদী জীবন ও সাহিত্যের এক স্বতন্ত্র ঘরানার লেখক। তার লেখায় বহুমাত্রিক অনুষঙ্গে দেশজ আখ্যান উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি একজন অনুসন্ধানী লেখক।
তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ইতিহাসের উপেক্ষিত নায়কদেরকে তুলে এনেছেন তার গল্প ও উপন্যাসে। এ প্রসঙ্গের জ্বলন্ত উদাহরণ তার লেখা ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর’, ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাস।
‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, —‘লেখক হিসাবে, সমকালীন সামাজিক মানুষ হিসাবে একজন বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের সমস্ত দায় দায়িত্ব বহনে আমরা সর্বদাই অঙ্গীকারবদ্ধ। দায়িত্ব অস্বীকারের অপরাধ সমাজ কখনোই ক্ষমা করে না। আমার বীরসা কেন্দ্রিক উপন্যাস সে অঙ্গীকারেরই ফলশ্রুতি।’
তিনি তার কলমের মাধ্যমে জাতিভেদ, শোষণ ও উপজাতিদের সমস্যাকে মানুষের সামনে তুলে ধরেন। বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালে নিজের লেখা লেখেননি, মাটিতে মানুষের কাছে গিয়ে তাদের দুঃখ খোদাই করেছেন...
মহাশ্বেতা দেবী অল্প বয়সেই গল্প-কবিতা লেখা শুরু করেন। তার প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আরণ্যের অধিকার’, ‘নটি’, ‘মাতৃচবি’, ‘অগ্নিগর্ভ’, ‘জঙ্গল কে দাবেদার’, ‘দ্যা মাদার অফ ১০৮৪’ (হাজার চুরাশির মা), ‘মহেশ্বর’ এবং ‘গ্রাম বাংলা’।
আরও পড়ুন : অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের
নকশাল আন্দোলনের ওপর রচিত তার উপন্যাস হাজার চুরাশির মা একটি খুব জনপ্রিয় উপন্যাস। মহাশ্বেতা দেবীর অনেক কাজের ওপর চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। তার ‘রুদালি’ উপন্যাস ‘রুদালি’ নিয়ে কল্পনা লাজমি তৈরি করেছিলেন এবং ‘হাজার চৌরাসি কি মা’ একই নামে ১৯৯৮ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা গোবিন্দ নিহালানি তৈরি করেছিলেন।
১৯৯৫ সাল নাগাদ উষা গাঙ্গুলি নির্দেশিত তারই নাটকের দল রঙ্গকর্মীর রুদালি কলকাতার হিন্দি থিয়েটারে একটি উল্লেখযোগ্য নাটক যেখানে আমি নিজে অভিনয় করেছি এবং প্রোডাকশনে কাজ করেছি।
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত তার উপন্যাস ‘আরণ্যের অধিকার’ উপজাতি নেতা বিরসা মুণ্ডার একটি গল্প। নকশালবাড়ি উপজাতি বিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা ‘অগ্নিগর্ভ’ উপন্যাসে চারটি দীর্ঘ গল্প রয়েছে।
মহাশ্বেতা দেবী সারাজীবন গরীব অসহায় মানুষের অধিকারের জন্য লিখে গেছেন এবং লড়াই করেছেন। ২০১৬ সালে পরপারে চলে গেলেও তিনি আমাদের তথাকথিত ভদ্রসমাজের গণ্ডি পেরিয়ে বর্ণ-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নিপীড়িত দুঃখী সংগ্রামী মানুষকে আপনজন ভেবে তাদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করে তাদের কথাই প্রকাশ করে গেছেন সারা জীবন...
তার প্রথম পর্বের লেখালেখি প্রসঙ্গে বলতে হয় তিনি গল্প-উপন্যাসে ইতিহাসের আলোকে রাজনীতি, অর্থনীতির সাথে সাথে লোকায়ত সংস্কৃতি ও লোকায়ত জীবন ব্যবস্থাকে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ‘নটি’ (১৯৫৬) উপন্যাসটি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচনা করেন খুদাবক্স ও মোতির প্রেমের কাহিনি অবলম্বন করে।
আরও পড়ুন : সন্জীদা খাতুন : স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে মহাশ্বেতা দেবী যেসব উপন্যাস রচনা করেন সেগুলোকে তার দ্বিতীয় পর্বের সাহিত্যকর্ম বলা যেতে পারে। এ পর্বে তিনি রাজনৈতিক চেতনায় ঋদ্ধ ইতিহাস নির্ভর কহিনীর আলোকে ব্যতিক্রমধর্মী বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে ‘আঁধার মানিক’ (১৯৬৬), ‘কবি বন্দ্যঘটি গাঞির জীবন ও মৃত্যু’ (১৯৬৭) ইত্যাদি।
তিনি তার তৃতীয় পর্বের সাহিত্য কর্মে অন্ত্যজ শ্রেণির দলিত মানুষের ইতিহাস, যাপিত জীবন ও দলিত হওয়ার কাহিনি তুলে ধরেছেন। আর এই কাহিনি তুলে ধরার জন্যে তিনি অন্ত্যজ শ্রেণির লোকেরা কেন দলিত তার ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হন। সে অনুসন্ধান লব্ধ জ্ঞানের আলোকে তিনি তার তৃতীয় পর্বের গল্প উপন্যাসে অন্ত্যজ শ্রেণির আদিবাসীদের জীবনের নানা দিক উপস্থাপন করেছেন।
মহাশ্বেতা দেবী সারাজীবন গরীব অসহায় মানুষের অধিকারের জন্য লিখে গেছেন এবং লড়াই করেছেন। ২০১৬ সালে পরপারে চলে গেলেও তিনি আমাদের তথাকথিত ভদ্রসমাজের গণ্ডি পেরিয়ে বর্ণ-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নিপীড়িত দুঃখী সংগ্রামী মানুষকে আপনজন ভেবে তাদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করে তাদের কথাই প্রকাশ করে গেছেন সারা জীবন। তাইতো ইতিহাসে তার নাম চিরদিনের জন্য লিপিবদ্ধ হয়ে আছে থাকবে। আর আমরা তাকে স্মরণ করব প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক, গবেষক ও রাজনৈতিক গবেষক