সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসবে কীভাবে?
ভাবতে ভালোই লাগে যে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। দেশে তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পরিবর্তনের সুবাতাস বইছে। মানুষের জীবনের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের ফলে আমাদের জীবনে শ্রম লাঘব হয়েছে, দূরত্ব ঘুচেছে, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। নিঃসন্দেহে তথ্য প্রযুক্তি আমাদের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তবে প্রদীপের নিচে যেমন অন্ধকার রয়েছে তেমনি এই তথ্য প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হচ্ছে এক নতুন ধরনের অপরাধ যার নাম সাইবার অপরাধ। তথ্য প্রযুক্তির এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে উপজীব্য করে অসাধু মহল সমাজে সাইবার অপরাধ নামের প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধের বিস্তার ঘটিয়ে যাচ্ছে।
এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, গুজব, মিথ্যা খবর, কিশোর অপরাধ, আত্মহত্যা, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, ব্যাংক ডাকাতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা সবই হচ্ছে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিরেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১১.৮৭৫ মিলিয়ন। যার মধ্যে মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ১০২.৩৫৩ মিলিয়ন ব্যবহারকারী, আই এস পি এবং ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ৯.৫২২ মিলিয়ন ব্যবহারকারী। উপরোক্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং এই ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে সেই অনুপাতে সচেতন গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে না। যার কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অনেক ব্যবহারকারী জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধের জালে।
সাইবার অপরাধ একটি বাউন্ডারিলেস ক্রাইম। কারণ এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে এক দেশে বসে অপরাধ সংগঠিত করে আরেক দেশের নাগরিকদের ভিকটিম বানানো সম্ভব। তাই প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে সাইবার ক্রাইম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এক দিকে অনলাইনে কেনাকাটা যেমন জনপ্রিয় হচ্ছে ঠিক তেমনি এই অনলাইনে কেনাকাটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রতারক চক্র। আমরা যদি একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই তাহলে বুঝবো কিভাবে বেড়ে চলছে এই সাইবার অপরাধ।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সাইবার অপরাধ বেড়েছে। ২০১৯ সালে সাইবার অপরাধের মামলা হয়েছে ২৮৪টি এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭১ জন। ২০২০ সালে মোট মামলা হয়েছে ৩১৭টি এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৮৪ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় ২০০টি, গ্রেপ্তার ১২১ জন; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা ৮৩টি, গ্রেপ্তার ৪৯ জন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা একটি আর গ্রেপ্তার হন একজন।
দেশে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, গুজব, মিথ্যা খবর, কিশোর অপরাধ, আত্মহত্যা, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, ব্যাংক ডাকাতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা সবই হচ্ছে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
অন্যদিকে ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৮৩টি মামলা, গ্রেপ্তার ১৯৯ জন; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা ৭৯টি, গ্রেপ্তার ৪৯ জন। যদিও ডিএমপির এই পরিসংখ্যানে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের তথ্য যোগ করা হয়নি।
আমাদের দেশে এই সাইবার অপরাধের বেশিরভাগ ভিকটিম হয় নারীরা। বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ২০১৯ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগী নারীদের হার আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়েছে। ২০১৯ সালে ভুক্তভোগী নারীদের হার ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ। যেটা ২০১৮ সালে ছিল ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়াও গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে এখন পর্যন্ত বিশেষ ইউনিটের হট-লাইনে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি সাইবার অপরাধের শিকার নারী কল করেছেন। এর মধ্যে ফেইক ফেসবুক আইডি সংক্রান্ত অভিযোগ ২৩ শতাংশ, আইডি হ্যাক সংক্রান্ত ১৩ শতাংশ, ব্ল্যাক মেইলিং সংক্রান্ত ৮ শতাংশ, মোবাইল হ্যারাজমেন্ট সংক্রান্ত ৯ শতাংশ, অশ্লীল কন্টেন্ট পাঠানো সংক্রান্ত ৭ শতাংশ, অন্যান্য ৯ শতাংশ এবং অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগ আসে ২৭ শতাংশ। একটি বিষয় পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের সাইবার অপরাধীদের মূল টার্গেট নারী সমাজ এবং বেশিরভাগ ভুক্তভোগীর বয়স থাকে ১৮-৩০ বছরের মধ্যে।
এখন যে প্রশ্নটিতে আলোকপাত করা প্রয়োজন তা হল আসলে এই ভুক্তভোগীর মধ্যে কত জন আইনের আশ্রয় নেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, সাইবার অপরাধে আক্রান্ত ৭ শতাংশ ভিকটিম অভিযোগ দায়েরের জন্য আইনের দ্বারস্থ হন; ৫৪ শতাংশ ভিকটিম পুলিশের প্রতি নারাজ; ৪৪ শতাংশ মনে করেন, দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তিকে সঠিক আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা হতো; ২৩ শতাংশ ভিকটিম পুনরায় যৌন হয়রানির ভয়ে আইনের দ্বারস্থ হতে ভয় পান; ২৩ শতাংশ ভিকটিম পত্রিকায় ছাপা হওয়ার ভয়ে আইনি সহায়তা নিতে ভয় পান; ১৭ শতাংশ ভিকটিম তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে সাইবার হয়রানি সম্পর্কিত ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করতে চান না; ৩০ শতাংশ ভিকটিম জানেনই না অনলাইনে যৌন নির্যাতনের শিকার হলে কিভাবে আইনি সহায়তা পেতে পারেন; ২৫ শতাংশ ভিকটিম কোনো ইতিবাচক ফল আসবে না বিধায় কোনো অভিযোগ করতেই চান না।
এ কথা পরিষ্কার যে, ভুক্তভোগীদের বিরাট অংশ বিভিন্ন কারণে আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না এবং এই আইনের আশ্রয় না নেয়ার কারণে অপরাধী বারবার একই অপরাধ করার সাহস পেয়ে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে সমাজে বেড়ে যাচ্ছে সাইবার অপরাধ। এখন সময় এসেছে এই সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দেওয়ার।
সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যে বিষয়টিতে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা উচিৎ তা হচ্ছে, সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। জনসচেতনতা তৈরির কাজে রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি সবার দায় আছে। ব্যক্তিকে যেমন তার পারিবারিক পর্যায় থেকে জনসচেতনতা তৈরির কাজ করতে হবে, পরিবারের কেউ ভুক্তভোগী হলে তার পাশে থেকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে তার ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কাজ করে যেতে হবে ঠিক তেমনি রাষ্ট্রকে ব্যাপক আকারে এই সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে মনোনিবেশ করতে হবে।
পাঠ্যপুস্তকে সাইবার সচেতনতামূলক বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সাইবার অপরাধের ভিকটিম কিভাবে আইনি সহায়তা পেতে পারে সেই আইনি বিষয়গুলোকে সহজ এবং বোধগম্য ভাষায় ব্যাপক আকারে প্রচার করতে হবে। এই জন্য আমাদের গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যমে সাইবার সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বেশি বেশি প্রচার করতে হবে।
বাংলাদেশের সাইবার অপরাধীদের মূল টার্গেট নারী সমাজ এবং বেশিরভাগ ভুক্তভোগীর বয়স থাকে ১৮-৩০ বছরের মধ্যে। ...৩০ শতাংশ ভিকটিম জানেনই না অনলাইনে যৌন নির্যাতনের শিকার হলে কিভাবে আইনি সহায়তা পেতে পারেন; ২৫ শতাংশ ভিকটিম কোনো ইতিবাচক ফল আসবে না বিধায় কোনো অভিযোগ করতেই চান না।
এইবার আসা যাক দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সেটি হচ্ছে এই অপরাধ যারা মোকাবিলা করবে তাদের সক্ষমতা নিয়ে। অবশ্যই সাইবার অপরাধ মোকাবিলার জন্য সাইবার থানা স্থাপন করতে হবে এবং এই সাইবার থানার কার্যক্রম সারা দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করতে হবে। এই থানায় যারা কাজ করবেন তাদের সাইবার অপরাধ বিষয়ে দক্ষ হতে হবে এবং তাদেরকে শুধু সাইবার অপরাধ বিষয়ক কাজেই মনোনিবেশ করতে হবে। সাইবার অপরাধ মোকাবেলার জন্য চাই ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব।
সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেনাল কোড, ১৮৬০ প্রভৃতি আইন রয়েছে বটে কিন্তু যেহেতু অপরাধটা প্রযুক্তি নির্ভর এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতা সাধনের সাথে সাথে অপরাধের ধরনেও আসছে পরিবর্তন, তাই এই ধরনের অপরাধ মোকাবিলার আইনেও আসতে হবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় প্রণীত আইনের দিকে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখবো আমাদের আইনটির আরও কত যুগোপযোগী এবং পরিবর্তন করা দরকার। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সাইবার অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা এই মুহূর্তে মাত্র একটি। যার কারণে সারা দেশের মামলা একটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ফলশ্রুতিতে বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়। দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষের জন্য মামলা চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। সেজন্য অবশ্যই বিভাগীয় পর্যায়ে দ্রুত সাইবার ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে সেখানে যোগ্য প্রসিকিউটর নিয়োগ দিতে হবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায় আসলে সবার। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সকলের সম্মিলিত দৃঢ় প্রতিরোধই পারে এই অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করতে।
মনিরা নাজমী জাহান ।। শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়