করোনার চতুর্থ ঢেউ কতটা ভয়ংকর
করোনা আবার বাড়তে শুরু করেছে। চিকিৎসকদের মতে, করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হয়ে গিয়েছে। দৈনিক সংক্রমণ ১৪-১৫তে পৌঁছেছে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে সংক্রমণ সংখ্যা বেড়ে ৩৩ পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। আবার করোনা রোগীর মৃত্যু খবর আসতে শুরু করেছে।
এ পর্যন্ত দেশে করোনায় সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় ২০২১ সালের জুলাই মাসে। সেই সময় এক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার অতিক্রম করেছিল। জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, এই চতুর্থ ঢেউয়ে সংক্রমণ ২০২১ সালের জুলাই মাসের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। কোরবানির ঈদ পরবর্তী সময়ে সারা দেশে বিশেষত ঢাকার বাইরে সামাজিক সংক্রমণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
দ্রুত গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের নতুন দুই সাব ভ্যারিয়েন্ট (বিএ.৪ এবং বিএ.৫) দায়ী বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)।
আরও পড়ুন : সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন কেন জরুরি
যদিও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় এসব ওমিক্রন সাব ভ্যারিয়েন্ট অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তে জানা যাচ্ছে, ওমিক্রন একটু হালকা ধরনের, আক্রান্তদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া, মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তির হার কম বলে জানিয়েছে গবেষণা কেন্দ্র।
২০২২ সালের ১৯ মে ঢাকায় প্রথম সন্দেহভাজন ওমিক্রন সাব ভ্যারিয়েন্ট বিএ.৫ রোগী শনাক্ত করা হয়। এরপর গত ছয় সপ্তাহে (১৪ মে থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওমিক্রনের বিএ.৫ উপধরন।
বাংলাদেশে এখন বিএ.৫ সবচেয়ে প্রভাবশালী সাবভ্যারিয়েন্ট হয়ে উঠেছে। ৪০ জন বিএ.৫ সংক্রমিত রোগীর ক্লিনিক্যাল ডাটা এবং টিকাদানের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সংক্রমিতদের মধ্যে ১৬ জন পুরুষ ও ২৪ জন নারী রয়েছেন। তাদের ৩৯ জনের মধ্যে করোনার মৃদু উপসর্গ দেখা গেছে এবং একজনের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি। তাদের মধ্যে মাত্র একজনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।
সর্দি, জ্বর, গলা ব্যথা, নাক দিয়ে জল পড়া, পেশিতে ব্যথা, হজমে সমস্যার মতো কিছু সমস্যা করোনার নতুন রূপ ওমিক্রনের উপসর্গ।
এদের মধ্যে ১১ জন দ্বিতীয়বারের মতো এবং সাতজন তৃতীয়বারের মতো করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনার টিকা নেওয়ায় রোগ প্রতিরোধের যে ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষমতাকে ওমিক্রনের বিএ.৫ উপধরন ফাঁকি দিতে পারে—এমন কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে করোনার টিকা সংক্রমণ ঠেকাতে না পারলেও রোগের তীব্রতা কমাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মাইক্রোবায়োলজিস্টরা। টিকা পাওয়া ব্যক্তি রোগে ভুগছেন কম, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন কম হচ্ছে।
করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ ও প্রতিরোধে আমাদের করণীয় সম্পর্কে বলা যায়—
১) মাস্ক না পরা : বছরের শুরুর দিকে কোভিডের দাপট কমায় অনেকেই ভেবেছিলেন, করোনা বুঝি বিদায় নিল। সেই ভাবনাকে মাথায় রেখেই মাস্ক পরার অভ্যাস ত্যাগ করার প্রবণতা তৈরি হয় অনেকের মধ্যেই।
আরও পড়ুন : স্বাস্থ্যের অব্যবস্থাপনা, দায়দায়িত্ব কার?
রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে বড় অংশের মানুষকে মাস্কবিহীন অবস্থায় দেখা যাচ্ছে এখনো। অসচেতনতাই নতুন করে করোনা সংক্রমণের একটা বড় কারণ। সংক্রমণ বাড়তে থাকলেও শহরবাসীর একাংশের মধ্যে এখনো মাস্ক পরার অনীহায় বিস্মিত চিকিৎসকেরা।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই শহরবাসীর একাংশ যেভাবে মাস্ক ছাড়াই রাস্তায় ঘোরাফেরা করছেন—তা একেবারে অনুচিত। জনস্বাস্থ্যবিদেরা মাস্ক পরার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করছেন। তারা বলছেন, করোনার টিকা নেওয়া থাকলেও মাস্ক না পরে ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না।
করোনা যেহেতু নাক মুখ দিয়েই প্রবেশ করে। তাই ওমিক্রনসহ করোনার যেকোনো ভ্যারিয়েন্ট/সাবভ্যারিয়েন্ট থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো মাস্ক পরা। এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের ভীষণভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতার কথা বলেছে সরকারও।
বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরিধান করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর ব্যত্যয় হলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলেও নির্দেশনায় জানানো হয়েছে। তবে এটি কার্যকর করার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
চিকিৎসকেরা বারবার বলেছেন, করোনা এখনো নির্মূল হয়নি। ফলে সামান্য সর্দি, জ্বর, কাশি, গলা ব্যথার মতো উপসর্গ এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
সরকারের কঠোর নির্দেশনার পরও মাঠ পর্যায়ে মাস্ক পরায় আগ্রহ কম সাধারণ মানুষের। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নির্দেশনা দিয়ে মাস্ক পরা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রশাসনকে মাঠ পর্যায়ে কঠোর হতে হবে। কোভিভ থেকে নিজে নিরাপদ থাকতে ও অন্যকে নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনে সঠিকভাবে মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক পরলে জীবন বাঁচে, রক্ষা পায় জীবিকাও।
২) দূরত্ব বিধি বজায় না রাখা : করোনা সংক্রমণ কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় শিকেয় উঠেছিল করোনা বিধি। ফলে উৎসব, অনুষ্ঠানে একসঙ্গে অনেক মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন। গণপরিবহনেও মানা হয়নি কোনো শারীরিক দূরত্ব। যার ফলে ফের দেশজুড়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে করোনা সংক্রমণ।
আরও পড়ুন : স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?
৩) স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা : করোনা সংক্রমণ নিম্নগামী হতেই বারে বারে স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশের ব্যবহারও কমেছে। বাইরে থেকে ফিরে হাত-পা ধোয়া, সাবান জলে পোশাক কেঁচে নেওয়ার মতো সুরক্ষা বিধিও মানা ছেড়ে দিয়েছেন সকলে। করোনা সংক্রমণ বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে এই কারণটিও।
দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউ বিরাজমান বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সরকার করোনা সংক্রমণ রোধে বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অনীহা দেখা গেছে। কোরবানির পশুর হাটে, ঈদুল আযহা উপলক্ষে বাড়িতে ফিরতে ও ঈদের জামাতে অংশ নেওয়া লোকজনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। চতুর্থ ঢেউ মোকাবিলায় সরকারকে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদগণ।
৪) ঠাণ্ডা লাগা ভেবে করোনা উপসর্গ এড়িয়ে যাওয়া : করোনার উপসর্গগুলো অনেকটাই সাধারণ ঠাণ্ডা লাগার উপসর্গের মতোই। গলা ব্যথা, হালকা জ্বর, সর্দি, কাশি, ক্লান্তিভাব এগুলোই। আর এখানেই সৃষ্টি হচ্ছে গোলমাল। করোনার এই উপসর্গগুলোকে মানুষ সাধারণ অসুখ ভেবেই ভরসা করছেন প্যারাসিটামলের ওপর। আর তাতেই আরও বেড়ে চলছে সংক্রমণ।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এইসব উপসর্গ দেখা দিলে তখনই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরামর্শ নেওয়া উচিত। আর গলা ব্যথাই কিন্তু করোনার মূল উপসর্গ। তবে গলা ব্যথা ঠাণ্ডা লেগেও হতে পারে। ঠাণ্ডাজনিত গলা ব্যথা আর করোনার গলা ব্যথার মধ্যে পার্থক্য আছে।
১. সাধারণ গলা ব্যথা হলে সেটা কখনো কমে কখনো বাড়ে। আর করোনার গলা ব্যথা সবসময় একই রকম থাকে।
আরও পড়ুন : মাস্ক, মাস্ক এবং মাস্ক
২. করোনার গলা ব্যথায় মনে হয় যেন গলার কাছে কিছু আটকে আছে। খাবার গিলতে কষ্ট হয়। আর সাধারণ গলা ব্যথায় সেটা হয় না।
৩. করোনার গলা ব্যথা কখনোই কোনো গরম পানীয় বা গরম খাবার খেয়ে কমে না। তার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রন অনেক বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তে জানা যাচ্ছে, ওমিক্রন একটু হালকা ধরনের, আক্রান্তদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার কম।
সর্দি, জ্বর, গলা ব্যথা, নাক দিয়ে জল পড়া, পেশিতে ব্যথা, হজমে সমস্যার মতো কিছু সমস্যা করোনার নতুন রূপ ওমিক্রনের উপসর্গ। সর্দি, কাশি, জ্বর হলেও তা বৃষ্টিতে ভিজে বা এসির হাওয়া থেকে ঠাণ্ডা লেগে হয়েছে বলেই ধরে নিচ্ছেন অনেকে।
করোনার সঙ্গে লড়াই করার অন্যতম অস্ত্র টিকা। টিকা নিয়ে আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সকলের করোনা টিকা এবং বুস্টার নেওয়া উচিত।
চিকিৎসকেরা বারবার বলেছেন, করোনা এখনো নির্মূল হয়নি। ফলে সামান্য সর্দি, জ্বর, কাশি, গলা ব্যথার মতো উপসর্গ এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। করোনা সংক্রান্ত একটিও উপসর্গ লক্ষ করলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া জরুরি। পজিটিভ হলে আইসোলেশনে থাকুন। নয়তো ফের দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে করোনা।
৫) করোনা টিকা না নেওয়া : করোনা টিকা না নেওয়া মানুষের সংখ্যা কম হলেও একেবারে শূন্য নয়। স্বাস্থ্য বিভাগ এখন পর্যন্ত দেশের ১২ কোটি ৯৪ লাখ মানুষকে করোনার প্রথম ডোজ এবং ১১ কোটি ৯৬ লাখ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দিয়েছে। আর তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ দিয়েছে ২ কোটি ৯৬ লাখ মানুষকে। পাশাপাশি ৫ থেকে ১২ বছর বয়সীদের করোনার টিকা দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরও পড়ুন : স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধ হবে কবে?
সরকার ইতিমধ্যে সব দিক দিয়েই স্বাস্থ্য সক্ষমতা বাড়িয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও করোনা পরীক্ষার ফি ও চিকিৎসা খরচ কমানো জরুরি। করোনা চিকিৎসা ও জনসচেতনতা বিষয়ে সরকারের সফলতাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখতে হবে।
সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিদগণের বক্তব্য, ‘আমাদের টিকা নেওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যথেষ্ট থাকলেও, স্বাস্থ্যবিধির বিষয় উপেক্ষিত ছিল। এর কারণেই আমরা টিকা নিয়েও বেশি সময় ধরে সংক্রমণের ধীরগতি বজায় রাখতে পারিনি।’
অনেকেই এতদিন বুস্টার ডোজ না নিয়ে বসে ছিলেন। তার পেছনে ‘করোনা চলে গিয়েছে’ এমন একটা ধারণা কাজ করেছে। বিগত করোনা স্ফীতিতে হাসপাতালগামী রোগীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণই ছিল করোনা টিকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সঙ্গে লড়াই করার অন্যতম অস্ত্র টিকা। টিকা নিয়ে আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সকলের করোনা টিকা এবং বুস্টার নেওয়া উচিত।
করোনা স্ফীতির এই পর্যায়ে দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে সংক্রমণ। শহর এবং শহরতলিতেও লাফিয়ে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। তবে করোনা সংক্রমণের এই পর্বে আগের দুইবারের তুলনায় হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বেশ কম। শারীরিক উপসর্গগুলোও ভয়ঙ্কর কিছু নয়।
করোনা সংক্রমণ খুব দ্রুতই বাড়ছে। তবে করোনার চতুর্থ ঢেউ বেশিদিন থাকবে না। আগামী দুই/তিন সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণ কমতে পারে। যে সংক্রমণ যত দ্রুত বাড়ে তা তত দ্রুত কমে যায়। মাইক্রোবায়োলজিস্টদের মতে, সামনের কয়েকটা দিন যদি সবরকম সুরক্ষা বিধি মেনে চলা যায় তা হলে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠা যাবে।
তাই আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। করোনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সতর্কতাও বাড়ানো জরুরি। সকলেই এ সময় নিজেদের প্রতিরোধ শক্তির দিকে নজর দিন।
ড. মো আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়