চীনে গরম, যখন চরম
আমার বর্তমান অফিস ও বাসা—দুটোই সিচিংশান জেলায়। না, এই জেলা সেই জেলা নয়। চীনের ‘জেলা’র সাথে বাংলাদেশের ‘জেলা’র পার্থক্য অনেক। চীনে প্রতিটি শহর কয়েকটি জেলা বিভক্ত। রাজধানী বেইজিং এর ব্যতিক্রম নয়।
বেইজিংয়ে ছোট-বড় জেলার সংখ্যা ১৬টি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জেলা মিইয়ুন (২২২৯.৪৫ বর্গকিলোমিটার) এবং সবচেয়ে ছোট জেলা তুংছ্যং (৪১.৮৪ বর্গকিলোমিটার)। আয়তনের দিক দিয়ে আমাদের সিচিংশানের অবস্থান ১৪তম (৮৫.৭৯ বর্গকিলোমিটার)।
তো, ৭ জুলাই সিচিংশান জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই দিনে চীনের ছেংতু শহরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ, ৭ জুলাই—চীনের একাদশ সৌরপদের প্রথম দিন—এত গরম পড়ার কথা না! সৌরপদের নামটা শুনলেই বুঝবেন, কেন এমন দাবি করছি।
আরও পড়ুন : চীন যেভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হলো
৭ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত স্থায়ী একাদশ সৌরপদের চীনা নাম ‘সিয়াওশু’। চীনা ভাষায় ‘সিয়াও’ মানে ‘ছোট’ এবং ‘শু’ মানে ‘গরম’। নামে ‘ছোট গরম’ হলেও, একাদশ সৌরপদ চীনে নিয়ে আসে ‘বড় গরম’-এর আমেজ। তবে, এবার সত্যি সত্যি ‘বড় গরম’ বা ‘তাশু’ (‘তা’ মানে ‘বড়’, ‘শু’ মানে ‘গরম’) এসেছে। তাশু চীনের দ্বাদশ সৌরপদ।
চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদ (solar terms)-এ। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেসকোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। চীনে হাজার হাজার বছর আগে এই সৌরপদ-ব্যবস্থার উৎপত্তি। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ সম্পাদন করে আসছে।
বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। এখন চলছে চীনের দ্বাদশ সৌরপদ। এর ব্যাপ্তিকাল ২২ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত।
হিট বা তাপ হচ্ছে শক্তির একটি রূপ। তাপ নিয়ে গবেষণা আসলে বস্তুর অণু-পরমাণু নিয়ে গবেষণা। বস্তুর অণু-পরমাণু যত দ্রুত নড়াচড়া করে, বস্তুর তাপমাত্রাও তত বেশি হয়। অন্যভাবে বলা যায়, তাপ হলো পদার্থের অণুগুলোর গতির সাথে সম্পর্কযুক্ত এমন এক ধরনের শক্তি, যা কোনো বস্তু ঠাণ্ডা না গরম—তার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন : মহাশূন্যে চীনের তিন শতাধিক সক্রিয় কৃত্রিম উপগ্রহ
পদার্থের অণুগুলো সবসময় কমবেশি গতিশীল থাকে। কোনো পদার্থের মোট তাপের পরিমাণ এর মধ্যস্থিত অণুগুলোর মোট গতিশক্তির সমানুপাতিক। কোনো বস্তুতে তাপ দেওয়া হলে এর অণুগুলোর ছোটাছুটি বৃদ্ধি পায়, ফলে এর গতিশক্তিও বেড়ে যায়। সুতরাং তাপ পদার্থের আণবিক গতির সাথে সম্পর্কিত এক প্রকার শক্তি, যা আমাদের শরীরে ঠাণ্ডা বা গরমের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
চীনের প্রায় ৯০ কোটি মানুষের শরীরে ইতিমধ্যেই প্রচণ্ড গরমের অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। তাশু সৌরপদে বছরের সবচেয়ে বেশি গরম পড়বে—এটাই স্বাভাবিক। চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে এমনটাই হওয়ার কথা। তবে, এবার আগের বছরের তুলনায় গরম একটু বেশি পড়ছে ও পড়বে বলে আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে।
২৬ জুলাইয়ের মধ্যেই চীনের দক্ষিণাঞ্চলের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠবে। আর ২৭ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত চীনের অধিকাংশ অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে বেশি গরম পড়বে। এর আগে, এই একবিংশ শতাব্দীর ২০০৩, ২০১৩, ও ২০১৭ সালে চীনারা এমন ধারা গরম সহ্য করেছিল।
‘তাশু’ সৌরপদে শুধু গরমই পড়ে না, প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়। দীর্ঘস্থায়ী সূর্যালোক, উচ্চ তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত কৃষির জন্য ভালো। তবে, এসময় কৃষকদের সাবধান থাকতে হয়। আকস্মিক বন্যা, অনাবৃষ্টি, বা টাইফুনের আঘাত আসতে পারে যেকোনো সময়। যথাসময়ে পাকা ফসল ঘরে তোলা এবং নতুন ফসল বোনা কৃষকদের জন্য তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাবধান না-থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বড় ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল।
চীনা কৃষকেরা এসময় সাবধান থাকে। তবে, চ্যচিয়াং প্রদেশের থাইচৌ এলাকার লোকেরা সাবধান থাকার পাশাপাশি, অধিক ফলন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট দেবতার বিশেষ পূজার আয়োজনও করে।
আরও পড়ুন : চীনে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দান ব্যবস্থা ও দশ বছরের লিন ওয়েনচুনের কথা
শত শত বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে। তাশু সৌরপদ এলেই, পূজার অংশ হিসেবে, স্থানীয়রা একটি বড় নতুন নৌযান নির্মাণ করে। এর নাম ‘বড় গরম জাহাজ’। এতে শুকর, ভেড়া, মুরগি, মাছ, চিংড়ি, ইত্যাদি বোঝাই করা হয়।
কমপক্ষে ৫০ জন জেলে সেই নৌযান সড়কপথে টেনে নিয়ে যায়। তখন সড়কের দু’পাশে স্থানীয় বাসিন্দারা দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে থাকে। এই সময় ড্রাম বাজানো হয়, পোড়ানো হয় আতশবাজি। একসময় নৌযান জাহাজ-ঘাটে পৌঁছে এবং সেটি সমুদ্রে ভাসে। পূজার একেবারে শেষ পর্বে নৌযান আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
তাশু সৌরপদে চীনের গ্রামাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে বেশি ঝিঁঝি পোকা পাওয়া যায়। ঝিঁঝি পোকার লড়াইও তখন বেশ জমে ওঠে। প্রাচীনকাল থেকেই ঝিঁঝি পোকার লড়াই চীনাদের বিনোদনের অংশ। যতদূর জানি, প্রাচীন আমলে সম্রাটদের অন্যতম প্রিয় বিনোদন ছিল এই ঝিঁঝি পোকার লড়াই।
হাজার বছর আগে, থাং রাজবংশ আমলে, ঝিঁঝি পোকার লড়াই শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। আধুনিক চীনে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এই লড়াই বিরল। তবে, তাশু সৌরপদে আজও চীনের কেউ কেউ ঝিঁঝি পোকার লড়াইয়ে মেতে ওঠে।
বলতে গেলে প্রতিটি সৌরপদে চীনারা বিশেষ খাবার খায়। অঞ্চলভেদে এই খাবার ভিন্ন হতে পারে। ফুচিয়ান প্রদেশের ফুথিয়ান অঞ্চলের লোকেরা তাশু সৌরপদের প্রথম দিনে লিচু ও ‘মিজাও’ খেয়ে একে স্বাগত জানায়। লিচুতে গ্লুকোজ ও ভিটামিন থাকে।
আরও পড়ুন : চীনের ‘তিন সন্তান নীতি’ এবং অতঃপর
ফুথিয়ানের মানুষ এই সময় লিচু কুয়ার ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখে। পরে তা মজা করে খায়। তারা বিশ্বাস করে, তাশু-তে লিচু জিনসেংয়ের মতো পুষ্টিকর। আর ‘মিজাও’ তৈরি করা হয় গাঁজানো ভাত থেকে। এর সঙ্গে বাদামি চিনি মিশিয়ে মিজাও রান্না করা হয়।
তাইওয়ানে একটি কথা প্রচলিত আছে, বড় গরমে আনারস খেতে হয়। সেখানকার চীনারা মনে করে, বড় গরম বা তাশু-তে আনারস খেতে সবচেয়ে মজা। আর চীনের মূল ভূ-ভাগের শানতুং প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাশু-তে ভেড়ার মাংসের স্যুপ খেয়ে থাকে। তাশু-র প্রথম দিনে এখানকার অনেক বাসিন্দা স্থানীয় রেস্তোরাঁয় ভিড় জমায় স্রেফ ভেড়ার মাংসের স্যুপ খেতে। এই স্যুপ ‘গ্রীষ্মের ভেড়ার মাংসের স্যুপ’ নামে পরিচিত।
১৫১৩ সালে ফ্লোরিডা আবিষ্কার করেছিলেন স্পেনের বিশ্বখ্যাত আবিষ্কারক হুয়ান পনছে দে লেয়ন (Juan Ponce de Leon)। কিন্তু তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন ‘যৌবনের ঝর্ণা’ খুঁজে বেড়ানোর জন্য। ৭৪ বছর বয়সে শিল্পী লুকাস ক্রনাখ (Lucas Cranach) এঁকেছিলেন ওই অলৌকিক ঝর্ণার কাল্পনিক ছবি।
থুত্থুড়ে বুড়িরা ঝর্ণার ভেতরে ঢুকছেন এবং বেরিয়ে যাচ্ছেন পূর্ণযৌবনা হয়ে—এই হচ্ছে ছবির বিষয়বস্তু। লেয়ন সেই কাল্পনিক ঝর্ণার খোঁজে গিয়ে, বনে-জঙ্গলে বিষমাখা তীর খেয়ে মারা গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন : চীনের দুই অধিবেশন
আধুনিক যুগে আর এমন পাগলামি করার সুযোগ নেই। তবে, কুয়াংতুং প্রদেশে একটি জনপ্রিয় কথা প্রচলিত আছে, ‘তাশু-তে ভেষজ জেলি খেলে যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয়।’ তাই, দ্বাদশ সৌরপদে অনেক চীনা এক ধরনের বিশেষ জেলি খেয়ে থাকে। এই জেলির চীনা নাম সিয়ানছাওতুং।
ইংরেজিতে একে ‘গ্রাস জেলি’ বা ঘাসের জেলি বলা যেতে পারে। এই জেলি তৈরি হয় বিশেষ এক ধরনের ঘাস থেকে। ঘাসের পাতা ও কাণ্ড সূর্যের আলোতে শুকিয়ে এই জেলি বানানো হয়। এই জেলি তাশু সৌরপদের তীব্র গরম কাটাতে মানুষকে সাহায্য করে। তবে, এতে তাদের যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয় কি না, কে জানে!
আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)