এই লজ্জা রাখব কোথায়?
বর্তমানে আমাদের ছাত্রদের দেখলে কেমন জানি উদ্দেশ্যহীন আর উগ্রবাদী মনে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আমাদের ছাত্র সমাজের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড আমার মতো অনেক সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে বলে আমি মনে করি।
জুন মাসে সাভারের হাজী ইউনুছ আলী কলেজের মাঠে দিনে-দুপুরে কলেজ শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে ওই প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল আহসান জিতু।
আরও পড়ুন : শিক্ষক লাঞ্ছনায় সবাই নিশ্চুপ কেন?
এরপরই সারাদেশে তা নিয়ে নিন্দা-প্রতিবাদ-সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমাজের বিবেকবান মানুষদের ভাবিয়ে তুলে ঘটনাটি। কেউ হয়তো ভাবেনি এইভাবে একজন শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠানের ছাত্র দ্বারা নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হবেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেখানে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল জ্ঞান অর্জন করা, নতুন নতুন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করা; তারা আজ সেখানে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছে।
এই ঘটনাই শেষ নয়। আরেকটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, ২০২২ সালের ২৯ মার্চ শরীয়তপুরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের ৩৪তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের বাংলা বিভাগের শিক্ষক-কর্মকর্তা বিএম সোহেলকে কিল, ঘুষি, লাথি মেরে লাঞ্ছিত করেন কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগের তথাকথিত সভাপতি সোহেল ব্যাপারী। পরে অবশ্য সেই কমিটি বিলুপ্ত করা হয় সেই ঘটনার জের ধরে।
আরও পড়ুন : শিক্ষক ও শিক্ষকতা
তারও আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে পরীক্ষা চলাকালীন এক পরীক্ষার্থীকে অনৈতিক সুবিধা না দেওয়ায় কলেজের ৩৩তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের এক শিক্ষক-কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
সম্প্রতি এইরকম অহরহ ঘটনার খবর আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমি বলব, এগুলো আসলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এগুলো আমাদের ছাত্র সমাজের চরম নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা অন্যায় করলেও শাসন করা যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেখানে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল জ্ঞান অর্জন করা, নতুন নতুন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করা; তারা আজ সেখানে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছে।
আরও পড়ুন : শিক্ষা, শিক্ষকতা ও জুতার মালা
শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলছে। শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করছে। অথচ, আমাদের সময় আমরা যখন দেখতাম শিক্ষক এক রাস্তায় দিয়ে আসলে, আমরা ভয়ে লুকিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করতাম। এখনো আমরা আমাদের গুরুজনদের দেখলে পেছনে নিজের হাত রেখে বিনয়ের সাথে কথা বলি পরম শ্রদ্ধা রেখে। এখন এইসবের দেখা মেলে না।
বর্তমান ছাত্র সমাজের এই করুণ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হতে পারে—
• শিক্ষার্থীদের পারিবারিকভাবে নৈতিক মূল্যবোধ ও নিজ নিজ ধর্মের শিক্ষা দেওয়া।
• শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপ-রাজনৈতিক চর্চা বন্ধ করা।
• অভিভাবকদের উচিত তাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, সেই বিষয়ে ব্যাপকভাবে নজরদারি রাখা।
• শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আদর-শাসন দুটি করার অধিকার দেওয়া।
অভিভাবকের পরে শিক্ষকদের স্থান সবচেয়ে উপরে। সেই জায়গায় এখন শিক্ষকেরা লাঞ্ছনার শিকার, হত্যার শিকার কেন? কেন আমাদের শিক্ষার্থীরা এত উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছে?
আমরা জানি, অভিভাবকের পরে শিক্ষকদের স্থান সবচেয়ে উপরে। সেই জায়গায় এখন শিক্ষকেরা লাঞ্ছনার শিকার, হত্যার শিকার কেন? কেন আমাদের শিক্ষার্থীরা এত উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছে? কেন তারা শিক্ষকদের লাঞ্ছনা আর হত্যা করছে?
যে শিক্ষক আমাদের লিখতে, পড়তে শেখায়, সেই শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে একটুও বিবেকে বাধল না কারও? সেই শিক্ষকের জন্যই আমরা আজ ছাত্র পরিচয়ে পরিচিত হতে পারছি।
আরও পড়ুন : কত শিক্ষক অপমানিত হলে আমাদের ঘুম ভাঙবে?
যে গুরুজন শিখিয়েছেন, ‘মানুষকে চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি মারা অন্যায় কাজ; খারাপ কাজ’—আজ সেই শিক্ষাগুরুরা চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি, লাথি, স্ট্যাম্পের আঘাতের শিকার! আমরা কি এইভাবে শিক্ষকদের প্রতিদান দিচ্ছি?
আমাদের মনে রাখা উচিত, এই চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি, লাথি, অপমান, লাঞ্ছনা কিন্তু শিক্ষকের নয়, পুরো জাতির। এইভাবে অপমান করে আমরা গোটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছি। এইটা লজ্জার! ঘৃণার! তা বন্ধ করা জরুরি।
গাজী মিজানুর রহমান ।। ৩৫তম বিসিএস ক্যাডার; লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার