শ্রীলঙ্কা সমাচার : সংকট যতটা অর্থনৈতিক, ততটাই সামাজিক ও রাজনৈতিক
শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ১৫ জুলাই। যদিও অনেকের নাম শোনা গিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকারের তালিকায়। তবে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য তারাই হতে পারে, যারা তাদেরকে এই অমানিশা থেকে মুক্তি দিতে পারে। সেই সম্ভাবনা এখনো নির্ধারিত হয়ে ওঠেনি।
বেশ কয়েক মাস ধরে চলা সরকার বিরোধী বিক্ষোভ ৯ জুলাই এক নাটকীয় মোড় নেয়, যখন শত শত বিক্ষোভকারী পুলিশের বাঁধা ভেঙে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন দখল করে নেয়। যদিও রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে এই ঘটনার আগেই পরিবার সমেত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যান।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবর বলছে, সৌদির প্লেনে মালদ্বীপ ছাড়লেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজাপাকসে পরিবারের সরকার পরিচালনার আপাত সমাপ্তি ঘটল। তবে শ্রীলঙ্কার সংকট সমাধানের বিষয় এই পরিবর্তনে কতটুকু ত্বরান্বিত হবে?
বিশেষত যখন এই কিছুদিন আগে উভয় নেতাই অঙ্গীকার করেছিলেন যে তারা পদত্যাগ করবেন এবং একটি সর্বদলীয় সরকারের জন্য পথ তৈরি করবেন যারা অর্থনীতিতে শৃঙ্খলার পুনরুদ্ধারসহ আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের সাথে ঋণ পুনর্গঠনের আলোচনা এবং আর্থিক ত্রাণের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতির সব দায়িত্ব সুচারুভাবে পালনে সক্ষম হবে।
তাহলে শ্রীলঙ্কার জনগণ এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারেনি তার মূল কারণ কি শুধুমাত্রই রাজাপাকসে সরকারের অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, নাকি জাতীয় রাজনীতিতে মানুষের আস্থার অভাব এক বিশাল ক্ষোভে রূপ নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার সমস্যা তাই নিছক অর্থনৈতিক নয়।
২০২২ সালের এপ্রিলে এসে শ্রীলঙ্কা সম্পূর্ণভাবে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার সূত্রপাত কি আসলেই সাম্প্রতিক?
করোনা মহামারি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে পর্যটন থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ হ্রাস করেছে। তার ওপর বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।
তবে এই অনিশ্চিত আর্থিক অবস্থার শিকড় আরও আগে প্রোথিত হয়েছিল বেশকিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে। যেমন—অতিরিক্ত ও অযাচিত অবকাঠামো ব্যয়ের ওপর আন্তর্জাতিক সূত্রগুলো থেকে ঋণ সঞ্চয় করা হয়েছে এবং কর কর্তনের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব আহরণের পথকে সংকুচিত করা হয়েছে।
তাছাড়াও ২০২১ সালে রাসায়নিক সারের ওপর আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে কৃষিকাজে জৈব বিকল্পের অভিপ্রায় সফলকাম হয়নি এবং ফসলের ফলনও নষ্ট হয়ে যায়।
এই প্রতিটি সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে অর্থনৈতিক মনে হলেও রাজাপাকসে সরকার সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে ও রাষ্ট্রপতির প্রশাসনিক ক্ষমতা চাপিয়ে দিয়ে অনেকটা জোরপূর্বক এই সিদ্ধান্তগুলোকে সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
এই ঋণের বোঝা বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রীলঙ্কা ক্রমবর্ধমানভাবে বাণিজ্যিক সুদের হারে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড গ্রহণ করেছে। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারিতে আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়ায়, ক্রেডিট-রেটিং ফার্মগুলো দেশের সার্বভৌম-ক্রেডিট অবস্থানকে দুর্বল চিহ্নিত করে এবং আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নতুন ঋণের সুযোগ বন্ধ করে দেয়।
২০২২ সালের এপ্রিলে এসে শ্রীলঙ্কা সম্পূর্ণভাবে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার সূত্রপাত কি আসলেই সাম্প্রতিক?
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, সামাজিক ও জাতিগত বিভাজনের ইতিহাস ও ২০০৯ সালের গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তামিল হিন্দু ও মুসলমানদের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈরিতার অবসান না ঘটা ইত্যাদি কারণে শ্রীলঙ্কা বিগত সময়গুলোতে অস্থিরতা, সহিংসতা এবং অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়েছে।
রাজাপাকসে পরিবার সবসময়ই শ্রীলঙ্কার জাতিগত উত্তেজনা নিয়ে ভোট ব্যাংকের রাজনীতি করেছে। ২০০৯ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন এবং গোতাবায়া রাজাপাকসে যুদ্ধের চূড়ান্ত, নৃশংস পর্বের সময় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ছিলেন যখন উত্তরে সবচেয়ে বেশি তামিলদের মৃত্যু ও হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো ঘটেছিল।
শ্রীলঙ্কার সরকারের কাছে ৫১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ বোঝা রয়েছে, যার মধ্যে ৬.৫ বিলিয়ন চীনের কাছে পাওনা। চীন ও শ্রীলঙ্কা এই বিপুল ঋণ কীভাবে পুনর্গঠন করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করছে।
গোতাবায়া রাকাপাকশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং যুদ্ধকালীন নৃশংসতার জন্য জবাবদিহি ব্যবস্থার দিকে সমস্ত অগ্রগতি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিচারের পথ সংকুচিত হয়েছে।
তবে, শ্রীলঙ্কা কখনোই বর্তমান সংকটের মুহূর্তে অর্থনৈতিক এই বিশাল আকৃতির চাপের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এখানে হাজার হাজার নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জ্বালানির ঘাটতি, অত্যাবশ্যক পরিষেবা, শিক্ষা এবং জনগণের জীবিকা ব্যাহত করেছে।
মৌলিক পণ্য এবং পরিষেবার জন্য প্রখর সূর্যের নিচে দীর্ঘ অপেক্ষার পরে তারা নিরাশ হয়েছে। এছাড়াও শ্রীলঙ্কায় অপুষ্টি এবং ওষুধের ঘাটতির প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আর এই দুরবস্থার শিকার বেশিমাত্রায় হয়েছে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।
সামাজিক বিভাজন গ্রামের ও সংখ্যালঘু সমাজের মানুষের দুর্দশাকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই একরৈখিক রাষ্ট্র পরিচালনা প্রক্রিয়ায় এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল বিপরীতমুখী জনতাবাদ (পপুলিজম)-এর ধারণার সূত্রপাত হয়েছে। জনতা তাই আজ আর অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানকল্পে সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
শ্রীলঙ্কার সরকারের কাছে ৫১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ বোঝা রয়েছে, যার মধ্যে ৬.৫ বিলিয়ন চীনের কাছে পাওনা। চীন ও শ্রীলঙ্কা এই বিপুল ঋণ কীভাবে পুনর্গঠন করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করছে।
বিশ্বব্যাংক শ্রীলঙ্কাকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। ভারত ন্যূনতম ১.৯ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকার সম্ভাব্য ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাথেও আলোচনা করছে।
পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় শিল্পায়িত দেশগুলোর জোট জি-৭ এর থেকে এখনো কোনো প্রত্যক্ষ সহায়তার ঘোষণা আসেনি, তবে তারা ঋণ পরিশোধের চাপ কমাতে শ্রীলঙ্কার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে এই মর্মে বিবৃতি দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এই সকল কার্যক্রমের বাস্তবায়নের জন্য একটি স্থিতিশীল ও কার্যকরী রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজন হবে।
একটি নতুন জনমুখী রাজনৈতিক প্রশাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার যেকোনো সংকট মোচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। দীর্ঘমেয়াদে, শ্রীলঙ্কার সমাজে বিভাজনের যে সংকট ও রাজনীতিবিদদের উপর আস্থাহীনতার যে সংস্কৃতি গভীরতর হয়েছে, তা দূর করার মাধ্যমেই অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানের স্থায়ী সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে।
ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস ।। সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়