উৎসবগুলো সম্প্রীতির কথা বলে
বাঙালির সংস্কৃতি একটি মিশ্র সংস্কৃতি। বর্তমান বাঙালি সংস্কৃতিতে হিন্দু, মুসলিম, আদিবাসীসহ এ ভূমির ভূমিজ সকল সম্প্রাদায়ের অবদান বা প্রভাব রয়েছে। রাজশক্তি বা ক্ষমতার কারণে সমাজের উঁচুতলায় হয়তো মেরুকরণ বা অসহিষ্ণুতা ছিল বা আছে। কিন্তু এর বিপরীতে সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে সর্বত্রই একটি সম্প্রতির বাতাবরণ ছিল এবং আজও তা পদ্মা প্রবাহের ন্যায় বহমান রয়েছে।
তাই দেশে উৎসব বা ধর্মীয় উৎসব হয়তো কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের হলেও, সে সকল উৎসবের আনন্দ সকল সম্প্রাদায়ের মানুষই আনন্দের সাথে উদযাপন করে। আমার ছোটবেলার বিশাল একটি সময় বরিশালে শহরে কেটেছে।
আজও মনে পড়ে, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বড়দিন বা যিশুখ্রিস্টের জন্মদিনের দিন বরিশাল অক্সফোর্ড চার্চসহ কয়েকটি গির্জায় সকালবেলা বড়দিনের অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম। আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহণ করতাম।
একইভাবে মনে পড়ে, ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি। মাদারীপুরে আমাদের বাড়ির পাশেই একটি বড় ঈদগাঁ রয়েছে। সেই ঈদগাঁতে ঈদের বড় জমায়েত অনুষ্ঠিত হত। ছোটবেলায় অন্য শিশুদের সাথে আমরাও অনেক আনন্দ এবং উৎসাহ নিয়ে ঈদের জমায়েত দেখতাম।
ঈদের দিনে বাবার পারিবারিক বন্ধু বাবলা হাওলাদার কাকা, আমাদের জন্য আলাদা করে রান্না করে, আমাদের অপেক্ষায় বসে থাকতেন। নব্বইয়ের দশকে দেখেছি ঈদ উৎসব উপলক্ষে সারা রমজান মাস জুড়ে প্রচুর বাজি পোড়ানো হত। সাধারণত শিশু বা কিশোরেরাই লুকিয়ে এ কাজটি করতো।
শহরের মধ্যে আমাদের বাড়িটি একটি বাগানযুক্ত বাড়ি। তাই নিরাপদে বাজি পোড়াতে শহরের বিভিন্ন এলাকার অনেক শিশু, কিশোরেরাই আমাদের বাগানে চলে আসতো। রমজান মাস উপলক্ষে যেহেতু স্কুল বন্ধ, তাই আমরাও আগ্রহ নিয়ে সেই বাজি পোড়ানো দেখতাম। সেই কৈশোরের স্মৃতিগুলো আজও আমার মনকে নাড়া দিয়ে যায়।
আমাদের এলাকায় কোনো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ না থাকায়, আমাদের শিশুকালে কোনো বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপন হতে দেখিনি। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগে ভর্তি হলাম, তখন সংস্কৃত এবং পালি দুটি বিভাগ একসাথে ছিল।
তখন যেহেতু সংস্কৃত এবং পালি বিভাগে সমন্বিত পরীক্ষা হতো না, ভর্তি পরীক্ষা হতো শুধুই বিভাগীয় তত্ত্বাবধানে, তাই সে সময়ে সংস্কৃত বিভাগের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং পালি বিভাগের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই ছিল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। আমার পালি বিভাগের বন্ধুদের মাধ্যমে প্রথম ঢাকা কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারসহ সেই বড়ুয়া বন্ধুদের বাসায় বুদ্ধপূর্ণিমার উৎসবে অংশগ্রহণ করি। সে স্মৃতিগুলো ভোলার নয়।
মহাকালের জাতায় পড়ে সময়টা অনেকটাই বুঝি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে প্রতিবেশী যে ছেলেটা আমার সাথে বসে আমার মতো অবাক বিস্ময়ে মন্দিরে প্রতিমা বানানো দেখত; পূজার সন্ধ্যাকালে প্রত্যেকদিন আরতি প্রতিযোগিতা হতো, সেই প্রতিযোগিতায় যে অংশগ্রহণ করতো, সেই ছেলেটাই আজ যখন মূর্তিপূজা নিয়ে, হিন্দু সম্প্রদায় নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন নোংরা কটূক্তি করে পোস্ট করে তখন বুঝতে পারি, সময়টা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।
সেই সুন্দর দিনগুলো হয়তো আর ফিরে আসবে না। এই যে সম্প্রদায়গত মনজগতের পরিবর্তন, এটা তীব্র হয় নব্বই দশকের শুরু থেকে। এর আগে যাপিত জীবনের আশপাশে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ এতটা ছিল না। সারা বাংলার কথা বলতে না পারলেও, অন্ততপক্ষে আমাদের এলাকায় ধর্মীয় মেরুকরণ ছিল না এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল পাড়া-প্রতিবেশী সকলের মধ্যে।
আমাদের বাড়ি ভর্তি ছিল নারিকেল গাছ। প্রচুর নারিকেল হতো গাছগুলোতে। পূজার আগে এগুলো দিয়ে প্রচুর পরিমাণে নারিকেলের নাড়ু তৈরি করা হতো। ছাতুর মোয়া, চিড়ার মোয়া, মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়াসহ বিভিন্ন প্রকারের মোয়া তৈরি করা হতো। ঢ্যাপের খইয়ের মোয়া তো আজ বিরল হয়ে গেছে।
নারিকেল এবং ক্ষীর দিয়ে তৈরি করা হতো, অপূর্ব স্বাদের টাটখিসসা নাড়ু। বিভিন্ন আকৃতির মাটির সাঁচের ছাপ দিয়ে তৈরি হতো সুদৃশ্য বাহারী নাড়ু। এ খাবারের ঐতিহ্যগুলো যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, আগামী প্রজন্ম হয়তো উপলব্ধিই করতে পারবে না বা জানতেই পারবে না ঐতিহ্যবাহী আমাদের এ বাঙালি খাবারগুলোর কথা। আমাদের আশপাশে অধিকাংশ পরিবারই মুসলিম পরিবার।
তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। তারা আসত এবং অত্যন্ত আগ্রহে একরকম কাড়াকাড়ি করে এ নাড়ু, মোয়া খেত। অনেকেই এই নাড়ু, মোয়া রাখার টিনের বড় বড় কৌটাগুলো কোথায় রাখা আছে তাও জানতো। কিন্তু আজ দুঃখ লাগে যখন দেখি, গত এক-দুই দশকে চারপাশটা অনেকটাই বদলে গেছে।
যারা আগে প্রচণ্ড আগ্রহ ভালোবাসা নিয়ে আমাদের বাসাতে পূজায় নাড়ু, মোয়া খেতে আসতো, তাদের অনেকেই আজ দেখি হিন্দুদের বাড়িতে খায় না। হতবাক হই কয়েক দশকের মধ্যে আশপাশের পরিচিত মানুষদের পরিবর্তনে। এখনও সম্প্রীতির সেই পুরাতন স্মৃতিগুলো চোখে ভাসে।
শুধুই শারদীয় দুর্গোৎসব নয়, ঈদ, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিনের উৎসবসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করে স্মৃতির মণিকোঠায়। আমার মতো হয়তো একই প্রকারের অভিজ্ঞতা প্রত্যেক বাঙালির।
উৎসবগুলো হয়তো বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের। কিন্তু এ উৎসবের আনন্দ সকলের। এ উৎসবগুলো সর্বজনীনতার কথা বলে, সম্প্রীতির কথা বলে। উৎসবগুলোকে কেন্দ্র করে যে একটি সামাজিক মেলবন্ধন দেখা যায়, এমনটি আর কোনো ক্ষেত্রেই দেখা যায় না।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা মৌলবাদী শক্তির মেরুকরণের রক্তচক্ষুর চাপ যতই থাকুক না কেন, সেই রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষ ঠিকই উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ করে। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে উৎসবগুলো আরও বর্ণিল হয়ে ওঠে। এ কারণেই বলা হয়, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।
বৈশাখের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ, বর্ষাকালে বর্ষা উৎসব, হেমন্তকালে হৈমন্তী উৎসব, নতুন ধানের অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসব, বসন্তকালে বসন্ত উৎসব, বঙ্গাব্দের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তি ইত্যাদি ঋতু বা মাসভিত্তিক অনুষ্ঠানের সাথে মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ, হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বুদ্ধপূর্ণিমা, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিনের উৎসবসহ বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবগুলোই পারে সার্বজনীন বাঙালি সত্ত্বাকে ঐক্যবদ্ধ করতে। হিংসা বিদ্বেষের সাম্প্রদায়িক কূপমণ্ডূকতা পরিত্যাগ করে একে অন্যের আরও কাছাকাছি আনতে। তবেই জাতিগতভাবে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারব।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এনএফ