লৈঙ্গিক বৈষম্য : শিক্ষাব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন?
যখন লিখছি তখন আমার প্রবাস জীবনের ১০ বছর কেটে গেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র এবং গবেষক হিসেবে। এই ১০ বছরের সাথে তার আগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বছরের তুলনা চলেই আসে মাঝে মাঝে।
আমি ভাবার চেষ্টা করি যে, দেশের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় যদি না দেখতাম, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে ধারণা কি আদৌ তৈরি হতো? বিশ্ববিদ্যালয়ে সমতা তৈরি, ক্রিটিক্যাল চিন্তার প্রসারে কী ভূমিকা রাখে বা রাখার সম্ভাবনা ধারণ করে, তা নিয়ে চিন্তার ক্ষমতা তৈরি হতো?
বাংলাদেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন যে বিষাক্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে নারী হিসেবে দিন পার করতে হতো, তার বাইরেও যে একটা পরিবেশের সম্ভাবনা আছে, এই ধারণা কি আদৌ তৈরি হতো?
বাংলাদেশে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম এবং আমার আশেপাশে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে—সম্পূর্ণ শিক্ষা কাঠামোতেই, টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি (বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক ব্যবহার) প্রতি কোষে কোষে ঢুকে আছে। ১৮/১৯ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে আমাদের কিশোরী-তরুণীদের মোকাবিলা করতে হয় এমনকি প্রৌঢ় অধ্যাপকদের প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক ব্যবহার।
তরুণ পুরুষ প্রভাষকদের নিয়মিত অপেশাদারি ব্যবহার তো আছেই। এই অপেশাদারিত্বের মধ্যে নারীদের প্রতি প্রচণ্ড কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনের দাবি, যৌন নির্যাতন সবই আছে।
কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য বা অপেশাদারি ব্যবহারে আপত্তি তোলার সাহসও আমরা করি না। এমনকি, যৌন নির্যাতনের শাস্তি দাবিও যতবার তোলা হয়েছে, শিক্ষা কাঠামো শিক্ষকদেরই সহায়তা করেছে কারণ ‘প্রমাণ’ এর অভাব।
একজন ২০/২১ বছরের তরুণী শিক্ষার্থীর কি সাথে করে ভিডিও টেপ রেকর্ডার সাথে করে ঘোরার কথা প্রমাণ রাখার জন্য যে কখন ‘সম্মানিত’ শিক্ষক অসম্মান করবেন? প্রতিদিন এই স্থূল সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকে যেতে হলে আদৌ কারো পক্ষে কি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তৈরি হওয়া সম্ভব?
এই পরিস্থিতির মধ্যে ধীরে ধীরে গুটিয়ে যেতে যেতে মোটামুটিভাবে সব মেয়ে শিক্ষার্থীই ঝরে যায়। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা কাঠামো এবং পুরুষতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোতে নারী শিক্ষার্থীর একাডেমিয়া বা নন-একাডেমিয়াতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে সুযোগ এবং পরিবেশ দরকার, তা নেই।
কাঠামোগত পরিবর্তন না আনলে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই অদূর ভবিষ্যতে। প্রতিদিন যদি নারী হিসেবে চলতে হয় অজস্র কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের ভেতর দিয়ে, সেই পরিবেশে বেড়ে ওঠার তাগিদ জন্মে না মানুষের। টিকে থাকাটাই কোনোরকমে হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
বাংলাদেশে কর্মস্থল বা শিক্ষাঙ্গনে অপেশাদারিত্বের সংজ্ঞা কী? ধর্ষণ বা যৌন অত্যাচার ছাড়া অন্য কোনো অপেশাদারিত্বের কি প্রতিবাদ করা যায়? মেয়েদের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে অনেক পুরুষ শিক্ষকেরা বলেন, ‘মেয়েরা পারবে না’, ‘পারে না তো দেখাই যায় আশেপাশে’ ‘অনার্স শেষে মেয়েদের উচিত বিয়ে করা, পড়াশোনা আবার কী’।
এইধরনের অপেশাদারিত্ব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে দেখে এবং মোকাবিলা করে? কোনো প্রতিরোধ প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে কী? যদি শিক্ষকেরা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বা আচরণ করেন, কী করা যেতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবছে এইসব নিয়ে?
একাডেমিক জগতে টিকে থাকতে প্রয়োজন কন্টিনিউয়াস মেন্টরিং—ক্লাসরুমের বাইরে প্রতিদিন জ্ঞানচর্চার জন্য নির্দেশনা দিতে সক্ষম এমন পরামর্শক। এই ব্যবস্থা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা আছে?
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য নারী শিক্ষক কতজন আছেন? পুরুষ শিক্ষকেরা কতজন নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবেশের বাঁধাগুলো বুঝে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী? এই অনুপাত পরিবর্তনে আমাদের শিক্ষা কাঠামো কী চিন্তা করছে?
উন্নত বিশ্বে লিঙ্গ এবং অন্যান্য সমতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাব্যবস্থা, বুদ্ধিজীবী সমাজ ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছে। এই প্রশ্নগুলো আমাদের সমাজে এখনো উঠছে না। তাই বাংলাদেশের অনেকটাই দুর্বল একাডেমিয়াতে নারীর অবস্থান দুর্বলতর।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঠামোতান্ত্রিক পরিবর্তন এনে বৈষম্য কমাতে কাজ করতে পারে। আমি এই লেখায় বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিদিন দেখা কিছু কাঠামোর কথা উল্লেখ করতে চাই। এই কাঠামোগুলো কেবলমাত্র সদিচ্ছার মাধ্যমেই পরিবর্তন করা সম্ভব, এর জন্য বিশাল পুঁজির প্রয়োজন নেই।
যৌন হয়রানি ট্রেনিং—প্রথমত, বহু মানুষ ‘অপেশাদারি’ মনোভাবের অর্থ জানে না। এই সমস্যা সমাধানে দরকার মানুষকে ক্রমাগত মনে করিয়ে দেওয়া প্রতিষ্ঠান কাকে ‘অপেশাদারি’ মনে করে। যেমন, আমার জানামতে একজন পুরুষ মধ্যবয়সী শিক্ষক আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রীদের বিয়ের পর বারবার ‘তোমার বাচ্চা হয় না কেন’ বলতেন। এই ধরনের মন্তব্য যে অপেশাদারি, তা আমাদের কাঠামোগত ভাবেই সবাইকে জানানো উচিত। প্রয়োজনে নিয়মিত বিরতিতে বারবার জানানো প্রয়োজন।
আমাকে আমার কর্মস্থলে এমন ট্রেনিংয়ের মধ্যে থেকে বারবার যেতে হয়। এই ট্রেনিংয়ের মূল লক্ষ্য বিভিন্ন হাইপোথেটিক্যাল সিনারিও-এর মাধ্যমে সবাইকে জানানো ‘অপেশাদারি’ কী।
ছাত্রদের কাছে থেকে বাড়তি সুবিধা নেওয়া, ছাত্রদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা, লৈঙ্গিক এবং শ্রেণি বৈষম্য করা, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা ইত্যাদি এর মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশে আমাদের শিক্ষক এবং সহকর্মী/সহপাঠীরা কুরুচিপূর্ণ ব্যবহারের সুযোগ যেন না পায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। করলে মানুষ সচেতন হবে, অন্তত আশা করা যায়।
মেন্টরিং এবং নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট:
নারী শিক্ষার্থীদের একাডেমিক এবং নন-একাডেমিক কাজে মেন্টরিং দরকার। এই মেন্টরিং কে করবে? মেন্টরিং করাটাও শিখতে হয়; আমাদের শিক্ষক হায়ারিং প্রসেস এতটাই অস্বচ্ছ এবং নড়বড়ে যে মেন্টরিং করার যোগ্যতাই আমাদের অনেক শিক্ষকদের নেই।
কিছু শিক্ষক এবং কিছু ছাত্র মিলে ‘দাদাগিরি’-এর মাধ্যমে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে রাখছে। কিন্তু, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এক/দুই দশকে নারী শিক্ষার্থীদের একাডেমিক/নন-একাডেমিক ক্যারিয়ারে বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে নারীদের নিজেদের মধ্যের নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে। এটা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ বৃদ্ধি:
বৈষম্য কমাতে আরও প্রয়োজন সব শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ। প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগের জন্য প্রয়োজন নিরাপত্তা। যেমন, নারী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কি ডে-কেয়ার সেন্টার আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে?
নারী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে দূর করছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের হল রাত ৯ টায় বন্ধ করা প্রয়োজন হলে, হলের ভেতরেই পড়াশোনার জন্য লাইব্রেরি সুবিধা রাখতে হবে। ক্যাম্পাসের সীমিত পরিসরেও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেন আজও অসম্ভব?
ভাষা ও ক্লাসরুম পাঠদান পদ্ধতি:
ক্লাসরুমে পাঠদানের পদ্ধতি পরিবর্তন একদিনের কথা না। ক্লাসরুমে একমুখী পাঠদান ব্যবস্থা এবং মুখস্থ ভিত্তিক একঘেয়ে পড়াশোনার কাঠামোতে কারো পক্ষে কি বেড়ে ওঠা সম্ভব?
লৈঙ্গিক বৈষম্যের সূত্রেই আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে পরবর্তী ইন্টারসেকশনগুলো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাঠদান পদ্ধতি কতটা সর্বজনীন? আমার জানামতে, অনেক বিভাগেই ঢাকা শহর এবং ঢাকার বাইরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চূড়ান্ত ব্যবধান বজায় থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম, তাতে ‘ভালো’ রেজাল্ট কেবল কিছু বিখ্যাত কলেজ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ডাইভার্স ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে বিশ্ববিদ্যালয় কি ভূমিকা রাখছে? এইসব প্রশ্নও তুলতে দেখি না আমাদের শিক্ষাবিদদের। বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স হয়েছে ১০০ বছর, কিছু পরিপক্ক দাবি এখন করা যেতেই পারে।
অপর্ণা হাওলাদার ।। পোস্টডকটরাল ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব রোড আইল্যান্ড, ইউএসএ