সংস্কৃতি যখন ধর্মের মুখোমুখি!
ঘরগুলো বদলে গেছে। আসবাব আগের মতো নেই। খুব বেশিদিনের পুরনো ঘর নয়। ঘরের মানুষগুলোও চেনা। ক্রমশ তারা অপরিচিত হয়ে উঠছে। যেভাবে তাদের চিনতাম। সেই চেনার জায়গা থেকে তারা অনেক দূরে চলে গেছে। এই দূরে চলে যাওয়া দুটো কারণে হয়েছে এক, টাকা; দুই, বিশ্বাস।
কারো কারো ঘরে বিত্ত এসেছে। বিত্ত আসার কারণে তাদের মধ্যে একটি তাড়না কাজ করেছে অতীতকে ভুলে যাওয়ার। ভুলে যেতে গিয়ে অভ্যাস ও আচারও মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলেছে বিশ্বাস। বিশ্বাস তার আগে ছিল না এমন বলা যাবে না।
সমাজের সকল ঘরই বিশ্বাসের স্তম্ভ দিয়ে তৈরি। সেখানে ধর্ম ছিল। ধর্ম নতুন করে ঘরে প্রবেশ করেনি। পার্থক্য হলো আগে ধর্ম ছিল সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার। পারিবারিক আচারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ধর্ম।
সংস্কৃতি আর ধর্মের মাঝে যে বিরোধ নেই, সেই কথা ভুলিয়ে দিয়ে দুটো বিষয়কে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। কারণ কি? সহজ কারণ হচ্ছে আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার।
ধর্ম যে সংস্কৃতি একথা সবার জানা ছিল। সংস্কৃতির অন্যান্য অনুষঙ্গের অনুশীলনের সঙ্গে সহবস্থান ছিল ধর্মের এবং অবশ্যই সকল ধর্মেরও সহবস্থান ছিল।
সহিষ্ণুতা ছিল সকল ঘরের পরিচিত আচার। অন্যের মতকে গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যাস তৈরি হতো ঘর থেকেই। এখন বদলে যাওয়া ঘরে ধর্ম বা বিশ্বাস এসেছে প্রদর্শনযোগ্য উপকরণ হয়ে।
সংস্কৃতি আর ধর্মের মাঝে যে বিরোধ নেই, সেই কথা ভুলিয়ে দিয়ে দুটো বিষয়কে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। কারণ কি? সহজ কারণ হচ্ছে আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার।
জ্ঞান যার কাছে আছে সেই ঘরে বা সমাজে আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার পথে যাবে না। সেই জ্ঞানের সুন্দর দিয়ে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করবে। জ্ঞান বহির্ভূত পুঁজি বা টাকা যার কাছে পৌঁছেছে, সে টাকা দিয়ে ধর্মকে কেনার চেষ্টা করেছে। সে টাকা দিয়ে কিনতে চায় সংস্কৃতি।
কিনতে চায় কথাটি এখন বাড়তি বলাই হচ্ছে। কারণ বেচা বিক্রি শেষ। এই কেনাবেচার কাজ আজ থেকে নয়, বহুদিন আগে থেকেই চলছে।
পৃষ্ঠপোষক হওয়ার সুযোগে পুঁজি ধীরে ধীরে সংস্কৃতির দখল নিয়েছে। এখন পুঁজি সংস্কৃতির সংজ্ঞা ঠিক করে দিচ্ছে। ফলে সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠকেরা তাদের চিন্তার পথচিত্রে হাঁটায় বিরতি দিয়েছেন।
নিজেদের আড়াল বা লুকিয়ে রেখেছেন। কারণ পুঁজি বা ক্ষমতা যে সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হয়েছে, সেই সংস্কৃতির সঙ্গে ঘরের পুরনো অভ্যাসের মিল নেই।
বাঙালির উৎসবকে ধর্মের আবরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ষড়যন্ত্র আছে। বাঙালি কৃষক, শ্রমিক আমজনতার মধ্যে রক্ষণশীলতা নেই...
সমাজ থেকে উৎসবের চেনা দৃশ্য প্রায় বদলে গেছে। মাটির সঙ্গে যে উৎসবের সম্পর্ক, তাকে করা হচ্ছে শিকড়চ্যুত। বাঙালির উৎসবকে ধর্মের আবরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ষড়যন্ত্র আছে। বাঙালি কৃষক, শ্রমিক আমজনতার মধ্যে রক্ষণশীলতা নেই।
তারা উদার নদী হাওর সাগরের মতোই। যেভাবে বাঁধ দিয়ে জলাধার দখল বা হত্যা করা হচ্ছে, সেভাবেই হত্যা করা হচ্ছে সংস্কৃতি। যখন কোনো জেলার নাম বদলে ফেলা হলো, আমরা প্রতিবাদ করিনি। রাজনৈতিক পটভূমি বদলে যাওয়ার পরেও ফিরিনি পুরোনোতে।
দখল ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা থেকে যে নামগুলো বদল করা হচ্ছিল, তাতে আমল না দেওয়াতে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি শুধু নাম নয় পোশাক ও রীতিতেও বদল ঘটে গেছে।
বাংলা সংস্কৃতিকে নিচ ও বিশেষ ধর্মের আচার বলা হচ্ছে। এই বলার কাজ করছেন যারা, তারা সমাজে আধিপত্য চায়। আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা ধর্মের পাশাপাশি রাজনীতিকেও ব্যবহার করছে।
রাজনীতি কখন তাদের ফাঁদে চলে গেছে টের পায়নি। যখন পেয়েছে তখন হয়তো আর ফেরার উপায় ছিল না। এই সংকট যে এককভাবে বাংলাদেশের তা বলা যাবে না।
সংকট বহু আগেই আঞ্চলিক সংকট হয়ে উঠেছে। যেখানে রাজনীতির পরাজয় ঘটেই যাচ্ছে। রাজনীতি যদি ফিরে আসতে চায় অসাম্প্রদায়িক ও জন কল্যাণ ধারাতে তবে তাকে ফিরতে হবে সংস্কৃতির কাছে।
রাজনীতি যখন সংস্কৃতির কাছে ফিরতে শুরু করবে, তখনই দেখা যাবে ঘরে ধর্ম ও মাটির শুদ্ধ অনুশীলনও শুরু হয়ে যাবে। কারণ তাদের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক নয় সম্প্রীতির।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী