পদ্মা সেতু কারিগরিভাবে কেন এত সমৃদ্ধ?
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ২৫ জুন ২০২২। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, গর্বের সেতু—মুহূর্তেই বুকের মধ্যে আনন্দ খেলে যায়। আচ্ছা, পৃথিবীতে তো আরও অনেক সেতু আছে, এমনতো না যে, এটাই দুনিয়ার প্রথম সেতু বা বাংলাদেশের প্রথম সেতু, দুনিয়াতে তো আরও অনেক বড় বড় সেতু আছে, অনেক সুন্দর সুন্দর সেতু আছে, তাহলে আজ এই ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ বা উদ্বোধনে কেন এত খুশি খুশি লাগছে? উত্তর খুঁজতে বেশি বেগ পেতে হলো না।
একটু অন্যভাবে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। আচ্ছা, প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থীই ‘এ প্লাস’ পায় পরীক্ষায়, কয়জনের কথা পত্রিকায় বা খবরে আসে? আসে সেই শিক্ষার্থীর কথা যে কি না অনেক প্রতিকূলতা জয় করে আজ এই ফলাফল অর্জন করেছে। তার হয়তো একবেলা খাবার জুটত না বা তাকে হয়তো অনেকে বলেছে যে, সে পারবে না বা লেখাপড়া তার জন্য না, তার হয়তো একটা হাত ছিল না বা সে হয়তো পা দিয়েই লিখেছে, হাজারও চ্যালেঞ্জ জয় করেছে বলেই আজ পুরো দেশ তাকে চিনছে।
এরপর থেকে তার উদাহরণ দিয়ে, তাকে দেখিয়ে অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে সাহস জোগাবে। এভাবে যেকোনো সফলতার পেছনে যত বেশি অবহেলা থাকে, যত বেশি সমালোচনা থাকে, যত বেশি কষ্ট থাকে সেই সফলতার হয় তত বেশি গর্বের।
আমাদের কাছে পদ্মা সেতু তেমন একটা ব্যাপার কারণ ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের যাতায়াতের কষ্ট কমাতে পদ্মা সেতু তৈরির পরিকল্পনা নেন। এরপর ২০০৪ সালে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয় যেখানে কনসাল্টেন্ট ছিল জাইকা। তারা মাওয়া পয়েন্টকে পদ্মা ব্রিজের জন্য নির্বাচন করেছিল।
২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই স্টাডি রিপোর্টের অনুমোদন দেন এবং শুরু হয় মূল নকশা প্রণয়নের কাজ। এতদূর পর্যন্ত সব ঠিক ছিল কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই পদ্মা সেতু নিয়ে ঘটে নানা নাটকীয়তা।
কাজ শুরু হয়নি, এক টাকাও অর্থ ছাড় হয়নি কিন্তু এরই মাঝে দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক নিয়ে আসল দুর্নীতির অভিযোগ। এক পর্যায়ে সরে যেতে হলো তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব আবুল হোসেনকে। যদিও শেষ পর্যন্ত কানাডিয়ান আদালতে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু এরই মাঝে বিশ্ব ব্যাংক বন্ধ করে দেয় অর্থায়ন।
প্রথম যে চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়াল সেটা হলো, পদ্মা নদী নিজেই। পদ্মা এমন একটা খরস্রোতা নদী যার তুলনা করা চলে একমাত্র আমাজন নদীর সাথে।
বিশ্ব ব্যাংকের এই আচরণ একদিকে যেমন ছিল অপ্রত্যাশিত তেমনি পুরো পৃথিবীর সামনে বাংলাদেশকে করেছিল নতজানু। তারা ভেবেছিল, আমরা এই অন্যায় আচরণ মেনে নিয়ে তাদের কথামতো সব মেনে নেব। কিন্তু তারা হয়তো বুঝতে পারেনি যে, এই দেশের মানুষের মধ্যে হয়তো অনেক ধর্ম আছে, দল আছে কিন্তু যখন প্রশ্নটা আসে দেশের সম্মানের তখন আমরা সবাই এক।
এই দেশের মানুষ সব সহ্য করতে পারে কিন্তু অবিচার সহ্য করতে পারে না ঠিক যেমন পারেনি ১৯৭১ সালেও। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা যখন দেশের উপর, দেশের মানুষের উপর আঘাত হেনেছিল তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে—আর তাই তো আমরা পেলাম এই স্বাধীন দেশ।
২০১৪ সালে এসে সেই ইতিহাস আবার ফিরে এলো নতুনভাবে। অন্যায়ভাবে যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া হলো তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ধারের টাকায় নয়, আমাদের যা আছে তাই দিয়েই হবে পদ্মা সেতু, দেশের মানুষের টাকায় হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
একটা সাহসী কথা, একটা সাহসী স্বপ্ন, একটা সাহসী সিদ্ধান্ত যে মানুষকে কতটা অনুপ্রাণিত করতে পারে, গত আট বছর তা দেখল পুরো দেশ, পুরো পৃথিবী। আজ পদ্মা সেতু বাস্তব। এক একটা পিলার বসেছে পদ্মার বুকে, এক একটা স্প্যান বসেছে তখন সবাই বলছে সেতু দৃশ্যমান হচ্ছে কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছিল বাংলাদেশ।
এই সেতু নির্মাণ করে আমার শুধু অবহেলার জবাব দিচ্ছি ব্যাপার কিন্তু তা নয়। এই সেতু নির্মাণের প্রতিটি ধাপে আমাদের জয় করতে হয়েছে প্রকৌশলগত সর্বোচ্চ চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি, বুদ্ধিমত্তা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের জয় করতে হয়েছে পদ্মার হাজারও প্রতিকূলতা।
প্রথম যে চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়াল সেটা হলো, পদ্মা নদী নিজেই। পদ্মা এমন একটা খরস্রোতা নদী যার তুলনা করা চলে একমাত্র আমাজন নদীর সাথে। এর একটি বড় কারণ হলো, গঙ্গার পানি এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি একসাথে এসে মিলিত হয় আরিচায় যেখানে নদীর প্রসস্থতা যথাক্রমে ১৪ কিমি এবং ৬ কিমি প্রায়।
অন্যদিকে মাওয়া প্রান্তে পদ্মার প্রশস্থতা ৬ কিমি প্রায়। অর্থাৎ ২০ কিমি প্রশস্থতায় প্রবাহিত পানি পার হচ্ছে ৬ কিমি এর একটা চ্যানেল দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই এই স্থানে নদীতে স্রোত থাকে বেশি এবং নদীর তলা আচমকা ৫০/৬০ ফিট বা তারও বেশি ধুয়ে চলে যেতে পারে যেকোনো সময়।
এছাড়াও এই খরস্রোতা নদীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজন হলো সর্বোচ্চ নদী শাসনের কৌশল ও ব্যবস্থাপনা, কারণ নদীর পাড় ভেঙে যাওয়া এখানে একটা নিত্য ব্যাপার। এই নদী শাসনের কাজে স্যাটেলাইট ইমেজের পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে জি পি এস প্রযুক্তি।
শুধু লম্বা পাইলিং করলেই এখানে হচ্ছে না কারণ যেকোনো সময় এখানে মাটি সরে যেতে পারে তাই প্রতিটা কলামের নিচে ৬টা করে পাইলিং করা হয়েছে যেগুলো কৌণিকভাবে অনেকটা মাকড়সার পায়ের মতো ছড়ানো যা স্টাবিলিটি ঠিক রেখেছে।
সেতুর প্রতিটা পিলার এবং পিলারের নিচে পাইলিং করা ছিল অন্যতম একটা চ্যালেঞ্জ এবং বিপদজনক কাজ। কারণ এই নদীর নিচে সব হচ্ছে পলি আর কাদা, এর মাঝে যা দেওয়া হবে তাই মুহূর্তে হারিয়ে যাবে। যেহেতু লোড ট্রান্সফারের জন্য প্রয়োজন শক্ত মাটি বা পাথর সেহেতু এক একটা পাইল প্রায় ৯৬ মিটার থেকে প্রায় ১২৮ মিটার দীর্ঘ করে বানানো হয়েছে।
শুধু লম্বা পাইলিং করলেই এখানে হচ্ছে না কারণ যেকোনো সময় এখানে মাটি সরে যেতে পারে তাই প্রতিটা কলামের নিচে ৬টা করে পাইলিং করা হয়েছে যেগুলো কৌণিকভাবে অনেকটা মাকড়সার পায়ের মতো ছড়ানো যা স্টাবিলিটি ঠিক রেখেছে।
এত বড় পাইলিং মাটিতে গাণিতিক হিসাব মতো প্রবেশ করানোও ছিল বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। এটা এমন একটা ব্রিজ যার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী হ্যামার এবং সবচাইতে শক্তিশালী ক্রেন ‘তিয়ানই’—যা শুধু মাত্র পদ্মা সেতু নির্মাণ করার জন্যই বানাতে হয়েছিল।
এই সেতু নির্মাণে আরেকটা বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবিলা করার ব্যাপার মাথায় রাখতে হয়েছে আর তা হলো ‘ভূমিকম্প’। ভূমিকম্প হলে সেই কম্পন মাটির মাধ্যমে পাইলিং-এ আসবে আর সেখান থেকে যেন সেতুর মূল কাঠামোতে না আসতে পারে সেই জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ প্রযুক্তি যা পেন্ডুলামের মূলনীতি অনুসারে কাজ করে ভূমিকম্পের সময় স্থাপনার ভারসাম্য বজায় রাখে।
দুই স্প্যানের সংযোগস্থলে যে বিয়ারিং বসানো হয়েছে তা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এছাড়াও এর সাথে যুক্ত হচ্ছে রেললাইন যার জন্য সেতুর সড়ক অবকাঠামোর নিচের অংশে স্টিলের ফ্রেম করা হয়েছে। অনেকসময় যেসব কাজে মানুষের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট।
দুই স্প্যানের সংযোগস্থলে যে বিয়ারিং বসানো হয়েছে তা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এছাড়াও এর সাথে যুক্ত হচ্ছে রেললাইন যার জন্য সেতুর সড়ক অবকাঠামোর নিচের অংশে স্টিলের ফ্রেম করা হয়েছে।
এভাবে প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে পদ্মা নদী আমাদের দিয়েছে এক একটি নতুন চ্যালেঞ্জ আর সেটা মোকাবিলা করেছে মূল কাঠামো নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ লিমিটেড’, নদী শাসনের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ‘সিনোহাইড্র’, আমাদের দেশের প্রকৌশলী আর এই সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দল।
পদ্মা সেতু নির্মাণ হলো একটি মহাযজ্ঞ কারণ এটা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বা দৈত্যাকার ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করে একটা স্থাপনা নির্মাণ শুধু নয় এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে জাতীয় অর্থনীতি ও মানুষের জীবন জীবিকার হিসাব।
এই সেতু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমন্বয় সাধনে ভূমিকা রাখেন কারণ এর ফলে সরাসরি দেশের দুটি বন্দর চট্টগ্রাম ও মংলার সংযোগ তৈরি হলো। এর ফলে পণ্য পরিবহনে সময় কমে যাবে, খাদ্যদ্রব্য ও সবজি আগে ফেরি পারাপারের দীর্ঘ সময়ে নষ্ট হয়ে যেত কিন্তু এখন আর তা হবে না, রেললাইনের মাধ্যমে রেল যোগাযোগ স্থাপন হলে অল্প সময়ে অনেক যাত্রী ও মালামাল পরিবহন হবে যা দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল তথা পুরো দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
এছাড়াও এই সেতুটি কিছুটা বাঁকা করে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে গাড়ি চালকেরা মনোযোগ না হারিয়ে ফেলে। সেতুটি সোজা হলে অনেক চালক ঘুমিয়ে পড়তে পারে আবার দিনের বিশেষ সময়ে সূর্যের আলো সরাসরি চালকের চোখে এসে পড়তে পারে। তাই জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তায় সেতু সোজা না করে কিছুটা দুই দিকে বাঁকাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, পদ্মা সেতু, এর সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজা বা অন্যান্য অংশ নির্মাণের জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তাদের প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থানের কথা মাথার রেখে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যার ফলে সকলের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। অর্থাৎ পদ্মা সেতু শুধু একটা স্থাপনাই নয় বরং এটা হল সমন্বিত পরিকল্পনার একটা উদাহরণ।
নদীর উপর সেতু এই পৃথিবীতে আরও রয়েছে, সামনের দিনেও হয়তো হবে কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো অন্য কোনো সেতু গোটা দেশের মানুষের আবেগের এতটা জায়গা দখল করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। এটা নিশ্চিত যে, এই সেতুর পেছনের গল্প আমাদের দেশপ্রেম শেখায়, সাহস দিয়ে সীমাবদ্ধতা দূর করতে শেখায়।
ভালো মানের উপকরণ দিয়ে সিভিল স্ট্রাকচার তৈরি করা হোক না কেন, যেহেতু একে রোদ-বৃষ্টি বা বৈরী আবহাওয়াকে মোকাবিলা করতে হয় সেহেতু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করলে লাইফটাইম অনেক কমে যায়। ইতিমধ্যে এই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের প্রটোকল ঠিক করা হয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে যেন তা নিয়মিত করা হয়। তাহলে আমরা সার্ভিস লাইফের চাইতেও দীর্ঘদিন এই সেতুর সুবিধা নিতে পারব।
এই সেতুর পেছনে প্রকৌশলগত ও প্রযুক্তিগত যে ব্যবস্থাপনা নেওয়া হয়েছে তা একদিন বিশ্বের নামকরা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর সবচাইতে বড় যে বার্তা পদ্মা সেতু দেয় তা হলো, ‘বাংলাদেশ জাগছে - Bangladesh is Rising’।
কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট