পদ্মা সেতু : ‘বড় আশা’র ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে
এক সাগর রক্ত পেরিয়ে বাঙালি বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় উদযাপন করেছিল। তখনো আমাদের বিজয় অসমাপ্ত। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই তা পূর্ণতা পায় বন্দিদশা থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে পা ফেলার পর।
১৯৭২ সালের দশই জানুয়ারি তিনি ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে’ পা রেখেছিলেন। প্রতিটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থানের অঙ্গিকার করেছিলেন। ধ্বংসস্তূপ থেকে সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। সংগ্রামী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে চাই।’
মনে রাখা চাই, তখন তার রিজার্ভে এক ডলারও নেই। কোটি শরণার্থী পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। সড়ক, রেল, সেতু, বন্দর, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত।
কোথাও ফেরি নেই। আশি শতাংশ মানুষ গরিব। খাদ্যাভাব তীব্র। এমনি বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতেও তিনি মানুষের অফুরান প্রাণশক্তির ওপর ভরসা করে সমৃদ্ধ সোনার বাংলার ডাক দিয়েছিলেন।
শুধু পদ্মা সেতু নয় আরও অনেকগুলো মেগা-প্রকল্প এখন দৃশ্যমান। বিশেষ করে মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, বঙ্গবন্ধু শিল্প পার্কের মতো প্রকল্পগুলোও এখন চারদিকে আলো ছড়াচ্ছে। এসব চালু হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুরো চেহারাই বদলে যাবে।
প্রতিকূল পরিবেশে বড় আশা করার এই যে শিক্ষা তিনি জাতিকে দিয়ে গেছেন সেটিই সবচেয়ে বড় পুঁজি হিসেবে আজও আমাদের চলার পথে সবচেয়ে বড় পাথেয় হিসেবে কাজ করছে। সেই আশার ভিত্তি ও ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়ে গেছেন। তার সেই আশাবাদী নেতৃত্বের পরম্পরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মাঝেও সম্প্রসারিত হতে পেরেছে বলেই আজকের বাংলাদেশ এতটা সাহসী এবং সফল হতে পেরেছে।
শুধু পদ্মা সেতু নয় আরও অনেকগুলো মেগা-প্রকল্প এখন দৃশ্যমান। বিশেষ করে মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, বঙ্গবন্ধু শিল্প পার্কের মতো প্রকল্পগুলোও এখন চারদিকে আলো ছড়াচ্ছে। এসব চালু হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুরো চেহারাই বদলে যাবে।
বড় আশা নিয়ে বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার প্রথম পরীক্ষা বঙ্গবন্ধুকন্যা পদ্মা সেতুর মতো চ্যালেঞ্জিং মেগা-প্রকল্প স্বদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই শুরু করেছিলেন। চারিদিকে তখন নাগিনরা ফেলছিল বিষাক্ত নিঃশ্বাস।
বাংলাদেশ ও তার নেতৃত্বকে অপবাদ দেওয়ায় তখন ‘আলোকিত মানুষেরা’ অসাধারণ তৎপর। তখনো পদ্মা সেতুর নির্মাণের ঠিকাদার ঠিক করা হয়নি। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞ প্রস্তাবিত এই সেতুর কারিগরি কমিটি যাচাই-বাছাইয়ে ব্যস্ত। অথচ বিশ্বব্যাংকের ‘ইন্টেগ্রিটি ডিপার্টমেন্ট’ মনগড়া সব অভিযোগ করে যাচ্ছে তথাকথিত দুর্নীতির কথা বলে।
জামিল স্যার পরে আমাকে বলেছেন, এই ধরনের অভিযোগের কোনো ভিত্তিই ছিল না। আর সেকারণেই কানাডার আদালতও রায় দিয়েছে যে এসব অভিযোগ ছিল বানোয়াট। ভাবুন, সেই সময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মনের অবস্থা কী হতে পারে।
সেদিনের অর্থ বিভাগের আপসকামীতা তাকে অবাকই শুধু করেনি দুঃখও দিয়েছে। আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধুর দেওয়া লড়াকু মনের জোরে সকল ষড়যন্ত্র কীভাবে ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন। আর দেশের সম্মান বাঁচাতে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করব।’
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই সংকটকালে তার পাশে থাকতে পেরেছিলাম বলে। তাই তো তিনি তার দলের এক সভায় পদ্মা সেতুর অর্থায়ন কৌশল নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত তার সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে।
তার ঘোষণার পরপরই আমরা গভর্নরের অফিসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা করেছিলাম। ঐ সভাতেই আমরা ঠিক করেছিলাম সরকার এডিপিতে পদ্মা সেতু বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ করবে তা থেকে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ডলার কেনা হবে।
অগ্রণী ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত ডলার না থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে তা দেওয়া হবে। এই ব্যবস্থা আজও সচল আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেটরি সমর্থন নিয়ে অগ্রণী ব্যাংক এরই মধ্যে ১.৪ বিলিয়ন ডলার পদ্মা সেতুর জন্য বৈদেশিক মুদ্রা প্রদান করেছে। আমার বিশ্বাস বাদবাকি ডলার চাহিদাও এই ব্যবস্থায় খরচ করা সম্ভব হবে।
আমাজনের পর সবচেয়ে খরস্রোতা পদ্মা সেতুর বুক চিরে ১২৮ মিটারের বিশ্বের গভীরতম পিলার গাড়া খুব সহজ কাজ ছিল না। এর জন্য বিশেষ হ্যামার জার্মানি থেকে ‘কাস্টমাইজ’ করে সংগ্রহ করতে হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে সেতু নির্মাণের সময় খানিকটা বেশি লাগতেই পারে। আশেপাশের জনগণ সর্বদাই দেখেছেন বাস্তবায়নকারী অংশীজনেরা কি নিষ্ঠার সাথে দিনরাত কাজ করেছেন।
বছর তিনেক আগে সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আমাকে এই সেতু নির্মাণের কর্মযজ্ঞ কাছে থেকে দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
সারাদিন ধরে সকল অংশীজনের কাজের ধরন আমি দেখেছি। তখন ছিল বর্ষাকাল। কি স্রোতে! তার মধ্যেও প্রকৌশলী ও কর্মীদের কি যে প্রাণান্ত কর্মচাঞ্চল্য দেখেছি তা লিখে বোঝাতে পারব না। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই স্বপ্নের সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। আমি স্বদেশ থেকে অনেক দূর। দেশে থাকলে নিশ্চয় আমি এই উদ্বোধনের আনন্দ যাত্রায় যুক্ত হতাম।
পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণ বাংলার একুশ জেলাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার সাথে যুক্ত করবে তাই নয়, ট্রান্স-এশীয় হাইওয়ে ও রেলওয়ের সাথে যুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইনকেও সমৃদ্ধ করবে। এর ফলে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য সংযোগ বাড়বে। আর দক্ষিণ বাংলার কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পর্যটন ও ডিজিটাল সেবায় বিপ্লব ঘটাবে।
আগে পণ্যবাহী যে ট্রাকগুলো দিনের পর দিন মাওয়া-জাজিয়া ঘাটে অপেক্ষা করত তা নিমিষেই পারি দেবে। পচনশীল কৃষি পণ্যের দ্রুত পরিবহনের সুফল দক্ষিণ বাংলার কৃষক ও ঢাকার ভোক্তারা পাবেন। দক্ষিণ বাংলায় এসএমই ও বড় শিল্প গড়ে উঠবে।
বিসিক জানিয়েছে, এরই মধ্যে বরিশালে প্রায় হাজার খানিক ছোট ও মাঝারি শিল্প ইউনিট স্থাপনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। সেখানে জমির দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। হাইওয়ের দু’পাশে জমির দাম তিনগুণের বেশি হয়ে গেছে। সেতুর ওপারে চরে রিসোর্ট হতে যাচ্ছে। সরকারের উদ্যোগে বিরাট কনভেনশন সেন্টার, বিমানবন্দর ও অন্যান্য স্থাপনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
খুলনা ও বরিশালে জাহাজ শিল্প ছাড়াও পর্যটন শিল্প প্রসারের বিরাট সুযোগ তৈরি হবে। কুয়াকাটা এরই মধ্যে নুতন রূপে সাজতে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু সমাধিস্থল, ষাট গম্বুজ মসজিদ, সুন্দরবন, নড়াইলের সুলতান আর্ট কেন্দ্র ঢাকার ও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য দিন গুনছে।
দক্ষিণ বাংলায় আরও বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হবে। সেতুর ওপর দিয়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ইন্টারনেটে পাইপলাইন যাবে। ফলে অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি সুলভে ডিজিটাল সেবাভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং-এর প্রসার এবং হাইটেক পার্কের প্রসার ঘটবে। এরই মধ্যে যশোরে হাইটেক পার্ক চালু হয়ে গেছে। মাত্র চার-পাঁচ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে রেলে বা গাড়িতে কলকাতা পৌঁছে যাওয়া যাবে।
নেপাল, ভুটান ও ভারতের সাথে পায়রা ও মংলা বন্দরের সেবা এবং সড়ক ও রেল যোগাযোগের সুযোগে আঞ্চলিক বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণ বাংলার জিডিপি ৩.৫ শতাংশ হারে বাড়বে। আর জাতীয় জিডিপি বাড়বে ১.২৬ শতাংশ হারে।
আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধুর দেওয়া লড়াকু মনের জোরে সকল ষড়যন্ত্র কীভাবে ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন। আর দেশের সম্মান বাঁচাতে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করব।’
রেল চালু হলে আরও এক শতাংশ। বছরে দুই লাখের মতো তরুণের কর্মসংস্থান হবে। এই এলাকার দারিদ্র্য কমবে ১.০১ শতাংশ হারে। দেশের দারিদ্র্য কমবে বাড়তি ০.৮৪ শতাংশ হারে। সব মিলে এক বিশাল অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ।
তাই আসুন, পঁচিশে জুন দলমত নির্বিশেষ পুরো বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পদ্মা সেতু উদ্বোধনের উৎসবে অংশগ্রহণ করি। যারা বুঝে বা না বুঝে এর বিরোধিতা করেছেন তাদেরকেও আমন্ত্রণ জানাই আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির এই উজ্জ্বল মাইলফলকটি দর্শনের। স্বশরীরে কিংবা ভার্চুয়ালি।
আসুন, আমরা জয়ধ্বনি করি স্বদেশি উন্নয়নের এই সাফল্যে। রবীন্দ্রনাথ তার ‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আশা করিবার অধিকারই মানুষের শক্তিকে প্রবল করিয়া তোলে। ... আশা করিবার ক্ষেত্র বড় হলেই মানুষের শক্তিও বড় হইয়া বাড়িয়া ওঠে। ... কোনো সমাজ সকলের চেয়ে বড় জিনিস যাহা মানুষকে দিতে পারে তাহা সকলের চেয়ে বড় আশা।’ পদ্মা সেতু আমাদের সেই ‘বড় আশা’ করার ক্ষেত্রটিকে আরও উর্বর করে তুলবে।
ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক