সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন এবং বাস্তবের ফাঁক-ফাঁকি
১
ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের কবিতাকে আমূল বদলে দিয়েছিল। এই অর্থে ভাষা আন্দোলনের সাথে বাংলাদেশের কবিতার নাড়ির সম্পর্ক। আবার ভাষা আন্দোলন-কেন্দ্রিক এবং ভাষা আন্দোলনের প্রেরণাকে মনে করে বাংলা ভাষা বিষয়ক গল্প-কবিতা রচিত হয়েছে অজস্র। এদিক থেকেও ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের কবিতার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। মোদ্দা কথা, ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের কবিতাকে যতটা প্রভাবিত করেছে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাঙালির আর কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা এককভাবে এতো গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এটি ভাষা আন্দোলন আর বাংলা ভাষার প্রতি এই জাতির এক গভীর প্রীতির ফল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এখনো যেন কানে শুনতে পাই, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’! এ প্রসঙ্গে পরে আসা যাক, আগে দেখা যাক বাংলা কবিতার সাথে ভাষা আন্দোলনের সম্পর্কটা কেমন।
চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলন বাঙালি মুসলমানের মনে পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের যে স্বপ্নাঞ্জন মেখে দিয়েছিল তার চিহ্ন বহন করেছে ওই দশকের কবিতা। ব্যতিক্রম বাদে ওই দশকের প্রায় সব কবির কবিতাই তীব্রভাবে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী চেতনার আবেগে কম্পিত। এই সময়ের বাংলাদেশের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক-ঔপন্যাসিকেরা ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন পাকিস্তানি জ্বর ও ঘোর দিয়ে’। আজাদ ভুল কিছু বলেননি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত ধারাটিই ছিল বাংলা কাব্য-কবিতার প্রধান ধারা। তবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর এই ধারাটি ক্রমে ক্ষীণ হয়ে যায় এবং একসময় ধারাটির মৃত্যু হয়।
ভাষা আন্দোলনের ফলে পূর্ব বাংলায় যে নতুন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ হয় সেই চেতনা বায়ান্ন-পরবর্তী সাহিত্যের খোলনলচে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। বিশেষত কবিতার ভাষায় একটা আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, ‘একুশের আগে বাঙালি মুসলমানের ভাষা ছিলো অপরিস্রুত, অনেকটা পুঁথি সাহিত্যের ভাষা; ওই ভাষার অবিরল আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ জানিয়ে দিতো যে রচয়িতারা মুসলমান, পাকিস্তানি। বায়ান্নর পরে পরিস্রুত হয়ে উঠতে থাকে বাঙলা ভাষা, বিদায় নিতে থাকে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ এবং ষাটের দশকে বাঙলা ভাষা প্রায় বিশুদ্ধ বাংলায় পরিণত হয়। ... ভাষা আন্দোলন ভাষাকেই স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত করেছে বেশি।’ ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের কবিদের জীবন ভাবনায় এনেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা আর বুর্জেয়া মানবতাবাদ। ‘বায়ান্নর চেতনা বুকে জ্বালিয়ে’ বাংলাদেশের কবিতার পঞ্চাশের দশকের প্রজন্ম ‘অনেক বেশি আধুনিক’ হতে পেরেছিলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির চৈতন্যকে দারুণভাবে নাড়া দেয়া এক ইতিহাসের নাম। বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রথম স্থায়ীভাবে জাগ্রত করেছে এই ঘটনাটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘একুশের রক্তরাঙা পথ বেয়েই বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং স্বাধিকার চেতনা ধীরে ধীরে এক দুর্বার গতি লাভ করে।’ কবি সিকান্দার আবু জাফর তার এক কবিতায় ভাষা আন্দোলনকে বলেছেন, ‘একটি মহৎ জন-জাগৃতি’। ষাটের দশকের অবরুদ্ধ সময়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে এই ইতিহাসটি ছিল ইঞ্জিনের তেলের মতো। যখনই বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা সংকটের মধ্যে পড়েছে তখনই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে সে স্মরণ করেছে এবং উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে নতুন আলোয়, নতুন উদ্যমে। একারণে আমরা দেখি, ষাটের দশকে এসেও ভাষা আন্দোলনের সময়কার বাঙালি দামাল ছেলেদের আত্মদানের ইতিহাস কবিরা বারবার স্মরণ করেছেন।
যখনই বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা সংকটের মধ্যে পড়েছে তখনই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে সে স্মরণ করেছে এবং উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে নতুন আলোয়, নতুন উদ্যমে। একারণে আমরা দেখি, ষাটের দশকে এসেও ভাষা আন্দোলনের সময়কার বাঙালি দামাল ছেলেদের আত্মদানের ইতিহাস কবিরা বারবার স্মরণ করেছেন।
স্মরণের আবরণে বর্তমানে জাগতে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগাতে চেয়েছেন। কবিরা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন সেদিনের সেই একত্র হওয়াকে। ষাটের দশকে রচিত সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায় যেন একথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়− ‘দেশের মানুষ একটি দণ্ডে/একাত্ম হয়েছিল,/স্নায়ু গ্রন্থিতে পাঁজরে পেশীতে,/মেখে নিয়েছিল একটি অঙ্গীকার−/সেদিন প্রথম।/এবং প্রথম নতুন দিগ্বলয়ে/সঞ্চরমান এ-দেশের ইতিবৃত্ত।/চেতনার পথে দ্বিধাহীন অভিযাত্রা।/নানানমুখী হাজার লোকের/একত্র অস্তিত্ব/একুশে ফেব্রুয়ারী।’
২
ষাটের দশকের শুরু থেকে যত দিন গড়িয়েছে তত ভাষা আন্দোলনের চেতনা পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে বেশি তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ যত দিন গিয়েছে ততই ভাষা আন্দোলনের দ্রোহ আর শক্তির দিকটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। কবিরাও নিঃশঙ্ক হয়ে উঠেছেন ভাষা আন্দোলনের দ্রোহ মূর্তির রূপাঙ্কনে। আল মাহমুদের কালের কলস কাব্যের ‘নিদ্রিতা মায়ের নাম’ কবিতায় এমনটিই লক্ষ করা যায়− ‘তাড়িত দুঃখের মতো চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল/রক্তাক্ত বন্ধুদের মুখ, উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে/তীরের ফলার মত/নিক্ষিপ্ত ভাষার চিৎকার:/বাঙলা, বাঙলা-।’ এভাবে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের রাজনৈতিক অবরুদ্ধতার মধ্যে ভাষা আন্দোলন কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে এবং বাঙালিকে সংগ্রামের প্রেরণা দিয়েছে এসব কবিতা।
শামসুর রাহমান একারণেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে স্মরণ করে জাগাতে চেয়েছেন বাঙালিকে- ‘বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও/আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,/বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।/সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা,/সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।/দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই/জনসাধারণ/দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো/ঝরে অবিনাশী বর্ণমালা/আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে/এখনও বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে/ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে/হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায়। সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ,/শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায়।’ শুধু ভাষা আন্দোলন নয় বাংলা ভাষার প্রতি গাঢ় ভালোবাসা প্রকাশ করে কবিরা সেই ষাটের উত্তাল সময়ে বাঙালি জাতীয়তা বোধকে জাগিয়ে রেখেছেন। ফজল শাহাবুদ্দীনের একটি কবিতায় দেখি বাংলার প্রতি সেই ভালোবাসার আকুতি- ‘হে আমার বাংলা ভাষা, মা আমার/তুমি চিরকাল এমনি ক’রে বেঁচে থাকবে মৃত্যুঞ্জয়ী ধ্বনিতে/জীবনের মতো চিরকালের কবিতায়/আমরা তোমাকে যুগে যুগে রক্ষা করবো/বরকতের মতো, সালামের মতো তাজা রক্তের প্লাবনে।’
শুধু পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে নয়, অদ্যাবধি ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষা আর ভাষা আন্দোলনের অন্তর্গত চৈতন্য নিয়ে লেখা হয়ে চলেছে অজস্র কবিতা। বায়ান্ন আর বাংলা ভাষা নিয়ে লেখেননি এমন গুরুত্বপূর্ণ কবি বোধ করি বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে মেলা ভার। মানুষ যখনই অগণতান্ত্রিকতা আর অন্যায্যতার শিকার হয় তখন কবিকে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি নিয়ে লিখতেই হয়। ভাষা আন্দোলন শুধু কবি-সাহিত্যিক নন, সমগ্র বাঙালির একটা দাঁড়ানোর জায়গা। এজন্যই বোধ করি ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে বাঙালি জড়ো হয় শহীদ মিনারে।
বাংলা ভাষা অধিকাংশ মানুষের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও মূলত গরিব মানুষের ভাষা হওয়ার অপরাধে পাকিস্তানিরা সেদিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে চায়নি। এই অগণতান্ত্রিক আর বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আত্মাহুতি দিয়েই বাঙালি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করেছিল। এই ভাষার নামেই সংগ্রাম করে বাঙালি প্রতিষ্ঠা করলো বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত কবিতা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছে এবং আজো জুগিয়ে চলেছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন তোলা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে, ভাষা আন্দোলন নিয়ে এত কাব্য-কবিতা-কাসিদা তার কী মানে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্র পর্যায়ে। একটু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের গর্বকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা নিয়ে যে-পরিমাণ উৎসাহ, আবেগ, গর্ব, মাহাত্ম্য আর শ্লাঘা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা কিন্তু সেই গর্ব, মাহাত্ম্য, শ্লাঘা অর্জন করতে পারেনি। বাংলা ভাষা অধিকাংশ মানুষের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও মূলত গরিব মানুষের ভাষা হওয়ার অপরাধে পাকিস্তানিরা সেদিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে চায়নি। এই অগণতান্ত্রিক আর বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আত্মাহুতি দিয়েই বাঙালি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করেছিল। এই ভাষার নামেই সংগ্রাম করে বাঙালি প্রতিষ্ঠা করলো বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বাংলা এখানে দিনদিন হয়ে উঠল প্রায় দ্বিতীয় ভাষা। বাংলা সাধারণ মানুষের ভাষা হয়েই যেন রইল। জাতে ওঠা যেন আর তার হলো না। বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতি দেখলে সহজেই বিষয়টা বোঝা যাবে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার গায়ে আভিজাত্যের তকমা আজ লাগেনি। টাকাওয়ালা কোনো বড় লোকই এখন আর তার সন্তানদের বাংলা মিডিয়ামে পড়ান না। উচ্চশিক্ষা, উচ্চ-আদালত, উচ্চতর গবেষণা কোথাও বাংলা নেই। বাংলা আছে মূলত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির খোলসের মধ্যে আর কবিতার নিষ্পাপ মর্সিয়ায়। হায়! রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানের যেন শেষ নেই!
৩
মাতৃভাষার মর্যাদার সাথে জাতীয় মর্যাদাবোধের গভীর সম্পর্ক আছে। যতদিন আমরা আমাদের এই মাতৃভাষাটিকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রের সকল কাজে অনিবার্য করে তুলতে না পারছি, আভিজাত্য বোধের সাথে যুক্ত করতে না পারছি, ততদিন ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের প্রতি ফেব্রুয়ারি এবং অন্য সময়ের আবেগ, উচ্ছ্বাস আর শ্লাঘাকে অন্তঃসারশূন্য ও মেকি বলেই মনে হবে। কিন্তু আসলে তো জনগণের তরফ থেকে তা কিছুতেই মেকি নয়। তাহলে কে এগিয়ে আসবে এগুলোকে অর্থবহ করার জন্য? আমাদের বক্তব্য খুব স্পষ্ট- রাষ্ট্র, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিলেই বাংলা ভাষার দুঃখ ঘুঁচবে। রাষ্ট্র এগিয়ে আসলেই অর্থবহ হয়ে উঠবে ভাষা আন্দোলন থেকে অদ্যাবধি রচিত সব কাব্য-কবিতা। রাষ্ট্র এগিয়ে আসলেই ইতি হবে এই স্লোগানের, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’!
ড. কুদরত-ই-হুদা ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক