রাষ্ট্রভাষা: বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
১
যত শাসন পদ্ধতি আছে পৃথিবীতে, যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও গণতন্ত্র এখনও পর্যন্ত সর্বোত্তম। ‘যাহা চাই, তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না!’ - গণতন্ত্র এমন কোনো সোনার হরিণ নয়। ভাগ্য-স্বভাব-চেষ্টা- মানুষের ভালো থাকার, এগিয়ে যাবার তিন নিয়ামক। গণতন্ত্র জিনিষটা ভুল করে মানুষ যে চায় না, তা নয়, কপাল কিংবা স্বভাব দোষে এবং চেষ্টার অভাবে পায় না। গণতন্ত্রের অভাবে কিংবা গণতন্ত্রের নামে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে চলে গোষ্ঠী তন্ত্র। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতেই থাকে দেশের সর্বময় ক্ষমতা। যেকোনো দেশের মতো বাংলাদেশের ক্ষমতাবান গোষ্ঠীও চায়, নিজেরা গত হবার পর বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতা তাদের উত্তরাধিকারীদেরই হাতেই থাকুক।
কোন ভাষাটি রাষ্ট্রভাষা হবে, বাংলা নাকি ইংরেজি, উর্দু নাকি বাংলা - এটি একটি রাজনৈতিক ও আর্থ-রাজনৈতিক প্রশ্ন। রাজনীতি কী? কেক ছোট, খানেওয়ালা বেশি। কৌশলে কেকের বেশিটুকু আমি কিংবা আমার গোষ্ঠীর সদস্যদের পেটে নেবার উপায় হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র ভাষা। মাতৃভাষা যদি শিক্ষার মাধ্যম না হয়, তবে শতভাগ আমজনতা সহজে শিক্ষিত হতে পারবে না। সর্বজনীন অশিক্ষা জারি থাকলে প্রশ্ন হবে কম। গোষ্ঠী তন্ত্রের অন্যতম শত্রু এই প্রশ্ন।
বাংলাদেশের ক্ষমতাবান গোষ্ঠী চায়, অতীতেও চেয়েছে, একটি বিজাতীয় ভাষায় রাষ্ট্রের সব কাজ চলুক। দূর অতীতে রাষ্ট্রভাষা ছিল সংস্কৃত, মধ্যযুগে ছিল ফার্সি, ঔপনিবেশিক যুগে ছিল ইংরেজি এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও জারি রয়েছে ইংরেজি। শিক্ষার মাধ্যম, বিচারের মাধ্যম, প্রশাসনিক কাজকর্মের মাধ্যম ইংরেজি হলে আম জনতা ক্ষমতার ভাগ নিতে পারবে না। শিক্ষিত হতে না পারলে জনগণের সন্তানেরা বিচারক, আমলা, শিক্ষক, সৈনিকও হতে পারবে না, যার ফলে ক্ষমতার বাতাবরণ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে তারা। শাসিত হবে, শাসন করতে পারবে না, জানবে না।
জাতিরাষ্ট্রের তিনটি উপাদান: বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ও আইন প্রণয়ন বিভাগ। বাংলাদেশে এই তিনটি বিভাগের কাজের মাধ্যম ইংরেজি। ইংরেজি যারা জানে না, তারা এই তিন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে না এবং ক্ষমতাও তাদের অধরা থেকে যায়। ক্ষমতা যাদের হাতে, নিজেদের ছেলেমেয়েদের তারা ইংরেজি শেখায়, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ায়, যাতে বিভাষায় লায়েক হয়ে তারা ক্ষমতা দখলে রাখতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাবানেরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যম বাধ্যতামূলক করছে কেন? ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় স্থাপন করছে কেন? বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের সকল স্তরে ইংরেজি মাধ্যম চালু করছে কেন? তারা ভালো করেই জানে যে বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নেই, ইংরেজি শেখানোর মতো শিক্ষক বাংলাদেশে বিরল হয়ে উঠছে দিনকে দিন, শিক্ষার সকল স্তরে। শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিও শিখবে না, বিজ্ঞান-কলা-বাণিজ্য বিষয়েও তাদের অধিকার জন্মাবে না। কোনোরকম পাশ করে যারা বের হবে, তারা হবে অর্ধ জ্ঞানী, অর্ধ ভাষী। তাদের একেকটি ‘পাশ’ হবে একেকটি ‘পাশ’, সংস্কৃতে যার অর্থ ‘দড়ি’। সেই সব দড়িতে নিজেদেরকে এবং সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার বাঁধনে বাঁধবে তারা।
ক্ষমতাবানেরা চায়, নিজেদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গিয়ে পূর্ণ জ্ঞানী না হোক, ইংরেজি ভাষাটা অন্তত শিখে লেফাফা দুরস্ত হয়ে ফিরে আসুক। আমেরিকান এ্যাকসেন্টে ইংরেজিতে দুরস্ত হলে লেফাফা খুলে কে দেখতে চাইবে, ঘটে আদৌ কিছু আছে কিনা? এতে কাজ যে হচ্ছে না, তার জ্বলন্ত প্রমাণ আছে হাতের কাছেই। বাংলাদেশে কর্পোরেট জগতের উচ্চপদে বাঙালিদের নয়, বিদেশিদের প্রাধান্য। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া, বিদেশ থেকে ফেরা ছেলেমেয়েরা কেন বড় বড় চাকরিগুলো পাচ্ছে না?
রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র ভাষা। মাতৃভাষা যদি শিক্ষার মাধ্যম না হয়, তবে শতভাগ আমজনতা সহজে শিক্ষিত হতে পারবে না। সর্বজনীন অশিক্ষা জারি থাকলে প্রশ্ন হবে কম। গোষ্ঠী তন্ত্রের অন্যতম শত্রু এই প্রশ্ন। ... যে ভাষা শিক্ষার মাধ্যম, সে ভাষাই কাজের ভাষা, রাষ্ট্রভাষা। বাংলা যেহেতু বাংলাদেশে শিক্ষার সর্বজনীন মাধ্যম নয়, কাজে-কর্মে বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষাও নয়।
ইংরেজি মাধ্যম চালু করলে অতিরিক্ত একটা লাভও আছে। শাসকের ছেলের মতো উন্নতি করার লোভে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সন্তানেরা এসে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায়তনে ভর্তি হবে। ইংরেজিতো তারা শিখবেই না, বাংলাও ভুলে যাবে। মাঝখান থেকে আমজনতার পকেট কেটে ফোকটে টুপাইস ইনকাম করাও সম্ভব। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা পদ্ধতি শাঁখের করাতের মতো, দুই দিকেই কাটে, তবে ক্ষতিটা দুই দিকেই হয় জনগণের এবং পরিণামে রাষ্ট্রের।
ইংরেজি ভাষা শিক্ষা আর ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করা দুটি ভিন্ন সিদ্ধান্ত। ইংরেজি শিখতেই হবে, কিন্তু ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করলে পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। যে ভাষা শিক্ষার মাধ্যম নয়, সে ভাষা বিচারের মাধ্যম, শাসনের মাধ্যম হতেই পারে না। শিক্ষাই জীবনের শিকড়। শিকড় শক্ত হলেই শুধু শিখরে ওঠা সম্ভব। আজকের শিক্ষার্থী আগামী দিনের শিক্ষক, বিচারক, প্রশাসক। যে ভাষা শিক্ষার মাধ্যম, সে ভাষাই কাজের ভাষা, রাষ্ট্রভাষা। বাংলা যেহেতু বাংলাদেশে শিক্ষার সর্বজনীন মাধ্যম নয়, কাজে-কর্মে বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষাও নয়।
২
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা ধনুকভাঙা পণ করেছে, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই দেশের উন্নয়ন করতে হবে। বইপত্র সব ইংরেজি ভাষায় লেখা, ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা, ভিন্ন একটি ভাষা শেখায় কী সমস্যা ইত্যাদি সব কু-যুক্তি। বইপত্র কেন আমরা অনুবাদ করি না বাংলায়? চীন-জার্মানি-জাপান কেন ইংরেজিকে শিক্ষার, বিচারের, প্রশাসনের মাধ্যম করে না? ইংরেজি তাদের জন্যেও আন্তর্জাতিক ভাষা বটে। এসব শুনে শাসক দলের উত্তর: আমরা চীন-জাপান-জার্মানি নই। আমাদের দেশ গরিব। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে যে আর্থিক সামর্থ্যরে প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। গরিব বলে আমরা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করতে পারছি না, নাকি শিক্ষার মাধ্যম বাংলা নয় বলে আমরা দিনকে দিন অশিক্ষিত এবং পরিণামে গরিব হচ্ছি?
ইংরেজিকে চিরদিন শিক্ষার মাধ্যম করে রাখা যাবে না, কারণ বেশির ভাগ বাঙালি ইংরেজি শিখে উঠতে পারবে না। ত্রিশ কোটি বাঙালির মধ্যে ত্রিশ হাজার জন ঠিকঠাক মতো ইংরেজি বলতে-লিখতে-বুঝতে পারে কিনা সন্দেহ। ইংরেজি শিখেছে ভেবে যারা আহ্লাদে গদগদ- হয়, তাদের ইংরেজিও দুর্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজ নিজ বিষয়ের পাঠ্যবই কি ইংরেজি বা অন্য ভাষা থেকে বাংলা অনুবাদে সক্ষম? প্রমাণতো পাইনি। কীভাবে বিশ্বাস করি, তারা ইংরেজি জানেন কিংবা নিজেদের বিষয়টুকু ঠিকঠাক মতো জানেন? শিক্ষকদের ইংরেজি দুর্বল বলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজিও দুর্বল হতে থাকে।
একটি দেশের আপামর জনগণকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য একটি ভাষায় পারদর্শী করে তোলা অসম্ভব। এর পূর্ব নজির রয়েছে। মধ্যযুগে ল্যাটিনকে ইউরোপের সর্বজনীন শিক্ষার মাধ্যম করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এর পরে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ইত্যাদি ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হয়েছিল এবং ঠিক তার পর থেকেই সেই সব ভাষা ও ভাষাভাষী জাতির উন্নতি হয়েছে। এর আগে বহু শতাব্দী ধরে ইংরেজিকে মনে করা হতো ছোট লোকের ভাষা, ঠিক বাংলার মতোই। বাংলাদেশেও আগে পরে বাংলাকেই শিক্ষা, বিচার ও প্রশাসন পরিচালনার মাধ্যম করতেই হবে, যেহেতু বাংলা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যত দেরিতে নেয়া হবে, বাঙালি জাতির উন্নয়নও ততই পিছিয়ে যাবে।
একটি ভাষার চার ধরনের প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা যেতে পারে। সামাজিক প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা। ইংরেজি ভাষার সব রকম প্রতিষ্ঠা রয়েছে। চট্টগ্রামে উপ বাংলা কিংবা গারো ভাষার একটি প্রতিষ্ঠানও নেই। বাংলারও সামাজিক প্রতিষ্ঠা ছিল না এককালে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জিত হয়েছে ১৯৫২ সালে, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা এখনও বাকি। একটি ভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা থাকার মানে হচ্ছে, ভাষাটি কোনো একটি দেশে কাজে-কর্মে রাষ্ট্রভাষা হওয়া। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা না থাকলে যেকোনো ভাষা মরণাপন্ন হয়ে পড়ে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে চট্টগ্রামের বাংলা কিংবা গারো ভাষার মৃত্যু শঙ্কা প্রমিত বাংলার চেয়ে বেশি। প্রমিত বাংলাকে দীর্ঘজীবী করতে হলে বা উপভাষাটির মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে হলে ভাষাটিকে সর্বস্তরে ব্যবহার করতে হবে। যে ভাষাটি সর্বস্তরে ব্যবহৃত হয় সেটিই রাষ্ট্রভাষা।
বাংলা ভাষাটি যত সহজে আমরা বুঝি, বলতে পারি, লিখতে পারি, পড়তে পারি, অন্য কোনো ভাষা সেভাবে পারি না। অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় অতটা গভীর নয়। ভাষাকে মানুষ ভালোবাসে, ভাষার স্বার্থে নয়, একান্তই নিজের স্বার্থে।
ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ভাষার আবহ: সংস্কৃতি, স্থান, কাল, পাত্র। ইংরেজি ভাষার আবহে আমি বড় হয়ে উঠিনি। বাঙালি কবি কণ্ঠে ‘বিনা স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা!’ কিংবা ‘আ মরি বাংলা ভাষা!’ ধ্বনিত হবার কারণ, এই ভাষাটি যত সহজে আমরা বুঝি, বলতে পারি, লিখতে পারি, পড়তে পারি, অন্য কোনো ভাষা সেভাবে পারি না। অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় অতটা গভীর নয়। ভাষাকে মানুষ ভালোবাসে, ভাষার স্বার্থে নয়, একান্তই নিজের স্বার্থে।
৩
বাংলাকে কাজেকর্মে রাষ্ট্রভাষা করার উপায় কী? বাংলাদেশের সংবিধান কিংবা ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইনের যাবতীয় খেলাফ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই শাস্তির প্রয়োগ হলে বাংলা ডি ফ্যাক্টও রাষ্ট্রভাষা হতে এক দশকও লাগবে না। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষায় পাঠদান হবে না, যে প্রতিষ্ঠানে বাংলার ব্যবহার হবে না, সাইনবোর্ডে বাংলার প্রাধান্য থাকবে না, সেগুলোকে বড় অংকের জরিমানা করতে হবে। এসব বিষয় তদারকির জন্যে একটি ভাষা কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে নির্বাচন কমিশনের মতো। প্রয়োজন হবে ভাষা-পুলিশের। কানাডার ভাষা আইন ১০১ এর আদলে একটি বাংলা-ভাষা প্রচলন আইন জারি করে কাজ শুরু করে দেয়া যেতে পারে।
বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? ইঁদুরেরা গা করে না, কারণ উন্নয়নে ভাষার ভূমিকা তারা জানে না, বোঝে না, বুঝতে চায় না। সাত দশক আগে তাদের পূর্ব পুরুষেরা পাকিস্তানি মার্জারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে প্রাথমিক কিছু সাফল্য পেয়েছিল। প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসে সে ঘটনার স্মৃতিতে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করাকেই ইঁদুরেরা যথেষ্ট মনে করে।
শিশির ভট্টাচার্য্য ।। অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়