দুঃখী মানুষের বাজেটের সন্ধানে
জাতীয় বাজেট যেমন পুরো অর্থনীতির সার্বিক ব্যবস্থাপনার একটি বার্ষিক পরিকল্পনা, তেমনি একটি মনস্তাত্ত্বিক দলিলও বটে। সব ধরনের বিনিয়োগকারী, দেশি ছোট-বড় উদ্যোক্তা, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী থেকে শুরু করে একেবারে মাঠ-পর্যায়ের সাধারণ মানুষও তাকিয়ে থাকেন বাজেট প্রস্তাবের দিকে।
সরকারের বাজেট প্রস্তাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তারা অর্থবছরের পরিকল্পনা সাজান। সরকারেরও লক্ষ্য থাকে নাগরিকদের আর্থসামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে অর্থনীতির চাকাকে আরও বেগবান করার সময়োচিত নির্দেশনা ও পরিকল্পনাগুলোকে বাজেট ডকুমেন্টসের মাধ্যমে সকলের সামনে হাজির করার।
স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিকৌশলের প্রকাশ ঘটে বাজেটে। সেই বিচারে ২০২২-২৩ সালের প্রস্তাবিত বাজেট বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। কারণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান যখন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে সেই সময়েই এই বাজেট প্রস্তাবিত হয়েছে।
বিশেষ করে করোনা যাদের জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করেছে এবং বর্তমানের ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্য যেসব প্রান্তজন তথা দুঃখী মানুষের জীবনচলা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে তাদের জন্য বাজেট কী ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে এই নিবন্ধে আমরা তা জানার চেষ্টা করছি।
প্রাথমিকভাবে বলা যায় যে, বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল থেকেই আসন্ন অর্থবছরের বাজেট তৈরি করা হয়েছে। এই সময়ের প্রধানতম সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাহিদা হলো, আমদানি-নির্ভরতা কমানো তথা বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা। এই জন্যই জিডিপির শতাংশ হিসেবে চলতি অর্থবছর থেকে আসন্ন অর্থবছরে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার কমেছে। আরও অনেক জায়গাতেই তুলনামূলক কম ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে।
তবে এর মধ্যেও জিডিপির শতাংশ হিসেবে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সার ইত্যাদিতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ ১.৭ থেকে ১.৯ শতাংশে বাড়ানো হয়েছে। অন্যত্র কাটছাঁট করলেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও সারের মূল্য যেভাবে দ্রুত বেড়ে চলেছে তার প্রভাব থেকে দেশের সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেবে বাজেটের এই প্রস্তাবনা।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, দরকার হলে এই ভর্তুকি ও প্রণোদনার পরিমাণ আরও খানিকটা বাড়ানোর পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে। ফলে সরকারের ব্যয় পরিকল্পনায় বিশ্ব সংকট থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয় যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে বলেই মনে হয়।
কৃষিই যে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষাকবচ সেটা সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতিতে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। তাই চলতি অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকি প্রথমে ১০ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব...
তবে জ্বালানি ও সারের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সাথে সমন্বয় করার কথা শোনা যাচ্ছে। এই সমন্বয় অন্তত আসন্ন অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে না করলেই ভালো হয়। তাহলে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ বৃদ্ধির যথাযথ সুফল মানুষের কাছে পৌঁছাবে। বিশেষ করে মুদ্রার বিনিময় হার সুস্থির হওয়ার পর তা করলে জনগণের ওপর কিছুটা হলেও চাপ কমবে।
দ্বিতীয়ত, বলা যায় কৃষিতে ভর্তুকির কথা। কৃষিই যে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষাকবচ সেটা সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতিতে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। তাই চলতি অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকি প্রথমে ১০ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়েছে। আর আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে তা প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
কৃষিতে ভর্তুকি ৬০ শতাংশ বাড়ানোর ফলে কেবল গ্রামীণ কৃষি-নির্ভর পরিবারগুলো বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি থেকে সুরক্ষা পাবেন এমন নয়। তাদের আয় সুরক্ষিত থাকা মানে দেশের অভ্যন্তরে চাহিদা সচল থাকা। ফলে তাদের চাহিদাগুলো মেটানোর সাথে অ-কৃষি খাতের যারা যুক্ত আছেন তারাও এই ভর্তুকির উপকারভোগী হবেন।
তবে আমার মনে হয়, কৃষিতে ভর্তুকি যদি আরও বাড়িয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা করা যেত তাহলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও সারের মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে দেশের কৃষির জন্য আরও শক্তিশালী সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো। ফল-সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণে ১০ বছরের ট্যাক্স ব্রেক, মাছ চাষে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কর ছাড় এবং হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাবার তৈরির উপকরণে দেওয়া কর ছাড়ও কৃষিকে দুর্যোগকালে বেগবান রাখতে সহায়ক হবে।
আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে এখন দেশের অনেক মানুষ কৃষি ছাড়াও শিল্প ও সেবা খাতে যুক্ত আছেন। এই খাতগুলোকেও তাই সুরক্ষা দেওয়া জরুরি। সেই বিবেচনাতেই কর্পোরেট কর হার কমানো হয়েছে। এক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি এবং ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের যে শর্তগুলো জুড়ে দেওয়া হয়েছে তা পালন করার পরই কিন্তু কোম্পানিগুলো এই কর ছাড় পাবে।
পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণ বাড়লে এবং সকল লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে হলে দুর্যোগকালেও সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত মজবুত থাকবে। এছাড়াও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জিএসপি সুবিধা শেষ হয়ে গেলে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী কোম্পানি বাড়তি সুবিধা না পেলে তারা চলে যেতে চাইবে। তাদের ধরে রাখার জন্যও এই কর ছাড় নতুন প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে।
বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা গেলে কর্মসংস্থান নিশ্চয় বাড়বে। ফলে এই কর ছাড়কে ‘কেবল ব্যবসায়ীদের দেওয়া সুবিধা’ ভাবার সুযোগ নেই। এগুলো বাস্তবায়িত করা গেল পুরো অর্থনীতি গতিশীল থাকবে, তাতে কর্মজীবীসহ সকলেরই মঙ্গল।
সময়োচিত আরও কিছু কর প্রস্তাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে যেগুলো নতুন উদ্যোক্তা এবং তুলনামূলক ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক হবে। যেমন আগামী অর্থবছর থেকে পোশাক খাতের মতো অন্যান্য রপ্তানিকারকেরাও ১২ শতাংশ কর্পোরেট কর দেবেন। তাদের কারখানাগুলো পরিবেশবান্ধব হলে এই হার আরও কমে হবে ১০ শতাংশ। এতে রপ্তানিকারকেরা উৎসাহিত হবেন, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও বাড়বে। স্টার্টআপ কোম্পানির টার্নওভার কর ০.৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.১ শতাংশ করা হয়েছে। আইসিটি উদ্যোক্তাদের জন্য এটি বিশেষ উৎসাহ জোগাবে।
করোনা-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের বিবেচনায় আগের তুলনায় এই দুটি খাতে বরাদ্দের অনুপাত যতটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছিল ততটা বাড়েনি। তবে মূল্যস্ফীতির বাজারে বাজেটের শতাংশ হিসাবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ ১৯ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশ যাওয়া অনেককেই অবাক করেছে।
সার্বিক বিবেচনায় কর প্রস্তাবনাকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য সহায়কই বলতে হবে। তবে মনে হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা—এই সামাজিক খাতগুলোতে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটু সাহসী হওয়া যেত। কিছুটা সংকোচনমুখী এই বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে তেমন কাটছাঁট নজরে পড়ছে না।
তবে করোনা-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের বিবেচনায় আগের তুলনায় এই দুটি খাতে বরাদ্দের অনুপাত যতটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছিল ততটা বাড়েনি। তবে মূল্যস্ফীতির বাজারে বাজেটের শতাংশ হিসাবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ ১৯ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশ যাওয়া অনেককেই অবাক করেছে।
বিশেষ করে ওএমএস কর্মসূচি এবং অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচির বরাদ্দ কমে যাওয়া এই সময়ের প্রেক্ষাপটে অসামঞ্জস্যকর মনে হয়েছে। অতিদরিদ্রদের কাছে ১০ টাকা কেজি দরে মাসে যে ৩০ কেজি চাল বিক্রি করা হচ্ছিল তার দামও কেজি প্রতি ১৫ টাকা করা হয়েছে।
খাদ্যমূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয়ের জন্যই হয়তো এমন করা হয়েছে। এই সমন্বয় এই সময় না করাই মনে হয় ভালো হতো। এসব খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির আলোচনায় বাড়তি বরাদ্দের জন্য বাড়তি অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে-এই প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু কিছু জায়গায় বরাদ্দ আরেকটু কমানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যেমন, জিডিপির ৯ শতাংশ পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে। একইভাবে বাজেটের ১২ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে।
সরকার পরিচালনায় আরেকটু কৃচ্ছ্রতা সাধন করে পরিচালন ব্যয় কমানো সম্ভব। আবার এখনই খুব জরুরি নয় এমন পরিবহন প্রকল্পগুলোতে কম বরাদ্দ দিয়ে বা আদৌ বরাদ্দ না দিয়েও কিছু অর্থ সাশ্রয় করা যেত। এই অর্থ তখন সামাজিক খাতগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া যেত। পরিবহন যাত্রীদেরও ভাড়ায় আরেকটু ভর্তুকি দেওয়া যেত।
আরও লক্ষ্য করতে হবে যে, চলতি বছরের মতো আসন্ন অর্থবছরেও আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। সমতুল্য অন্য অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে তুলনা করে বলা যায় যে, এই অনুপাত অন্তত ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য বাড়তি বরাদ্দের ব্যবস্থা করা সম্ভব। বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতার আওতা বেড়েছে। কিন্তু পরিমাণও বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। আজকাল পাঁচশ টাকায় কী মেলে?
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাতেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশে ৪ কোটি মধ্যবিত্ত বা তদূর্ধ্ব আয়ের নাগরিক আছেন তাদের মধ্যে মাত্রা ৭৫ লক্ষের টিআইএন আছে। এই সংখ্যা আসছে বছরে ১ কোটি নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আমার মনে হয়, এনবিআর-এর সক্ষমতা বাড়ানো গেলে এই সংখ্যা এক বছরেরর মধ্যে ২ কোটিতেও নেওয়া যায়। তখন কর-জিডিপি অনুপাতও বাড়ানো যাবে।
এনবিআর-এর ডিজিটাইজেশন এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কার করেই তা করা সম্ভব। আসছে অর্থবছরেই এই উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তাতে সরকারের আয় বাড়বে। ফলে সামাজিক খাতে বরাদ্দ দেওয়ার মতো অর্থও বাড়বে।
সর্বোপরি আমি মনে করি যে, আমাদের বাজেট ঘাটতি ৫.৪ শতাংশ থেকে আরও ১ শতাংশ বাড়ানো যেত। এভাবেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য বাড়তি বরাদ্দের ব্যবস্থা করা সম্ভব। বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতার আওতা বেড়েছে। কিন্তু পরিমাণও বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
আজকাল পাঁচশ টাকায় কী মেলে? অবশ্যই উচ্চ সুদের বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়া ঠিক হবে না। বরং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে কম সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়াই লক্ষ্য হওয়া উচিত। বৈদেশিক দেনা পরিশোধে আমাদের ইতিবাচক ট্র্যাক রেকর্ডের কারণে এমন ঋণ পাওয়া খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। এজন্য ‘স্মার্ট ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি’ খুব দরকার।
এই কথা বলা যায় যে, বাজেট ২০২২-২৩-এর প্রস্তুতিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে সকল স্তরের নাগরিকের জীবনমানের সুরক্ষার প্রশ্নের প্রতি আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা সংবেদনশীল থাকার চেষ্টা করেছেন। একইসঙ্গে এটাও মানতে হবে যে, অনেক ক্ষেত্রেই আরও ভালো করার সুযোগ ছিল।
সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা চলছে। সংসদের বাইরেও নাগরিক সংগঠন এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ/দাবি আসছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা একটি গণমুখী ও সময়োপযোগী বাজেটই চূড়ান্ত করবেন বলে আমার বিশ্বাস। যাদের আয় কমে গেছে তাদের জন্য বাজেট আরও একটু সদয় হবে সেই প্রত্যাশাই করছি।
ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর