বাবা দিবস কেন গুরুত্বপূর্ণ?
‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে
বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না
জানালার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা
মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না
আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়...’
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া এই গান সন্তানদের অসীম নস্টালজিয়ায় ডুবিয়ে দেয়। বাবা সন্তানের মাথার উপর স্নেহের ছায়া বটবৃক্ষের মতো, সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে পারেন। বাবার তুলনা বাবা নিজেই।
বাবা ঠিক মায়ের মতো নয়। একটু দূরের, কঠিন চেহারা, ঘরের বাইরে থাকেন বেশি সময়, অত সহজে হাসেন না। এই বাবাকেই কোনো-না-কোনো সময় ঠিক চিনে ফেলে সন্তান। বাইরে তিনি যত কঠিন ভেতরে ততটাই কোমল। ভরসা ও ছায়ার নাম বাবা। পরম নির্ভরতার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য নিজের বর্তমানকে হাসিমুখে উৎসর্গ করা এই বাবাদের আজ আলাদাভাবে স্মরণ করার দিন।
প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার এই দিবস উদযাপন করা হয়। সেই হিসেবে ১৯ জুন রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস। পৃথিবীর অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবস উদযাপিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাবা দিবস পালন শুরু হয়। আসলে মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও যে তাদের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল এটা বোঝানোর জন্যই এই দিবস পালন করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর সব বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছে থেকে যার শুরু।
ধারণা করা হয়, ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই আমেরিকার পশ্চিম ভার্জেনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় বাবা দিবস প্রথম পালিত হয়। আবার সনোরা স্মার্ট ডড নামের ওয়াশিংটনের এক ভদ্রমহিলার মাথাতেও বাবা দিবসের আইডিয়া আসে।
ডড এই আইডিয়া পান গির্জার এক পুরোহিতের বক্তব্য থেকে, সেই পুরোহিত আবার মা’কে নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলছিলেন। তখন তার মনে হয়, তার বাবাদের নিয়েও তো কিছু করা দরকার। ডড তার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই ১৯ জুন, ১৯১০ সাল থেকে বাবা দিবস পালন করা শুরু করেন।
আসলে মা দিবস নিয়ে মানুষ যতটা উৎসাহ দেখাতো, বাবা দিবসে মোটেও তেমনটা দেখাতো না। বরং বাবা দিবসের বিষয়টি তাদের কাছে বেশ হাস্যকর ছিল। ধীরে ধীরে অবস্থা পাল্টায়, ১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে বাবা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করা হয়।
১৯২৪ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ (Calvin Coolidge) বিলে পূর্ণ সমর্থন দেন। অবশেষে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন বাবা দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
বাবা দিবসের আনুষ্ঠানিক আইনগত স্বীকৃতি পেতে অনেক বছর লেগেছে এবং এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ঘটেছে। হিস্ট্রি ডটকমে উল্লেখ আছে, ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দিকে মা দিবস ও বাবা দিবসের বিলুপ্তি ঘটাতে এবং এর পরিবর্তে কেবলমাত্র পিতামাতা দিবসের প্রচলন করতে যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় আন্দোলন হয়। কিন্তু এসব আন্দোলন সফল হয়নি। কিছু পুরুষ শুরু থেকেই বাবা দিবসের বিরোধী ছিলেন। কেউ কেউ এই দিবসের প্রচলনকে বাণিজ্যিক আয় বাড়ানোর কৌশল হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারো কারো মতে, এই দিবস সমাজে পুরুষদেরকে হেয় করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
হ্যাঁ, প্রতিদিনই বাবার জন্য ভালোবাসা। তবে আজ বিশেষ দিবস। মুখ ফুটে ভালোবাসি বলার দিন। আজ বাবাকে নিয়ে কেক কাটা হবে, ফুল, নতুন জামা, প্রিয় বই উপহার দেওয়া হবে বাবাকে।
আজ যারা নিজেরাও বাবা হয়েছেন তারা ফিরে যাবেন শৈশবে। পুরোনো স্মৃতি থেকে নতুন করে আবিষ্কার করবেন বাবাকে। অনেকে প্রয়াত বাবার কথা ভেবে নীরবে মুখ মুছবেন। নিজের প্রিয় সন্তানকে বুকে টেনে নিয়ে কষ্ট ভোলার চেষ্টা করবেন কেউ কেউ।
আজ ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে ফিরেই আসবেন বাবা। পিতার ছবি খুঁজে নিয়ে পোস্ট করবেন সন্তান। নিজের ভেতরে বাবাকে নিয়ে আবেগ লিখে তা প্রকাশ করার চেষ্টা করবেন।
বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহারগুলোর নিঃসন্দেহে একটি। সন্তানের সকল বায়নাই মায়ের কাছে। এটা চাই, ওটা দাও। মা এসব আবেদন নিবেদন শোনেন। আর বাস্তবায়ন করেন বাবা। দিন-রাত পরিশ্রম, খাটুনির সামান্যও নিজের জন্য নয়। বরং সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর সব চেষ্টাই করেন তিনি।
‘পিতা স্বর্গ পিতা ধর্মঃ পিত্য হি পরমং তপঃ পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা’—হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই মন্ত্র জপে বাবাকে দেবতা জ্ঞান করে শ্রদ্ধা করেন। কোরআনে পিতা-মাতার সম্মান প্রসঙ্গে বলা আছে, তাদের সঙ্গে ‘উহ!’ শব্দ পর্যন্ত করো না।
পিতা সন্তানের মাথার উপর বটবৃক্ষের ছায়ার মতো, যার স্নেহ অবারিত ধারায় শুধু ঝরতেই থাকে। শিশু সন্তানের কচি হাত যখন বাবার হাত আঁকড়ে ধরে হাটতে থাকে তখন তাদের এই অটুট সম্পর্কের বন্ধন সৃষ্টি হয়।
আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছেই বাবা দিবস পালনের বিষয় খুব একটা গুরুত্ব পায় না। তাই বলে এই ধরনের দিবস একেবারেই যে অপ্রয়োজনীয় তেমন কিন্তু মোটেও বলা যাবে না। সন্তানের জন্য বাবার ভালোবাসা অসীম।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছেন। তিনি সন্তান হুমায়ুনের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবন ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। এসব স্বার্থহীন যার ভালোবাসা, সেই বাবাকে সন্তানের খুশির জন্য জীবনের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়।
বাবা দিবসে সন্তানের সামনে সুযোগ আসে বাবাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানানোর। তাছাড়া বাবা দিবস পালনের ফলে সমাজে এবং পরিবারে বাবাদের অবদান তা যে সমাজ এবং নিজের সন্তানেরা মূল্যায়ন করছে, এই বিষয়টি বাবাদের বেশ আনন্দ দেয়। তাছাড়া অনেক সন্তানই আছে, যারা পিতামাতার দেখাশোনার প্রতি খুব একটা মনোযোগী নয়।
মা দিবস বা বাবা দিবস তাদের চোখের সামনের পর্দা খুলে ফেলে পিতামাতার প্রতি তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই ক্ষেত্রে তাই বলা যায়, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে মা দিবস বা বাবা দিবসের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। মোট কথা, আমাদের পারিবারিক তথা সমাজে পিতার যে গুরুত্ব তা আলাদাভাবে তুলে ধরাই বাবা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য।
ভাষাভেদে শব্দ আর স্থানভেদে বদলায় উচ্চারণ, তবে বদলায় না রক্তের টান। দেশ থেকে দেশে কিংবা সময় থেকে সময়ে একই মমতায় চিরন্তন পিতা-সন্তানের বন্ধন।
বাবার তুলনা বাবা নিজেই। যার কল্যাণে পৃথিবীর রূপ, রঙ এবং আলোর দর্শন। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন। বাবা দিবস সকল বাবার মুখে হাসি ফোটাক। শুভ হোক বাবা দিবস।
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ।। উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়