পদ্মা সেতু : পর্যটন সম্ভাবনার নতুন করিডর
পর্যটন সম্ভাবনার বড় করিডর পদ্মা সেতু। স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলার মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্ন পূরণের অনন্য উদাহরণ। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে পদ্মা পাড়ে দর্শনার্থীর পদচারণা।
ধূসর রঙের দ্বিতল কাঠামোর পদ্মা সেতু। থই থই জলরাশি আর খরস্রোতার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় স্থাপনা পদ্মা সেতু। এই পদ্মা সেতুকে ঘিরে মানুষের অন্যরকম অনুভূতি ও উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর জেলার জাজিরাসহ দক্ষিণাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য জেলার সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক যোগসূত্র স্থাপন হবে।
এই যোগসূত্র স্থাপনের ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশের অনন্য অবদান রাখবে। পদ্মা সেতু দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর দুই পাড় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক পদ্মার দুই পাড়ে নান্দনিক সৌন্দর্য দেখার জন্য ঘুরতে যায়। মাওয়া ও শরীয়তপুর প্রান্তে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানাবিধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্ট জাজিরায় তাঁত পল্লী প্রতিষ্ঠার কাজ চলমান ও খ্যাতনামা দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান এসব এলাকায় বিনিয়োগ করছে যা উক্ত অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে সংযোগ স্থাপন করবে। এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। ঢাকার সাথে মংলা বন্দর, বরিশাল, কুয়াকাটা, পায়রা বন্দর, খুলনা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য জেলার অর্থনৈতিক খাতে এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
এই পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর ভূমিকা নিয়ে এর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, সেতু বাস্তবায়িত হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে থেকেই প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক পদ্মার দুই পাড়ে ভিড় জমাচ্ছে। পর্যটকদের সেবা প্রদানের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই।
বাংলাদেশে তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রয়েছে তন্মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ ও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এই দুইটি হেরিটেজ দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত তবে ওই অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক পর্যটকদের পছন্দের পর্যটন কেন্দ্র হওয়া স্বত্বেও ভ্রমণে আগ্রহ ছিল কম। পদ্মা সেতুর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণগুলোতে ভ্রমণে আগ্রহ বাড়বে।
দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণগুলোর মধ্যে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ, ভাসমান পেয়ারা বাজার, ঐতিহাসিক দুর্গা সাগর, কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইন্সটিটিউট, খান জাহান আলী সেতু, খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর, জাতিসংঘ পার্ক, দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মাজার, রূপসা নদী, শহীদ হাদিস পার্ক, খানজাহান আলী কর্তৃক খননকৃত বড়দীঘি, খুলনা শিপইয়ার্ড, গল্লামারী স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভূমি, জাহানাবাদ বনবিলাস চিড়িয়াখানা ও শিশুপার্ক, পিঠাভোগ, প্রেম কানন বকুলতলা, মংলা পোর্ট, রাড়ুলী, রেলস্টেশনের কাছে মিস্টার চার্লির কুঠিবাড়ি, সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক ও অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণগুলোর চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে থেকেই প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক পদ্মার দুই পাড়ে ভিড় জমাচ্ছে। পর্যটকদের সেবা প্রদানের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। সেসব এলাকায় পর্যটন জমে ওঠায় অনেকে এখন আদি পেশা বাদ দিয়ে পর্যটন কেন্দ্রিক নতুন ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করছেন এতে তাদের আয়ের পরিমাণ আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পূর্বেই দুই পাড়ে বিভিন্ন স্থানে চা কফির দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বিশ্রামাগার, স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার দোকান, হ্যান্ডি ক্রাফট দোকান তৈরি হয়েছে। এছাড়াও ফরিদপুরের ভাঙ্গায় দর্শনার্থীদের জন্য বেশ কয়েকটা স্পট তৈরি হয়েছে।
এই যেন উন্নয়নের এক নান্দনিক রূপ। মহা সড়কের দুই পাশে একের পর এক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে। যা উক্ত অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মান ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলে পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক দূর সম্প্রসারিত হবে।
৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু থেকে পদ্মার জলের ঢেউয়ের সাথে সূর্যের আলোতে সোনালি জলতরঙ্গ তৈরি হয় এই নান্দনিক দৃশ্য দেখার জন্য প্রচুর পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটক আসবে। পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ১৩টি রুটে বাস চলাচল করবে যা আন্তঃজেলা যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে।
পর্যটকেরা কুয়াকাটা সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং খুব কম সময়ে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট-কচিখালী, কটকা সৈকত, জামতলা সী-বিচ, সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে জেগে ওঠা দ্বীপ পক্ষীর চর, ডিমের চর ঘুরে দেখার অপার সুযোগ সম্প্রসারিত হবে।
কটকাতে হরিণ পালের বিচরণ দেখতে অনেক পর্যটক ছুটে যান সেখানে। খুলনা শহর থেকে নদী পথে কটকা যেতে হলে সময় লাগে ১৫ ঘণ্টার মতো, আর মংলা থেকে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা।
পর্যটন উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এই সেতু দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ঈর্ষণীয় ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, পায়রা বন্দরকে ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলবে পদ্মা সেতু এবং মাত্র ৬ ঘণ্টায় উপরের উল্লেখিত পর্যটন আকর্ষণগুলোতে পর্যটকেরা যেতে পারবে। তবে কুয়াকাটা থেকে কটকায় পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো।
অন্যদিকে কুয়াকাটার গা ঘেঁষে অবস্থিত ফাতরার চর, লাল কাকড়ার চর, শুঁটকি পল্লী, লালদিয়ার চর, চর বিজয়, ফকিরহাট, সোনার চর, ক্র্যাব আইল্যান্ড বা কম কী? একটি স্পট থেকে আরেকটি স্পট নান্দনিক এছাড়াও রয়েছে ভিন্ন রকম জীব-বৈচিত্র্যর সমারোহ। দারুণ সময় কাটাতে চাইলে এসব পর্যটন স্পটের জুড়ি পাওয়া কঠিন।
পর্যটন উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এই সেতু দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ঈর্ষণীয় ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভ্রমণপ্রেমীদের অন্যতম আকর্ষণ পদ্মা সেতু। দেশের পর্যটনের গতিধারাও বদলে দিতে পারে এই সেতু। ইতিমধ্যে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোও পদ্মা সেতুকে ঘিরে বিভিন্ন রকম ভ্রমণ প্যাকেজের পরিকল্পনা করছেন।
রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময়ে পণ্য পরিবহন করে মংলা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানি গতিশীল হবে এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি হবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত (যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়), ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট দ্বীপগুলোকে মালদ্বীপের ন্যায় পর্যটন আকর্ষণ তৈরি করা সম্ভব এবং সুন্দরবন ঘিরে ওয়াইল্ড লাইফ ট্যুরিজম উন্নয়নের অনন্য সুযোগ রয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চরগুলো কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মালদ্বীপের ন্যায় পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করা গেলে প্রচুর পরিমাণ আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব। ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে যে সময় লাগে তবে পদ্মা সেতু চালু হলে তার চেয়ে অর্ধেক সময়ে পর্যটকেরা কুয়াকাটা ও সুন্দরবন পৌঁছে যাবে।
পায়রা বন্দরের সাথে বুলেট ট্রেন চালু করার কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে কুয়াকাটাসহ অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে যা দেশি ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
প্রতিবছর পর্যটকবাহী ৪৫টি ক্রুজ ভারতে কুচবিহার-চেন্নাই-গোয়া হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে চলে যায়। তবে এই ক্রুজগুলো যদি পায়রা বন্দরে আকৃষ্ট করা যায় তবে আন্তর্জাতিক পর্যটক উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। পদ্মা সেতু গতিশীল করবে মংলা ও পায়রা বন্দরকে যা সুনীল অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রাখবে।
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল যেমন কুয়াকাটা, মংলা বন্দর ও পায়রা বন্দর কেন্দ্র করে সমুদ্র পর্যটনের সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। নদীভিত্তিক ও সমুদ্রভিত্তিক পর্যটনে সময়োপযোগী সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য মাত্রা বাস্তবায়নের পাশাপাশি তৈরি করবে কর্মসংস্থান সুযোগ, শক্তিশালী হবে জাতীয় অর্থনীতি। তবে আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য পদ্মা সেতুর ও দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণগুলো ছোট ছোট প্রমো তৈরি করে ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং করা প্রয়োজন।
ড. সন্তোষ কুমার দেব ।। চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়