সংস্কৃতি খাতে বাজেট এত কম কেন?
বাংলাদেশ ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পরম্পরায় একটি অনন্য জাতিরাষ্ট্র। ভাষা এবং সাংস্কৃতিক স্বাভিমানের উপরেই এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। বহু পুরাতন পুরাতাত্ত্বিক পরম্পরা রয়েছে এই রাষ্ট্রের।
বঙ্গের কথা ঋগ্বেদে যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি রামায়ণ মহাভারতেও বর্ণিত হয়েছে। ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ শব্দের উল্লেখ রয়েছে। এটিই বঙ্গ শব্দের সর্বপ্রাচীন সাহিত্যিক নিদর্শন।
রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে, রাজা দশরথ রাণী কৈকেয়ীকে তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বঙ্গদেশের নামোল্লেখ করে ইচ্ছেমতো বর প্রার্থনা করতে বলেছেন। অর্থাৎ বঙ্গ সুপ্রাচীনকাল থেকেই একটি সমৃদ্ধ জনপদ।
বাঙালির পরিচয় শুধু তার ভাষাতেই সীমাবদ্ধ নয়, আবহমান বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিতেও। তাই এই সংস্কৃতিকে রক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অন্ততপক্ষে বর্তমানের প্রগতিশীল শাসকদের পক্ষে তো বটেই।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে প্রয়াস থাকা উচিত, তা একেবারেই ক্ষীণ। একেবারে নিভু নিভু প্রদীপের মতো। কোনো মতে জ্বলছে। যা হচ্ছে এর অনেকটাই দায়সারাভাবে। যা কখনোই কাম্য নয়।
৯ জুন ২০২২। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেন। বাজেটের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন।’
আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে প্রয়াস থাকা উচিত, তা একেবারেই ক্ষীণ। একেবারে নিভু নিভু প্রদীপের মতো।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হলো ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে রয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব।
প্রস্তাবিত বাজেটে সংস্কৃতি খাতে ৬৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৫৮ কোটি টাকা বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৫৮৭ কোটি টাকার। পরবর্তীতে ৮ কোটি টাকা কমে সংশোধিত হয়ে ৫৭৯ কোটি টাকায় রূপ নেয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় বলেন, সরকার বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, নাটক ইত্যাদি সুকুমার শিল্পের সৃজনশীল উন্নয়ন ও বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে।
দেশীয় সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সমকালীন শিল্প-সাহিত্যের গবেষণা, প্রদর্শন, প্রকাশনা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ চিহ্নিতকরণ, খনন, সংস্কার, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন, সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের কপিরাইট সংরক্ষণসহ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উদযাপন, একুশে পদক প্রদান এবং বাংলা নববর্ষসহ জাতীয় দিবসসমূহ উদযাপনে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর কথা শুনে অনেকেই আমরা হয়তো আশাবাদী হতে পারি যে, বাহ্ দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে তো অনেক বরাদ্দ হচ্ছে, তারা অনেক কাজ করছে ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে ঠিক তেমন নয়। অনেকটা ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতো অবস্থা।
বাজেটে সংস্কৃতি খাতে ৬৩৭ কোটি টাকা আপাতদৃষ্টিতে হয়তো অনেক টাকা মনে হতে পারে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এটি অনেক নয়। ন্যূনতম এক শতাংশও বরাদ্দ হয়নি সংস্কৃতি খাতে। অথচ বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী চেনে তার আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে।
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীব্যাপী পালিত হয় এই দিন। আমাদের জন্য তা অত্যন্ত গৌরবের। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমাদের সকল গৌরবের অতীত তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে হবে।
অর্থমন্ত্রীর কথা শুনে অনেকেই আমরা হয়তো আশাবাদী হতে পারি যে, বাহ্ দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে তো অনেক বরাদ্দ হচ্ছে, তারা অনেক কাজ করছে ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে ঠিক তেমন নয়।
আজ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অধিকাংশ গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি বা লোকঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। শহরে বসবাস করা নতুন প্রজন্ম অধিকাংশই গ্রামীণ যাত্রাপালা, পুতুলনাচ দেখেনি। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল ইত্যাদি মাটির সাথে সম্পর্কিত সংগীত শোনেনি। যদিওবা শুনেছে, তা শহরের শিল্পীদের মুখে। সেই গানগুলো অনেকটাই ঘষামাজা করা। এই ঘষামাজা করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই প্রাচীন স্বরূপই আর থাকে না।
এই আলোচনা সারা দিনরাতব্যাপী করলেও শেষ হবে না। তবে এর থেকে উত্তরণের পথ কী? বরং বলতে হয় আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অথবা সংস্কৃতি সুরক্ষায় আরও আন্তরিক হতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়ানো যেমন প্রয়োজন, তেমনি সেই বরাদ্দ কতটা কার্যকরী হচ্ছে তাও দেখা প্রয়োজন। সরকারি টাকায় প্রশাসনিক আমলাদের বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা কামানো প্রয়োজন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে আসা প্রয়োজন।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন অধিদপ্তরকে আমলাতন্ত্র থেকে মুক্ত করে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। তবে মন্ত্রণালয় যথাযথভাবে সক্রিয় হয়ে লোককল্যাণ করতে পারবে। শুধুই দায়সারাভাবে পহেলা বৈশাখ, নজরুলজয়ন্তী রবীন্দ্রজয়ন্তীসহ কয়েকটি অনুষ্ঠান উদযাপন করলেই তাকে সংস্কৃতি চর্চা বলে না।
প্রয়োজন এই ভূখণ্ডের সহস্র সহস্র বছরের ইতিহাস, সাহিত্য এবং পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে। সেই দেওয়া যথাযথভাবে হচ্ছে না বলেই দেশের তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ মেরুকৃত হয়ে বিভিন্ন উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে।
একমাত্র বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চাই পারে, সেই উগ্রবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী পদক্ষেপ। সেই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে না বলেই, আমাদের যথাযথ সাংস্কৃতিক চর্চা হচ্ছে না। যতটা হচ্ছে ততটা, নামকাওয়াস্তে দায়সারাভাবে। বিষয়টি যেমন কাম্য নয়, তেমনই দুঃখজনক।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়