শেখ হাসিনার কারামুক্তি ছিল গণতন্ত্রের বিজয়
ধানমন্ডি লেকের এপারে বাস করি আমি। আর ওপারে থাকতেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তখন ছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাল। হঠাৎ দেখি ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরবেলায় লেকের ধারের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা।
আমাদের বাড়ির পাস অব্দি তাদের অবস্থান। উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুকন্যাকে গ্রেফতার করা। খবর পেয়ে বেগম মতিয়া চৌধুরীসহ দলের তেজি কর্মী ও নেতারা চলে এসেছেন ধানমন্ডির পাঁচ নম্বর সড়কে। জরুরি অবস্থা সত্ত্বেও তাদের এই সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
চ্যানেলগুলো সরাসরি দেখাচ্ছিল এই গ্রেফতার পর্ব। এক পর্যায়ে নেমে এলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ঢাকা জেলা আদালতে। দেওয়া হলো কারাবাসের নির্দেশ। সংসদ ভবনে স্থাপন করা হয়েছিল বিশেষ কারাগার। সেখানেই নেওয়া হলো তাকে। তিনি অসুস্থ। অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তসহ বেশ কয়েকজন চিকিৎসক নিয়মিত যান তার কাছে। ডা. দীপু মনিও যান তার সাথে।
ব্যারিস্টার শফিক ও তার সহযোগী আইনজীবীরাও দেখা করেন তার সাথে। তাদের মাধ্যমেই খবর পেতাম তার শারীরিক অবস্থার। সবাই বলতেন, মনের জোর একটুও হারাননি তিনি। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা ও কর্মীরা ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন তার মুক্তির জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই দাবি জানান তার আশু মুক্তির জন্য। সকলের অনড় দাবির মুখে ১১ মাস কারাভোগের পর তাকে আট সপ্তাহের অস্থায়ী জামিন দেওয়া হয় ২০০৮ সালের ১১ জুন।
...হঠাৎ দেখি ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরবেলায় লেকের ধারের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা।
এরপর থেকেই এই দিনকে তার কারামুক্তি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সত্যিকার অর্থে সেদিন ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রে ফেরার দিবস। পুরো জাতি সেদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।
অস্থায়ী কারাগার থেকে বের হওয়ার পরপরই তার সুচিকিৎসার জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রে তার ছেলের কাছে যেতে দেওয়া হয়। এরপর কয়েকবার তার জামিন বাড়ানো হয়। ততদিনে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার সাথে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছেন।
ঐ সরকারের শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান তার সাথে দেখাও করেছেন। ইতিমধ্যে স্পষ্ট হতে থাকে যে সহসাই জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তাই তিনি বিদেশ থেকেই দলের নির্বাচনী ইশতেহারের কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
এক পর্যায়ে ‘দিন বদলের সনদ’ নামের ঐ দলিল প্রণয়নের কাজে তার সাথে আমিও যুক্ত হই। ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর দেশে ফেরেন তিনি। এরপর ধানমন্ডির ঐ বাড়িতেই এই দলিল চূড়ান্ত করেন। আমি পায়ে হেঁটেই সেখানে গিয়েছি।
ঐ ইশতেহার তিনি শেরাটন হোটেল উপস্থাপন করেন। সেদিনই রাতে তার নির্দেশে আমি এটিএন বাংলায় ‘দিন বদলের সনদ’-এর নানা দিক ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। মনজুরুল আহসান বুলবুলের তত্ত্বাবধানে ঐ লাইভ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
এরপর ঐ বছরের ২৯ ডিসেম্বর হলো জাতীয় নির্বাচন। বিপুল ভোটে বিজয় বঙ্গবন্ধুকন্যা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করলেন। শুরু হলো দিন বদলের সত্যিকারের অগ্রযাত্রা।
এরপর আরও দুইবার তিনি নির্বাচিত হয়ে দীর্ঘ তেরো বছর ধরে দেশ পরিচালনা করছেন। ২০০৯ থেকে প্রায় সাত বছর তার সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন কাছে থেকে তার জনবান্ধব নেতৃত্বের ধরণ দেখেছি।
বিশ্ব আর্থিক সংকট মোকাবিলা করে তিনি যে অসাধারণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক রূপান্তরের অভিযাত্রা পরিচালনা করে আজকের সুদৃঢ় এক গতিময় বাংলাদেশে পরিণত করেছেন তা অস্বীকারের সুযোগ নেই।
রাজনৈতিক সংকট, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছাড়াও হালের বিশ্ব মহামারি তথা করোনা সংকট কীভাবে তিনি মোকাবিলা করেছেন তা তো আমাদের চোখের সামনেই। এছাড়া স্বদেশের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে সাহসী নেতৃত্ব তিনি দিয়েছেন তা এদেশের মানুষ যুগে যুগে মনে রাখবেন। আমি সেই সময়টায় তার পাশেই ছিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই দাবি জানান তার আশু মুক্তির জন্য। সকলের অনড় দাবির মুখে ১১ মাস কারাভোগের পর তাকে আট সপ্তাহের অস্থায়ী জামিন দেওয়া হয় ২০০৮ সালের ১১ জুন।
এরই মধ্যে শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবে সারা বিশ্বে চলছে মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনৈতিক তাণ্ডব। এই সংকটকালে তার নির্দেশনায় দেওয়া হয়েছে বাস্তবানুগ বাজেট।
আয় বুঝে ব্যয় করার সাশ্রয়ী ও পরিমিতিবোধের এই অর্থনৈতিক কৌশলের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে অপচয় রোধ করা এবং মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষের জীবনে খানিকটা হলেও স্বস্তির পরিবেশ নিশ্চিত করা।
সীমিত রাজস্ব আয় সত্ত্বেও কৃষিতে বেশি করে সমর্থন দেওয়া, দেশি শিল্পকে মদদ দেওয়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নাগালে রাখার জন্য বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি অক্ষুণ্ন রাখা এবং আয় ক্ষয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য সহনীয় মূল্যে খাদ্য সহায়তাসহ বিপুল পরিমাণে সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করার সাহসী উদ্যোগ এই বাজেট নেওয়া হয়েছে।
কিছুদিন আগে তিনি চলমান সংকট মোকাবিলার উপায় হিসেবে জনগণের জন্য যেটি বেশি প্রয়োজন তেমন প্রকল্প হাতে নিতে বলেছেন। অহেতুক সম্পদ নষ্ট না করে সাশ্রয়ী উদ্যোগ নেওয়ার ডাক দিয়েছেন। এই আহ্বানের প্রতিফলন অনেকটাই দেখতে পাই প্রস্তাবিত বাজেটে।
তার এমন ধারার বিচক্ষণ উন্নয়ন নীতি কৌশলের কারণেই এই সংকটকালেও বাংলাদেশ সাত শতাংশের বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের সাফল্য দেখাচ্ছে। অথচ এখন চলছে বিশ্ব মন্দা।
সারা বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধির হার এর অর্ধেকের মতো। তবে এই সাফল্য সত্ত্বেও যে সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যে কষ্টে আছেন সেকথা মানবিক এই নেত্রী ভালো করেই জানেন। তাই তো ভর্তুকি ও প্রণোদনার প্রশ্নে তিনি আপস করেননি। তা সত্ত্বেও সমালোচনার তো কমতি নেই।
যেকোনো প্রশাসনিক ব্যত্যয়ে তাকে তীব্র আক্রমণ করা হয়। তা যে করা হবে সেই কথা তিনি জানেন। আর জেনে বুঝেই তিনি জনকল্যাণে অনড় থাকেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখে তিনি এগিয়ে চলছেন সাহসের সঙ্গে। আছে দুঃখ।
তার কাজেও নিশ্চয় ভুল-ভ্রান্তি আছে। তিনি তো মানুষ। তাই তা থাকতেই পারে। অনেক কাজের মাঝে দু’একটি ব্যত্যয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। নিশ্চয় আছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ। এসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েই তাকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
এই কারামুক্তি দিবসে তার শুভানুধ্যায়ী ও অনুসারীদের একথা মনে রাখতে হবে যে তাকে বিব্রত করতে পারে এমন কোনো ‘বাড়াবাড়ি’ বা অন্যায় আচরণ যেন তারা না করেন।
বড় চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে বাংলাদেশ। সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকেই এই চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করার অঙ্গিকার করার দিন আজ। বঙ্গবন্ধুকন্যার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করছি।
ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর