তাহলে গরিবের জীবন চলবে কী করে?
দেশে চাল, চিনি, তেল, পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বাড়ে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, বাস ভাড়া বাড়ে। বাড়ি ভাড়া, শিক্ষা, চিকিৎসা খরচ সবকিছুর দামই বাড়ে, কিন্তু আয় বাড়ে না।
করোনা পরিস্থিতি আর মন্দ ব্যবসায় চাকরি চলে যাওয়া, বেতন কমে যাওয়া সব ধাক্কা পড়েছে মধ্যবিত্ত আর গরিবের উপর। পেঁয়াজ, লাউ, বেগুন-মরিচ, আদা-রসুন, তেল-লবণ সবকিছুর দামই এখন আকাশছোঁয়া। তাহলে গরিবের জীবন চলবে কী করে?
বলতেই হয় গরিব, মধ্যবিত্ত কেউ আর ভালো নেই, সুখে নেই। সম্প্রতি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ‘চাল তেলসহ সকল পণ্যেও দাম ঊর্ধ্বমুখী : জীবনের চাকা ঘোরাতে পারছে না নিম্ন আয়ের মানুষ’ এমন শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
শ্রমজীবী মানুষের নানা কথা লেখা আছে প্রতিবেদনে। ‘কেমন আছেন?’ প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে রিকশাচালক মিজানের সাফ কথা, ‘বালা নাইক্কা’। রিকশার চাকাতো ভালোই চলছে, আমরাও তো ভাড়া ঠিকঠাক মতোই দিচ্ছি বলতেই, ছন্দে ছন্দে একদমে রিকশাচালকের উত্তর, ‘চাল-তেল, আটা-ময়দার দাম আকাশছোঁয়া, কী কইরা ঘুরাই জীবনের চাকা।’
সেদিন কঠিন সত্য কথা বললেন, রমনার চা বিক্রেতা সাইফুল। ‘বালা থাহনের কোনো পথই খোলা নাই। পর্তেকদিন চরকির মতন ঘুইরা চা বিক্রি কইরা যা আয় অয় তা দিয়া জীবনের চাকা ঘোরাইতে পারি না’ দ্রব্যমূল্য নিয়ে এমন অভিযোগই এখন সবার।
নারায়ণগঞ্জের একটি পত্রিকায় প্রতিবেদনে দেখলাম। বাজারে রাস্তার পাশে এক কোণে বসে কলমিশাক বিক্রি করেন এক বৃদ্ধ মহিলা। বললেন, কলমিশাকের দাম এক টাকা বাড়লে কেউ আর কিনতে চায় না কিন্তু তাদের সবকিছুই বাড়তি দামে কিনতে হয়।
রিকশাচালক মিজান কিংবা গুলিস্তানের আখের রস বিক্রেতা রিপন, রমনার ভাসমান চা বিক্রেতা সাইফুল এদের জীবন ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু সমস্যা সেই একই। দিন চলে না কারো।
প্রকৃতপক্ষে কাজ থেকেও তাদের কাজ নেই। এই হচ্ছে কাজ করে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা। এই দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেকই এখন বেকার। এরপর শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের কথা বোধ করি আর অধিক বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না।
তাদের সম্পর্কে একটা কথাই বলা যায়, জীবনের চাকা আর ঘোরাতে পারছেন না তারা। দেশে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। সরকারের হাতেও কাজের সুযোগ সীমাবদ্ধ। সুতরাং বেকার সমস্যার সমাধান করতে হলে দেশে শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশের বস্ত্র শিল্পে সংকট চলছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কমছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক শিল্প কারখানা। কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকেরা। বিদেশের শ্রমবাজারও মন্দা। এতে মানুষের আয় কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন এই তিন মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি তার আগের তিন মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৭২ ভাগ কমেছে। যদিও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে পাঁচ দশমিক ১৬ ভাগ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী এই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত প্রবৃদ্ধি ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতেতো আর ধরে রাখা যায়নি। গত বছরের তুলনায় আগস্টে রপ্তানি কমেছে ১২ ভাগ আর সেপ্টেম্বরে কমেছে পাঁচ ভাগ।
চলতি বছর বাংলাদেশের পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২০ কোটি ডলার। যা গত বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৯১ ভাগ বেশি। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে এখন সংশয় দেখা দিয়েছে। ছোট কারখানাগুলো তাল মেলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে বেকার হচ্ছে বহু শ্রমিক। অনেকেরই এখন কাজ নেই। হাতে পয়সা নেই। তারমধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে।
দেশে গ্যাস জ্বালানি সংকট রয়েছে। মানুষের নানা সংকট বাড়ছে, সাধারণ মানুষের জীবন আরও বিপন্ন হচ্ছে। দেশের শ্রম বাজারে প্রতিবছরই ঢুকছে নতুন নতুন মুখ। সরকারি হিসেবেই বছরে এই নতুন মুখের সংখ্যা ১৫ লাখ। অথচ দেশে কাজের অভাব মারাত্মক।
যশোরের চৌগাছা এলাকার আমিনুল ইসলাম বলেন, ডিগ্রি পাস করে ঢাকায় এসে একটা চাকরির জন্য ঘুরছি গত ১ বছর ধরে। খেয়ে না খেয়ে কমলাপুরের কলোনিতে দিন কাটলেও এই যাবৎ একটি ছোটখাটো চাকরিও জোটেনি আমার ভাগ্যে।
প্রতিদিন বহুলোক শুকনো মুখে কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা শহরগুলোতে। ঢাকা মহানগরীর বাড্ডা, গুলিস্তান, শ্যামলী, আগারগাঁও, যাত্রাবাড়ী, কারওয়ানবাজার প্রভৃতি এলাকায় ভোর থেকে দিনমজুরেরা বসে শ্রম বিক্রির জন্য। তাদের সাথে কথা বলে একটি দৈনিক লিখেছে, ইদানীং সপ্তাহে ৩-৪ দিন কাজ জুটছে না। ১০০ জন বসলে মধ্যদিনের আগে ৭০ জনকেই কাজ না পেয়ে চলে যেতে হচ্ছে।
অনেককেই চলে যেতে হচ্ছে উপোস থাকার ঝুঁকি নিয়ে। কুমিল্লা থেকে গত জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এসে কালু মিয়া থাকছেন মতিঝিলের বস্তিতে। উপর্যুপরি ৪ দিনে বেকার থাকার কথা জানাতে গিয়ে তার কণ্ঠে হতাশা ঝরে পরে, ‘কেউ আমারে ডাহে না।’ ডাকে না শুধু কালু মিয়াকেই নয় ১০০ জনের মধ্যে এমনি ৭০ জনকেই। কাজ না পেয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ (২০২০-২০০২১) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, গত ৫ বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৬৬ লাখ। কাজ করার ক্ষমতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান নেই ১ কোটি ২০ লাখের বেশি।
১৫ কোটি মানুষের মধ্যে শ্রমশক্তি (লেবার ফোর্স) ধরা হয় সাড়ে ৪ কোটি মানুষকে। এর শতকরা ৩০ ভাগই বেকার। মতান্তরে অর্ধেক। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক (ফরমাল-ইনফরমাল) উভয় খাতেই এখন ঘোরতর বেকারত্ব। শিল্পখাতে কর্মসংস্থান তৈরি কিংবা হারানোর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বেশ কিছুদিন থেকেই তৈরি পোশাক ছাড়া কোনো বর্ধিষ্ণু খাত নেই।
কৃষিখাতে কর্মসংস্থান ক্রমাগত কমছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না হওয়া প্রভৃতি কারণে অর্থনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা চলছে। দেশের শ্রমজীবী মানুষ তারই শিকার।
বেকার সমস্যা কম-বেশি সবসময়ই ছিল। এখন দিনে দিনে তা আরও ভয়াবহ ও প্রকট হয়ে উঠছে। সরকারি একটি বিভাগে ৪০৭ শূন্যপদে দরখাস্ত পড়েছিল ১১ লাখ। অন্য একটি বিভাগে ৩টি পদের জন্য আবেদনপত্র জমা পড়েছিল ১৫ হাজার।
বোধহয় দৃষ্টান্ত আর বাড়ানোর দরকার নেই। এসব থেকেই বোঝা যায়, দেশে বেকার সমস্যা অর্থাৎ কাজের অভাব কী তীব্র ও ভয়াবহ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি।
যত কথাই বলা হোক, যত ভালো কথা, যত দামি কথা, সবকিছুই নিরর্থক, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। এক কথায় বললে বলতে হয়, নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের জীবনের চাকাই একরকম অচল হয়ে পড়ছে। এই অবস্থাকে কোনোমতেই দেশের ও সমাজের সুলক্ষণ বলা যায় না। যেমন করেই হোক, সর্বপ্রথমে সর্বাগ্রে মানুষের হাতে কাজ দিতে হবে।
কর্মসংস্থান অর্থাৎ কাজে সুযোগ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। গত ৩৮ বছরে দেশে কর্মসংস্থানের পরিধি যতটা বাড়া উচিত ছিল তারা সামান্যতই মাত্র বেড়েছে। এর একটা বড় কারণ সরকার নিয়ন্ত্রিত শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে ক্রমাগত বিপর্যয়।
গত ৩৮ বছরে কর্মবাজার সৃষ্টিতে তাই পাবলিক সেক্টরের অবদান বলা যায় নগণ্য। সরকারি ও বেসরকারি খাতের বাইরে কর্মসংস্থানের আরও একটি ক্ষেত্রের কথা বলা যায়, যার নাম বিকল্প কর্মসংস্থান।
এটা অনেকটা নিজেই নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে দেশে বহু সাফল্যের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলো নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। তবে এতেই যে দেশে বেকারত্বের চাপ খুব একটা কমেছে এমন বলা যাবে না।
মোদ্দা কথা হলো, কাজই এখন মানুষের বেঁচে থাকার উপায়। কর্মসংস্থান তৈরি সেই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যেও ঊর্ধ্বগতি নামিয়ে আনা গেলে সাধারণ মানুষ শান্তি ফিরে পাবে। কাজের ক্ষেত্র বা পরিধি যত প্রসারিত হবে ততই এই দুঃসহ চাপ কমবে।
মীর আব্দুল আলীম ।। সাংবাদিক, কলামিস্ট