দুটি হত্যা মামলার রায়ে জঙ্গিদের নিষ্ক্রিয়তা কমবে না
১
মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে আলোচিত দুটি হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম রায়টি ঘোষিত হয় ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ এবং দ্বিতীয়টি ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে। প্রথম রায়ে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার দায়ে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান আটজন আসামীর সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন এবং প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন।
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে দীপনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম নামের একটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। দীপনের প্রকাশনা সংস্থা থেকে অভিজিৎ রায়ের লেখা বই প্রকাশ করা হয়েছিল বলেই সম্ভবত তাকে হত্যা করে ঘাতক জঙ্গিরা। দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং মুক্তচিন্তার লেখক-গবেষক হিসেবে পরিচিত আবুল কাশেম ফজলুল হক। দীপনকে হত্যার আগে-পরে জঙ্গিরা দেশে আরও কয়েকজন লেখক-প্রকাশক-ব্লগারকে হত্যা করেছে বা হত্যা-চেষ্টা চালিয়েছে।
দীপন হত্যার অভিযোগে যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাদের ছয়জন বর্তমানে কারাগারে আছেন আর দুইজন আছেন পলাতক। পলাতক দুইজন হলেন সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া এবং আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির।
বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে হত্যার দায়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান। এই রায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যেও পলাতক জিয়াউল হক জিয়া এবং আকরাম হোসেন রয়েছেন। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎ রায়কে। গুরুতর আহত হয়েছিলেন অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। অভিজিতের বাবা পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অজয় রায় বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন। তিনি তার পুত্র হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি। ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ড. অজয় রায় মৃত্যুবরণ করেন।
অভিজিৎ এবং দীপন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হওয়ায় এবং আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ায় সাধারণভাবে তাদের পরিবার এবং দেশের মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে বলেই মনে হয়। তবে এই রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত কারো মন থেকেই সংশয় পুরোপুরি দূর হবে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির জন্য দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা কিছুটা কমে এলেও তারা একেবারে নির্মূল হয়নি। মাঝে মাঝেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জঙ্গি গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়।
জঙ্গিদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা কারা করছে, কারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে তা বের করতে হবে। জঙ্গিরা হাওয়া খেয়ে বাঁচে না। সমাজে যারা তাদের রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করছে তাদের শনাক্ত করতে না পারলে কিছু প্রত্যক্ষ অপরাধীকে দণ্ড দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সুফল পাওয়া যাবে না।
তাছাড়া জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেন নামের দুই জঙ্গিকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে না পারায় উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়াকে জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলা এবং মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যার পেছনে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মনে করা হয়। আকরাম তার প্রধান সহযোগী। প্রায় সব জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গেই তাদের জড়িত থাকার কথা শোনা যায়। এই দুর্ধর্ষ দুই জঙ্গিকে ধরতে না পারায় এমন আশঙ্কা থেকেই যায় যে, তারা গোপনে আরও কোনো অঘটন ঘটানোর পরিকল্পনা করছে কিনা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের উচিত পলাতক দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিকে খুঁজে বের করে আদালতের রায় বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। জিয়াউল হক দেশে আছেন না বিদেশে পালিয়ে গেছেন, সে বিষয়টাও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তার অবস্থান চিহ্নিত করা গেলে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সহজ হতে পারে।
২
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সক্রিয় হতে হবে। জঙ্গিদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা কারা করছে, কারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে তা বের করতে হবে। জঙ্গিরা হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকে না। সমাজে যারা তাদের রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করছে তাদের শনাক্ত করতে না পারলে কিছু প্রত্যক্ষ অপরাধীকে দণ্ড দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সুফল পাওয়া যাবে না।
অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার বক্তব্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা নিজে আহত হয়েছিলেন, তিনি ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। কিন্তু তার সঙ্গে মামলার তদন্তকারীরা যোগাযোগ না করাটা দুঃখজনক। মামলার রায় ঘোষণার পর বন্যা তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অভিজিতের মতো লেখক, ব্লগারদের হত্যার ঘটনায় যারা টাকা খরচ করেছে তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য তদন্তে উঠে আসেনি। অল্প কিছু চুনোপুঁটির বিচারকার্য সম্পাদন করে এবং জঙ্গিবাদের উত্থান ও শিকড় উপেক্ষা করে এ হত্যার ন্যায়বিচার হতে পারে না'। এটা উপেক্ষা করার মতো বিষয় নয়। আশা করি, সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ পড়বে বন্যার বক্তব্যের প্রতি।
জঙ্গিদের উত্থান একদিনে হয়নি। এটা নির্মূলও রাতিরাতি করা সম্ভব নয়। যেই যেই কারণে জঙ্গিবাদ তৈরি হয়, সেই কারণগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করতে হবে। রোগের কারণ নির্ণয় না করে চিকিৎসা করলে রোগ থেকে নিরাময় পাওয়া সম্ভব হয় না।
মোটা দাগে এটা বলা যায় যে, আশির দশকে হরকাতুল জিহাদ বা হুজির মাধ্যমে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের যাত্রা শুরু। এরপর সামনে আসে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি। তারপর সাবেক সেনাকর্মকর্তা জিয়াউল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় আনসার আল ইসলাম। আরও দু’একটি জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার কথাও শোনা যায়। জঙ্গি সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাতে না পারলেও তারা যে সমাজে কোনো না অংশ থেকে সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়ে থাকে তাতে সন্দেহ নেই।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম আমলের শেষ দিকে ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি কবি শামসুর রাহমানের শ্যামলীর বাসায় ঢুকে তাকে হত্যা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জঙ্গিদের সক্রিয়তার বিষয়টি সামনে আসে। তারপর বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে দেশে জঙ্গিবাদের প্রবল উত্থান ঘটে। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি লেখক-চিন্তক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার ঘটনা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একসঙ্গে ৬৩ জেলায় বোমা হামলার মাধ্যমে জঙ্গিরা তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ অনেক জঙ্গি এবং তাদের জঙ্গি সংগঠনের নাম মানুষ জানতে পারেন।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিকভাবে বোমা-গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। এক ধরনের ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়। শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলা ভাইসহ তাদের কয়েকজন সহযোগী জঙ্গির শাস্তি হলে অল্প সময়ের জন্য জঙ্গিদের প্রকাশ্য কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও তারা গোপনে সংগঠিত হতে থাকে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা আবার সামনে আসে। এরপর ধারাবাহিকভাবে জঙ্গি হামলার শিকার হতে থাকেন লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, সমকামী অধিকার কর্মীরা।
আশির দশকে হরকাতুল জিহাদ বা হুজির মাধ্যমে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের যাত্রা শুরু। এরপর সামনে আসে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি। তারপর সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় আনসার আল ইসলাম। আরও দু’একটি জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার কথাও শোনা যায়...
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে হোলি আর্টিজানে হামলা, শোলাকিয়ায় ঈদের দিন হামলাসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনার পর সরকারের জঙ্গি বিরোধী দৃঢ় মনোভাবের কারণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সফল অপারেশনে কয়েকজন জঙ্গির মৃত্যু ও অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। দীপন ও অভিজিৎ হত্যার বিচারের রায় জঙ্গি দমনে আরেক ধাপ অগ্রগতি হিসেবেই দেখা যেতে পারে।
৩
অভিজিৎ হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, জন নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ না করতে পারে। আদালত বলেছেন, অভিযুক্ত আসামিরা বেঁচে থাকলে ওই জঙ্গি সংগঠনের অন্য সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহী হবে। এতে বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তমনা লেখকরা স্বাধীনভাবে লিখতে ও মত প্রকাশ করতে সাহস পাবেন না। কাজেই আসামিরা কোনো সহানুভূতি পেতে পারেন না।
আদালতের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করে বলা যায়, মুক্তচিন্তা চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত ততোক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব হবে না, যতোক্ষণ সমাজে জঙ্গি মানসিকতার প্রতি সহানুভূতি থাকবে। সমাজ মানসে পরিবর্তন আদালতের নির্দেশে আসবে না। এজন্য মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার উপযোগী শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নানা ত্রুটি-গলদ দূর করার কোনো ভালো চেষ্টা দেখা না গেলেও মূঢ়তা বিস্তারের লক্ষ্যে হাস্যকর সব পরিবর্তন ঠিকই ঘটতে দেখা যায়। আমাদের নীতি নির্ধারকদের কারো কারো মধ্যে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পথে না হেঁটে ভুল পথে চলার প্রবণতা প্রবল বলেই মনে হয়। তাই আমরা গন্তব্য পৌঁছাতে দেরি করি, মাঝ পথেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সময় এসেছে ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার।
অভিজিৎ রায়, দীপনসহ যারা জঙ্গিদের হাতে নিহত হয়েছেন তারা কেউ কিন্তু কারো বিরুদ্ধে হত্যার প্ররোচনা দেননি, কোনো ধরনের বিদ্বেষ প্রচার করেন নি। অভিজিৎ তার লেখার মাধ্যমে মানুষকে যুক্তিবাদী হতে সহায়তা করেছেন। কিন্তু যারা বিদ্বেষ ছড়ায়, মানুষকে হিংসার পথে উস্কানি দেয় তাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ধর্মান্ধদের সুযোগ দেওয়া এবং উদার চিন্তার মানুষদের ব্যাপারে নির্লিপ্ততা কাম্য হতে পারে না। আইন এবং আইনের শাসন সবার জন্যই সমান প্রযোজ্য হওয়া উচিত। যারা অন্ধ বিশ্বাসের প্রচারক তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞানের আলো হাতে যে সব সত্য সাধক অকুতোভয়ে পথ চলতে চান, তাদের জীবন নিরাপদ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে অবশ্যই নিতে হবে। জোড়াতালির মেরামত কখনো টেকসই হয় না।
বিভুরঞ্জন সরকার ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক