ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েকদিন ধরে গড়ে প্রায় ১০ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে, বিশেষ করে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
সারাবছর ডেঙ্গু রোগী খুব কম পাওয়া গেলেও বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু রোগী হু হু করে বাড়তে থাকে। বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো বৃষ্টি। অপরিকল্পিত নগরায়ন, মানুষের অসচেতনতা ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব শহরে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা জন্মানোর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।
আধুনিক জীবনযাপনের সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট, পানির জারসহ বিভিন্ন ধরনের পাত্র। আর এই পাত্রই ডেকে আনছে ডেঙ্গু। নগরীর বিভিন্ন স্থানে আনাচে কানাচে পড়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের পাত্র এডিস মশা প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান।
এডিস মশার ঘনত্বের মাত্রা থেকে অনুমান করা যায় এডিস মশা বাহিত রোগ, বিশেষ করে ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া কেমন হতে পারে। ২০২২ সালের প্রাক-মৌসুম জরিপে ঢাকা শহরের ৪.৫৩ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে।
এবছর প্রাক-মৌসুম এডিস মশার ঘনত্ব ২০২০ ও ২০২১ সালের প্রাক-মৌসুম এডিস মশার ঘনত্বের তুলনায় বেশি। এই বিষয় ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় জানানো হয়েছে।
সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে গত দুই বছরের চাইতে এবছর মৌসুমে ডেঙ্গু বেশি হওয়ার। তেমনি লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান সময়ে। মে মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বলে দেয় বিজ্ঞানভিত্তিক জরুরি পদক্ষেপ না নিলে এবছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।
ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গুর প্রধান বাহক। আমাদের দেশে ৯৫ ভাগ ডেঙ্গু রোগ ছড়ায় ইজিপ্ট প্রজাতির এডিস মশা। ডেঙ্গুর সেকেন্ডারি বা অ্যাপিডেমিক বাহক হচ্ছে এডিস অ্যালবোপিকটাস।
ডেঙ্গু, এডিস মশা বাহিত একটি ভাইরাসজনিত জ্বর রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি স্ট্রেইন (ডেন-১, ২, ৩ ও ডেন-৪) এর যেকোনো একটি দিয়ে ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। আর এই ভাইরাস বহন করে এডিস প্রজাতির মশা।
এডিস মশার দুটি প্রজাতি ঢাকা শহরে দেখা যায়, তার মধ্যে একটি হলো এডিস ইজিপ্টি আরেকটি হলো এডিস অ্যালবোপিকটাস। এডিস ইজিপ্টিকে নগরের মশা বা গৃহপালিত মশা বলা হয়ে থাকে। এই মশা নগরীর বাড়ি এবং বাড়ির আশেপাশে বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানিতে জন্মায়।
ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গুর প্রধান বাহক। আমাদের দেশে ৯৫ ভাগ ডেঙ্গু রোগ ছড়ায় ইজিপ্ট প্রজাতির এডিস মশা। ডেঙ্গুর সেকেন্ডারি বা অ্যাপিডেমিক বাহক হচ্ছে এডিস অ্যালবোপিকটাস। একে এশিয়ান টাইগার মশাও বলা হয়ে থাকে।
অ্যালবোপিকটাস মশা বিভিন্ন পাত্র ছাড়াও গাছগাছালি যুক্ত এলাকায় গাছের কোটর, কলাগাছের দুই পাতার মাঝখানে, কচুর পাতার মাঝখানে, কাটা বাঁশের গোড়ায় জমে থাকা পানিতে জন্মায়।
বাংলাদেশ ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু আসে তখন এটিকে ঢাকা ফিভার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব মতে ৫,৫০০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৫৫০ জন মারা যায়।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু সবচাইতে বড় আঘাত হানে ২০১৯ সালে। সেই বছর প্রায় ১০১,৩০০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং সারা বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। ২০২১ ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৯ হাজার।
বৃষ্টিপাত বাড়লে এডিস মশার ঘনত্ব আরও বাড়বে তাই এখনই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে নিম্নলিখিত কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।
সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি মূল পিলারকে একসাথে সারাবছর বাস্তবায়ন করতে পারলেই এডিস মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া ও জিকাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ডকে দশটি ব্লকে ভাগ করে দশটি টিম গঠন করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। পুরস্কারের ব্যবস্থা করে তাদের উৎসাহিত করা যেতে পারে।
স্বল্প সময়ের অভিযান বা কার্যক্রম করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে পাঁচ থেকে দশ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সারা বছরব্যাপী চলমান থাকতে হবে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মহাপরিকল্পনায় সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি মূল পিলারকে একসাথে সারাবছর বাস্তবায়ন করতে পারলেই এডিস মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া ও জিকাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
প্রকৃতপক্ষে জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া দুষ্কর। তাই এই প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে সামাজিক সংগঠনগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে এই কাজ করানো যেতে পারে।
ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা যেটিকে সরকার বা সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি।
তাই সিটি কর্পোরেশন এবং নগরবাসী একে অপরকে দোষারোপ না করে যার যার দায়িত্ব বোধ থেকে সমন্বিত কার্যক্রম চালালে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে। ডেঙ্গুর বাহক মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ; গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়