শতাব্দীর পশ্চাতে নজরুল অবলোকন
শতাব্দীর পশ্চাতে (১৯২২) ফিরে গেলে পাওয়া যায় এক বিপ্লবী তরুণ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। যিনি বাংলা সাহিত্যের সবিশেষ উল্লেখ্য ও অদ্বিতীয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশ করে রাতারাতি খ্যাতিমান হয়েছেন। সমালোচকেরা মনে করেন, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী কবির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই বছর।
কবিতায় ‘বিদ্রোহী’র প্রকাশ যেমন তাকে বিদ্রোহী কবির অভিধায় সিক্ত করছে। তেমনি এবছর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ ও এই পত্রিকায় তার বিপ্লবী রচনাবলীর মুদ্রণ, রাজরোষ এবং কারাবরণ সবই ঘটেছে। বলা হয়, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী নজরুলের স্ফুরণবর্ষ ১৯২২, আর এই বিবেচনায় ২০২২ নজরুল স্ফুরণবর্ষের শতবর্ষ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্ফুলিঙ্গের মতো, প্রজ্বলিত অগ্নিশলাকার মতো দ্বীপ্তময় হয়ে উঠেছিলেন ১৯২২ সালে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা ও প্রকাশনায় যে উন্মাদনা তার ছিল, তার দ্বিগুণ উচ্ছ্বাস-আলোড়ন ছিল ‘ধূমকেতু’র প্রকাশনায়। ‘ধূমকেতু’ ছিল তার স্বপ্নসারথি ও গন্তব্যসঙ্গী। ‘ধূমকেতু’র প্রকাশ প্রেক্ষাপট তাই সাক্ষ্য দেয়।
উল্লেখ্য মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’র ‘সেবক’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেকার জীবন অতিবাহিত করছিলেন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা ও প্রকাশনায় যে উন্মাদনা তার ছিল, তার দ্বিগুণ উচ্ছ্বাস-আলোড়ন ছিল ‘ধূমকেতু’র প্রকাশনায়। ‘ধূমকেতু’ ছিল তার স্বপ্নসারথি ও গন্তব্যসঙ্গী।
সেই সময় চট্টগ্রামর হাফিস মাসউদ একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন ও নগদ আড়াইশত টাকা নিয়ে কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হন কমরেড মুজফ্ফর আহমদ।
১৯২২ সালের ১১ আগস্ট কাজী নজরুল ইসলাম অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’ প্রকাশ করেন। ক্লাউন ফলিতে ১৫" ১০" সাইজের আট পৃষ্ঠার পত্রিকা, যার মূল্য ধরা হয়েছিল এক আনা এবং বাৎসরিক মূল্য ছিল পাঁচ টাকা।
‘ধূমকেতু’র চার সংখ্যা পর পৃষ্ঠা সংখ্যা ধার্য করা হয় বারো। পত্রিকা অতিদ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং কাজী নজরুল ইসলামের কবি খ্যাতির পাশাপাশি বিপ্লবী কবি বিশেষণে পরিচিতি ঘটে।
কবি যখন ‘নবযুগে’ ছিলেন তখন তাকে বিপ্লবী নামে অভিহিত করা হতো। কিন্তু ‘ধূমকেতু’র প্রকাশের পর বিদ্রোহী-বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম নামে তার সর্বাধিক সুখ্যাতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
কবি এই পত্রিকার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে, সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে মানুষকে জাগ্রত করতে ও সাম্য-সমতার লড়াইয়ে মানুষকে সমবেত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই পত্রিকা জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের ও সাম্যবাদী লড়াকুদের প্রশ্রয় ও আকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছিল।
ভূপতি মজুমদার, কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, শান্তিপদ সিংহ, নৃপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধচন্দ্র সেন, হুমায়ুন কবির, হেমেন্দ্রকুমার রায়, বলাই দেব শর্মা, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ নামে-ছদ্মনামে বিপ্লবী চেতনাস্নাত কাব্য-কবিতায়, গদ্য-প্রবন্ধে ‘ধূমকেতু’র পাতা ভরিয়ে রাখতেন। সম্পাদক হিসেবে নয়, সারথি হিসেবে ‘ধূমকেতু’র রথ চালিয়েছেন কবি নজরুল।
‘ধূমকেতু’র প্রথম সংখ্যায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেরিত আশীর্বাণী ছাপা হয়েছিল। কবি লিখেছিলেন—
‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা-
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্দ্ধচেতন।’
[২৪ শ্রাবণ, ১৩২৯, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘ধূমকেতু’ ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা)]
‘ধূমকেতু’র চার সংখ্যা পর পৃষ্ঠা সংখ্যা ধার্য করা হয় বারো। পত্রিকা অতিদ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং কাজী নজরুল ইসলামের কবি খ্যাতির পাশাপাশি বিপ্লবী কবি বিশেষণে পরিচিতি ঘটে।
‘ধূমকেতু’কে শুভাশীষ জানিয়েছিলেন অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লবী বারীন ঘোষ প্রমুখ। এদের সকলের প্রীতি-আশীর্বাদে, প্রেরণা-প্রণয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী চেতনাশাণিত কবি ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হয়েছিল এই বাইশ সালেই। কবি লিখলেন—
‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
ঐ স্রষ্টার শনি মহাকাল-ধূমকেতু।’
কবি ‘ধূমকেতু’তে ‘সারথির পথের খবর’ শিরোনামে লিখলেন, ‘স্বরাজ নয় স্পষ্ট স্বাধীনতা চাই। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশিদের অধীনে থাকবে না। ভারতের শাসনভার থাকবে ভারতীয়দের হাতে। বিদেশিদের রাজত্ব ও মোড়লি চলবে না।’
শতাব্দীর পশ্চাতে এমন অগ্নিময় সাহসী স্বাধীনতার দাবি উচ্চারণ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বিপ্লবীতে রূপান্তরিত করেছিল। বস্তুত অসহযোগ আন্দোলনের অহিংস পথধারায় পরিচালিত ভারতীয় বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে আবার সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির শোণিত ধারায় প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
কবি নজরুল, বিপ্লবী নজরুলে পরিণত হন এবং ‘ধূমকেতু’ অফিসে ‘যুগান্তর’ ও ‘অনুশীলন’ দলের সদস্যদের পছন্দ সান্নিধ্য হয়ে ওঠেন নজরুল।
শতাব্দীর পশ্চাতে কবি নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে যে বিদ্রোহী সত্ত্বার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই তিনিই ‘ধূমকেতু’ প্রকাশ ও ধূমকেতুতে বিপ্লবী লেখা লিখে ঐ মধ্যবিত্তকে বিপ্লবী চেতনায় শাণিত ও জাগ্রত করেছেন।
‘ধূমকেতু’-তে তিনি লিখলেন তার বিপ্লবী কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’; যে লেখার কারণে ১৯২২ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। এবং তার এই কবিতা ও কবির কারাবরণ সে সময়ের তারুণ্যকে বিপুলভাবে আলোড়িত ও আন্দোলিত করে, শিক্ষিত দেশব্রতী যুব সমাজকে বিপ্লবীতে রূপান্তরিত করেছিল।
এই সত্য আজ সর্বজন স্বীকৃত। সেই সত্যই আজ উচ্চকিত উচ্চারণে প্রমাণিত ধ্রুবকে পরিণত হয়েছে। আর শতাব্দীর পশ্চাতে নজরুল অবলোকন সেই উচ্চারণকে করেছে কালোত্তীর্ণ বাণী।
অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী ।। শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার