নরসিংদীতে তরুণী লাঞ্ছনা : নতুন সমস্যা পোশাক-বিভ্রাট
নরসিংদীতে কী ঘটেছে এখন সবাই আমরা জানি। জিনস ও স্লিভলেস টপস পরায় জেলার রেল স্টেশনে এক তরুণী লাঞ্ছিত হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার সাথে থাকা এক তরুণও। কতগুলো বখাটের সঙ্গী হয়েছিল এক নারীও। কিছুদিন আগে আরেক তরুণী বাসের ভেতর লাঞ্ছিত হয়েছিলেন এক হিজাবি নারী কর্তৃক।
ভারতের মুসকান নামের নারী, হিজাব পরার স্বাধীনতায় প্রতিবাদী হলে বাংলাদেশে যারা বলেছিল, পোশাক পরার অধিকার নিজস্ব, তারাই আবার হিজাবের বাইরে অন্য পোশাকের বেলায় এই স্বাধীনতা দিতে রাজী নয়।
যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন পোশাকে একটি নারী সমাজের লোকচক্ষুর সামনে এসে দাঁড়ালে তা হবে শোভন? তারা বলবেন, রুচিশীল এবং সেই রুচিশীলতার কোনো স্থির উত্তর নেই তাদের কাছে। তবে আছে, সেটা সবাই মুখ খুলে বলে না। বাংলাদেশের বড় একটি অংশের মনোজগতে নারীর পোশাক মানে পুরো আবৃত তালেবানি শাসনে থাকা নারী।
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের একটা বড় জায়গা ছিল ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সেই লড়াইয়ে নারীদের বড় অংশগ্রহণ ছিল। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। তারপরে কেটে গেছে ৫০টিরও বেশি বছর। ঘটেছে বহু নীরব ও সরব নারীবাদী আন্দোলন।
আজ নারী সমাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এক পৃথিবীতে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির শিখরে পৌঁছেছে মানুষ। বিশ্বায়নের স্রোতে আজ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও আধুনিক সভ্যতার অংশ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভালো নেই বাংলাদেশের নারী। আধুনিক পৃথিবীর মুক্ত বাতাসে তারা শ্বাস নিতে পারছেন না।
ধর্ষণ, নিপীড়নের পাশাপাশি এক নতুন উপদ্রব নারীর সাজ ও পোশাক নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী শক্তি ক্ষমতায়। দেশের অব কাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে অনেক।
একের পর এক ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির ঘটনার সাথে যুক্ত হয়েছে এই নতুন অত্যাচার। এখন রাস্তায় একজন পুলিশ কনস্টেবল নারীকে অপমান করছে টিপ কেন পরেছে তা নিয়ে...
নারীরা আজ রাজনীতি ও প্রশাসনের বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ পদেও আছেন এবং সেই ক্ষেত্রে সরকারের একটা প্রচেষ্টাও আছে। কিন্তু সরকারি এসব কাজ যে সার্বিক নারী প্রগতি ঘটাতে পারে না, পারছেও না তার প্রমাণ প্রায় প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে।
বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন, সিনেমা, টিভির ধারাবাহিক—সব ক্ষেত্রেই আধুনিকতার মোড়কে আমরা অনেকেই পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণাগুলো বহন করে চলেছি। সেই সাথে সামনের কাতার থেকে সরকার ও সরকার বিরোধী পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী। তাদের মতাদর্শই এখন রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশে।
সভ্যতার প্রদীপের নিচেই রয়েছে গভীর অন্ধকার। সেখানে নারীরা এখন আলোর পথ খুঁজছেন। এই অন্ধকার গোষ্ঠীর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিষয় নারীকে অপমান করা, হয়রানি করা, তাদের পোশাক নিয়ে মন্তব্য করা, তাদের পড়ালেখা করা নিয়ে বিষোদগার করা।
শরীরের সাথে টাইটফিট লেগে থাকা (যদিও সেটাতেও কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়) হিজাব গ্রহণযোগ্য হলেও সাধারণ শ্লীল শার্ট, প্যান্ট বা টপস যেন মহাপাপ।
দীর্ঘদিন যাবৎ দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে। গত কয়েক দশকে সেই ধারণায় অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। পুরোদস্তুর আধুনিক না হলেও আর্থিক সংস্কারের কল্যাণে দেশ ক্রমশই অগ্রগতির পথে।
বিশেষ করে গত ১৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সারা দুনিয়ায় প্রশংসা বাণী উচ্চারিত হয়। কিন্তু নতুন করে বাংলাদেশ পরিচিতি পাচ্ছে নারীদের অবস্থান নিয়ে।
একের পর এক ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির ঘটনার সাথে যুক্ত হয়েছে এই নতুন অত্যাচার। এখন রাস্তায় একজন পুলিশ কনস্টেবল নারীকে অপমান করছে টিপ কেন পরেছে তা নিয়ে কিংবা রেল স্টেশনে হাজারও মানুষের সামনে শালীন পোশাক পরা তরুণীও আক্রান্ত হচ্ছে।
নারী শরীরের কোনো অংশ উন্মুক্ত দেখে যদি কোনো পুরুষের যৌন ক্ষুধা লাফিয়ে ওঠে, তাহলে সেই সমস্যা সেই পুরুষের নিজস্ব। এরূপ বেয়াড়া আবদারকে নিবৃত্ত করার দায় তো কোনো মতেই নারীর নয়। কিন্তু কিছু নারীও যখন এসবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন সমাজকে বোঝানো বড় কঠিন যে, অপরের পোশাক ঠিক কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে কালক্ষেপণ করা অনধিকার চর্চা।
নতুন এই সমস্যার নাম নারীর পোশাক-বিভ্রাট। আমরা নাকি এমন এক দেশে থাকি যেখানে নারীদের সম্মান নির্ভরশীল তাদের পোশাকের বহরের উপর। মানুষজনের বড় অংশই ধর্ষণের পশ্চাতে নারীদের ‘অশ্লীল’ পোশাককে দায়ী করতে অভ্যস্ত এখন।
এই চিন্তাধারার মৌলিক অন্যায্যতা বহু-আলোচিত, তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি মেয়েদের উন্মুক্ত পোশাককে পুরুষের উত্তেজনার কারণ বলে স্বীকার করেন নারীরাও, শিক্ষিতজনেরাও, তাহলে বলতেই হবে কাবুলকে কবুল করা হয়ে গেছে মনে মনে।
মন চাইল আর তৎক্ষণাৎ পোশাকের অজুহাতে একজন নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম—এরকম স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার সভ্য সমাজে স্বতঃসিদ্ধ হতে পারে না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেটিই হচ্ছে।
নারী শরীরের কোনো অংশ উন্মুক্ত দেখে যদি কোনো পুরুষের যৌন ক্ষুধা লাফিয়ে ওঠে, তাহলে সেই সমস্যা সেই পুরুষের নিজস্ব। এরূপ বেয়াড়া আবদারকে নিবৃত্ত করার দায় তো কোনো মতেই নারীর নয়। কিন্তু কিছু নারীও যখন এসবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন সমাজকে বোঝানো বড় কঠিন যে, অপরের পোশাক ঠিক কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে কালক্ষেপণ করা অনধিকার চর্চা।
পোশাক হবে আরামদায়ক, স্বচ্ছন্দ, সুবিধাজনক। যেই হোক না কেন, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী, আমলা, রাজনীতিক বা ব্যবসায়ী, কারখানা শ্রমিক। যে পোশাকে যে স্বচ্ছন্দ, সেটাই তার ড্রেসকোড।
সমাজ-নির্মিত যে কাম্য ও স্বীকৃত নারীত্ব, এই লিঙ্গ-নির্মাণের অনেকগুলো বিধি-নিষেধের একটি প্রধান খাত মেয়েদের পোশাক। তার প্রতিফলন এসব ঘটনা। নারীর হাঁটু, গ্রীবা, বাহুমূল কিংবা ক্লিভেজ অনাবৃত থেকে গেলে যদি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাহলে এই সমাজ গেল কোথায়? উন্নয়নটা হলো কোনখানে?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন