মোটরসাইকেল কীভাবে দূরপাল্লার পরিবহন হয়
সবকিছু স্বাভাবিক থাকার পরও এ বছরে সড়ক পথের ঈদযাত্রা ছিল তুলনামূলক অনেক স্বস্তির। শেষ কবে সড়ক পথের ঈদযাত্রায় যানজট এতটা কম ছিল তা অনেক চেষ্টা করেও বের করতে পারলাম না। ঢাকায় ফেরার পথে কিছু কিছু জায়গায় যানজট ছিল তবে তা খুব দ্রুতই আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।
এর পেছনে আমার মতে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। প্রথমটি হলো, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, যানজট হয় এমন কয়েকটি স্থানে ফ্লাইওভার তৈরি করে গ্রেড সেপারেশন করে দিয়েছে এবং কিছু নতুন ব্রিজ নির্মাণ করেছে যা ভালো ফল দিয়েছে, যেমন ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অতীতে যেমন মাইলের পর মাইল যানজট লেগে যেত এবার তা দেখা যায়নি। এছাড়াও রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের দিকটিও এবার বেশ ভালোভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ হলো, অন্য সব ঈদের সময়ের তুলনায় এবার পুলিশের তৎপরতা অনেক বেশি ছিল। সাধারণত রাস্তার সংযোগস্থলে বাস বা অন্যান্য যান দীর্ঘক্ষণ থেমে থাকা বা জটলা করার কারণে যানজট সৃষ্টি হতো, কিন্তু এবার পুলিশ এ ব্যাপারে খুব তৎপর ছিল তাই যানজট সৃষ্টি হতে পারেনি।
এছাড়াও এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত দুই লেনের রাস্তাকে একমুখী চলাচলের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তাও বেশ ভালোভাবে কাজ করছে যদিও ঢাকামুখী যানবাহনকে বেশ কিছুটা পথ ঘুরে আসতে হয়েছে। এই দুটি ব্যাপারে সরকার বিশেষ করে সড়ক ও জনপদ ও বাংলাদেশ পুলিশ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে।
তৃতীয় কারণ হলো, ঈদযাত্রায় বিপুল পরিমাণে মোটরসাইকেলের ব্যবহার। সড়ক পথের যানজটের ভয়, বাসের অতিরিক্ত ভাড়া বা সিট পেতে ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে বিপুল সংখ্যক মানুষ মোটরসাইকেলে করে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে।
মোটরসাইকেলে দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন সাময়িক সময়ের জন্য আমাদের স্বস্তি দিলেও এ ব্যবস্থা টেকসই এবং নিরাপদ নয়। ইতিমধ্যে অনেক সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য আসছে যেখানে অর্ধেকের বেশি হলো মোটরসাইকেল সংক্রান্ত দুর্ঘটনা।
এমনকি অনেক সময় বাস যখন যাত্রীর অভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তখন পাশ দিয়ে নিজের বা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে করে মানুষ ঈদযাত্রা করেছে। যেহেতু মোটরসাইকেল কোনো জায়গায় না থেমে বা বিকল্প অনেক পথ দিয়ে চলতে পারে তাই মহাসড়কের কিছু যাত্রী চাপ কমে গিয়েছে।
মোটরসাইকেলে দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন সাময়িক সময়ের জন্য আমাদের স্বস্তি দিলেও এ ব্যবস্থা টেকসই এবং নিরাপদ নয়। ইতিমধ্যে অনেক সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য আসছে যেখানে অর্ধেকের বেশি হলো মোটরসাইকেল সংক্রান্ত দুর্ঘটনা।
ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার সাময়িক স্বস্তি দিলেও ঈদের সময়ে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের যে সম্পৃক্ততা দেখা যাচ্ছে তা বেশ অনুমেয় ছিল এবং এই প্রবণতা যদি আমরা অভ্যাসে পরিণত করি তাহলে অদূর ভবিষ্যতে মহাসড়কের এক আতঙ্কের নাম হবে মোটরসাইকেল।
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এভাবে চলতে থাকলে এটা শুধু ঈদযাত্রাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না আস্তে আস্তে বছরের অন্যান্য সময়েও মানুষ দূরের যাত্রায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল ব্যবহার করবে। অতি ব্যবহারের অন্যতম কারণ হলো এর সহজলভ্যতা এবং এর সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে উদাসীনতা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিএ) এর মার্চ-২০২২ পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাব অনুসারে ঢাকা শহরে রেজিস্ট্রেশনকৃত মোট যানবাহনের সংখ্যা ১৮ লক্ষ ১০ হাজার দুইশত পঁচাত্তর, তার মধ্যে ৯ লক্ষ ১৪ হাজার আটশত সতেরো হলো মোটরসাইকেল যা মোট মোটরযানের ৫১ শতাংশ।
একইভাবে পুরো বাংলাদেশের হিসাবে মোট যানবাহনের প্রায় ৭০ শতাংশ হলো মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল একটা ঝুঁকিপূর্ণ বাহন হিসেবে পুরো পৃথিবীতেই পরিচিত। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ জড়িত রয়েছে। প্রথমত, মোটরসাইকেলের স্থিতিশীলতা বা স্টাবিলিটি কম থাকে, যেকোনো সময় চাকা পিছলে গিয়ে বা রাস্তায় পড়ে থাকা বস্তুর সাথে লেগে তা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মোটরসাইকেলে যাত্রী ও চালক উভয়েই উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে তাই যেকোনো দুর্ঘটনায় হতাহতের মাত্রা বেশি হয়ে থাকে। তৃতীয়ত, মোটরসাইকেল আকারে অন্যান্য যান থেকে ছোট হওয়ার কারণে দৃষ্টিগোচর হয় কম, বিশেষ করে রাতের বেলা বা খারাপ আবহাওয়ায় এ ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ভারী মোটরযানের কারণে ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঈদের সময়, অতিরিক্ত ব্যাগ নিয়ে চলাচল এই ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
মোটরসাইকেল একটা ঝুঁকিপূর্ণ বাহন হিসেবে পুরো পৃথিবীতেই পরিচিত। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ জড়িত রয়েছে। প্রথমত, মোটরসাইকেলের স্থিতিশীলতা বা স্টাবিলিটি কম থাকে...
আমাদের দেশে মোটরসাইকেলের অনুমোদিত সর্বোচ্চ সিসি হল ১৬৫ সিসি যদিও বেশিরভাগ মোটরসাইকেল ১৫০ সিসি বা তার কম সক্ষমতার হয়ে থাকে। ১৫০ সিসি থেকে শুরু করে ১৬৫ সিসি মানের একটি মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতি হয়ে থাকে প্রায় ১২০ কিমি/ঘণ্টা।
মহাসড়কে চলাচলের জন্য ন্যূনতম ১৫০ সিসি মানের মোটরসাইকেল হওয়া প্রয়োজন কিন্তু ঈদযাত্রায় এর চাইতেও কম সিসি-র মোটরসাইকেল চলাচল করেছে যেগুলো দূরের যাত্রার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয় কারণ এদের ওজন কম হয়ে থাকে ও স্টাবিলিটিও কম হয়ে থাকে।
এখন দেশের মোট মোটরযানের প্রায় ৭০ শতাংশই যদি হয় এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাহন যা লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে তা স্বল্প দূরত্ব থেকে শুরু করে আন্তঃজেলা চলাচল করে গণপরিবহনের বিকল্প হয়ে যাচ্ছে তখন শুধুমাত্র যানজট কম হয়েছে মনে করে যদি আমরা আত্মতুষ্টিতে থাকি তবে তা হবে বোকামি।
মোটরসাইকেল কখনোই গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না বিশেষ করে ঈদযাত্রায় যেভাবে মানুষ পরিবার ও মালামালসহ একে মহাসড়কে ব্যবহার করেছে তা যেন অভ্যাসে পরিণত না হয় সেজন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, ১৫০ সিসি-এর কম কোনো মোটরসাইকেল যাতে মহাসড়কে চলাচল না করে সে বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, চালকসহ দুইজন যাত্রীর বেশি বহন না করা এবং সবার মান-সম্মত হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রায় দেখা যায়, বাবা-মা হেলমেট পরিধান করলেও শিশুদের হেলমেটবিহীন অবস্থায় যাত্রা করেন। শিশুদের ও হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়াও যেকোনো যাত্রার শুরুতে মোটরসাইকেলের অবস্থা ও আবহাওয়ার অবস্থা ভালোভাবে দেখে নিতে হবে কারণ বৃষ্টি বা বৈরী আবহাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও মোটরসাইকেল চালনার সময় সামনের গাড়ির ব্লাইন্ড স্পটের বাইরে থাকতে হবে এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
তবে দীর্ঘ মেয়াদে রাস্তার শৃঙ্খলা বৃদ্ধি ও দুর্ঘটনা কমানোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ বাহনকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পৃথিবীর অনেক দেশ মোটরসাইকেলের আধিক্যের কারণে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে এ বাহনকে বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, যেমন ভিয়েতনামের হ্যানয় (Hanoi) শহরে ২০৩০ সালের পর থেকে মোটরসাইকেলের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশেও নিকট ভবিষ্যতে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে তাই এখনই প্রয়োজন সঠিক কৌশল গ্রহণ করা এবং সড়কের পাশাপাশি রেল ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারিত করা।
কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট