পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা
আমাদের এই সভ্যতার ইতিহাস মূলত পরিব্রাজক বা পর্যটকদের হাতে গড়া ইতিহাস। হিরোডোটাসের ইতিহাস গ্রন্থই বলুন অথবা হিউয়েন সাং, ফা-হিয়েন, মার্কো পোলো, ইবনে বতুতা বা আল-বেরুনীর মতো পরিব্রাজক বা ভূ-পর্যটকেরা সেই কত প্রাচীন যুগেই যখন এত আধুনিক যানবাহন কিছুই ছিল না, পদব্রজে অথবা মাসের পর মাস ক্যারাভানে দীর্ঘ ও প্রাণক্ষয়ী যাত্রায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে জেনেছেন পৃথিবীর পরিচয়। এবং সেই পরিচয় জানিয়েছেন অন্যদেরও।
আলেকজান্ডারের সেনাদলের সাথে আসা গ্রিকরা লিখেছেন, ভারত তথা বাংলা অবধি আমাদের উপমহাদেশীয় সভ্যতার কথা। মধ্যযুগে আল-বেরুনী লিখছেন, ‘ভারত তত্ত্ব’। মার্কো পোলোর অভিযাত্রার কাহিনি পড়ে মুগ্ধ ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ লিখেছেন ‘কুবলাই খান’।
ইবনে বতুতা বাংলাদেশে এসে যা দেখছেন তাই বিধৃত করছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। হিউয়েন সাং বা ফা-হিয়েনরাও ঘুরে গেছেন বাংলার সপ্ত জনপদ। তারও পরে কলম্বাস বা ম্যাগিলান দ্য ড্রেকের মতো অভিযাত্রীরা দক্ষিণ আমেরিকার মতো অজানা নানা মহাদেশের অবগুণ্ঠন উন্মোচিত করছেন।
সত্যি বলতে, এই একবিংশ শতকে মানব সভ্যতা তার যাবতীয় সীমাবদ্ধতাসহ অর্থনীতি-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-পোশাক-রন্ধন-সঙ্গীত-স্থাপত্য-চিত্রকলাসহ এই তুঙ্গস্পর্শী মহিমা কখনোই অর্জন করতে পারত না যদি ‘ভ্রমণ’ বস্তুটি না থাকত।
মিশরের পিরামিড-স্ফিংকস-প্যাপিরাস, চীনের রেশমী কাপড় থেকে কনফুসিয়াস, গ্রিক দর্শন-বিজ্ঞান-সাহিত্য, দক্ষিণ আমেরিকার মায়া বা ইনকা থেকে সমরকন্দের মঙ্গোলীয় মান-মন্দির, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান, সুমেরীয়-ভারতীয়-পার্সি মহাকাব্য গিলগামেশ-রামায়ণ-মহাভারত-শাহনামেহ, পার্সেপোলিস থেকে মহেঞ্জোদারো অথবা আমাদের আজকের রান্নাঘরে মোগলাই পোলাও নামের খাবারটি পর্যন্ত যে সেই তাজিকিস্তান-উজবেকিস্তান হয়ে আসা...এসবই সম্ভব হয়েছে একমাত্র আন্তঃমহাদেশীয় ভ্রমণের মাধ্যমে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’ থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘জাপানযাত্রী’ বা বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এর মতো পৃথিবীর যাবতীয় ভ্রমণ সাহিত্যের পাঠও পাঠকের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিতে প্রবলভাবে সক্ষম।
অথচ গভীর দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এটিই যে, স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাসে আমরা আজ পর্যন্ত একটি নিরাপদ, পর্যটকবান্ধব ও নারীর প্রতি সমতাপূর্ণ একটি পর্যটন শিল্পের অবকাঠামো আজও গড়ে তুলতে সক্ষম হলাম না। হ্যাঁ, হয়তো ছোট একটি দেশ আমাদের।
রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’ থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘জাপানযাত্রী’ বা বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এর মতো পৃথিবীর যাবতীয় ভ্রমণ সাহিত্যের পাঠও পাঠকের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিতে প্রবলভাবে সক্ষম।
এমনিক প্রতিবেশী ভারতের মতো হিমাচল বা অরুণাচল থেকে রাজস্থান বা কাশ্মীর অবধি মরুভূমি, তুষারাচ্ছন্ন পর্বত থেকে নদীমাতৃক সমভূমি ও আর্যাবর্ত বা উত্তরাপথ থেকে দাক্ষিণাত্য অবধি নানা প্রাসাদ-সৌধ-মন্দির-মসজিদসহ বিচিত্র স্থাপত্যের সম্ভার নেই আমাদের। কিন্তু যা আছে বা ছিল সেটুকু সাজিয়ে-গুছিয়েও কিন্তু পর্যটন শিল্পকে আমাদের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে গড়ে তোলা যেত।
কক্সবাজারের ৯৬ মাইল বা ১৫৫ কি.মি. ব্যাপ্ত পরিসরে অতি দীর্ঘ ও অভগ্ন সমুদ্র সৈকত, সিলেটের চা বাগান-জাফলং থেকে শুরু করে খাসিয়া-মণিপুরী নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উত্তর বাংলা বা নদীমাতৃক বরিশাল...প্রকৃতি এই ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের দেশকে কম তো দেয়নি।
অথচ, একাধিকবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বিদেশি পর্যটক বিশেষত, নারী পর্যটক হেনস্থা বা আক্রান্ত হওয়ার কথা যদি বাদই দিই, এবার ঈদের ছুটিতে সিলেটের জাফলংয়ে পর্যটকদের উপর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের হামলা বা প্রহারের ভিডিও ইতিমধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এবং জাফলংয়ের পরপরই নাটোরেও এমনটি ঘটেছে বলে খবর এসেছে।
এরা কিন্তু বহিরাগত বা বিদেশি পর্যটকও নন। বাংলাদেশেরই সাধারণ নর-নারী। এমনটাও নয় যে কোনো বিদেশিনীর ভিন্ন ধাঁচের পোশাকে বহির্পৃথিবী চোখে না দেখা কতিপয় বাংলাদেশি যুবক অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে।
যে বাংলাদেশে নারী গত পঞ্চাশ বছরে নিজেই নিজেকে ক্রমাগত আরও পর্দায় ঢাকছে, সেই বাংলাদেশে কেন কোনো পার্বণে বা ছুটিতে সপরিবারে বা সবান্ধব কিছু মানব-মানবী ঘুরতে গেলেও চাঁদাবাজি থেকে দৈহিক হামলা, অশালীন কটুক্তি বা থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো হয়রানির শিকার হবেন?
থাইল্যান্ডের পাতায়া বিচ পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই, এমনকি ঢাকা থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার বিমান যাত্রার দূরত্বের শহর কলকাতায় মেয়েরা হরদম যেকোনো পোশাকে ঘুরছে-ফিরছে, সেখানে এত হয়রানি হয় না কেন? আর বাংলাদেশে একটি মেয়ে চৈত্র-বৈশাখের দরদর ঘামসহ গরমে হাত-পা-নাক-চোখ সব ঢেকেও কেন রেহাই পাবে না? এত উত্তেজনা কেন ও কীসের?
৫ মে ২০২২ তারিখে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যাচ্ছে যে, ‘বৃহস্পতিবার (৫ মে) দুপুরে জাফলং পর্যটন এলাকায় ঈদুল ফিতরের ছুটিতে জাফলংয়ে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের বেধড়ক লাঠিপেটা করেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকেরা। এ সময় তারা নারী পর্যটকদেরও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন।
একাধিকবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বিদেশি পর্যটক বিশেষত, নারী পর্যটক হেনস্থা বা আক্রান্ত হওয়ার কথা যদি বাদই দিই, এবার ঈদের ছুটিতে সিলেটের জাফলংয়ে পর্যটকদের উপর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের হামলা বা প্রহারের ভিডিও ইতিমধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ঈদের দিনগুলোতে প্রবেশ টিকিট বিক্রি ও ছবি তোলার নামে স্বেচ্ছাসেবক নামধারী কতিপয় যুবক পর্যটকদের সঙ্গে চাঁদাবাজি করছিলেন। একটি ছবি তুলে তারা পর্যটকদের জিম্মি করে ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা দাবি করেন।
এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের জের ধরে পর্যটক এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় থাকা কতিপয় যুবক পর্যটকদের ওপর বেপরোয়া হয়ে হামলা চালান। তারা বাঁশের লাঠি দিয়ে পর্যটকদের পেটাতে থাকেন। এ সময় তরুণীরা তাদের সঙ্গীদের বাঁচাতে এগিয়ে গেলে তাদেরও মারধর, হেনস্তা করা হয়। স্থানীয়রা ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করলেও কেউ এগিয়ে আসেননি।’
ঐ প্রতিবেদনের শুরুতেই আরও বলা হচ্ছে, “এ ঘটনার পর উঠে এসেছে নেপথ্যে উন্নয়ন কমিটির নামে ‘চাঁদাবাজি’। স্থানীয় কতিপয় নেতাকর্মী তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা স্বেচ্ছাসেবক চক্র। চক্রের সদস্যরা লাখ লাখ পর্যটকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে ভাগবাটোয়ারা করে নেন। এর নেপথ্যে আছেন ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতাকর্মী, যারা জাফলং শাসন করেন। এজন্য উপজেলা প্রশাসন ও পর্যটন উন্নয়ন কমিটিকে দায়ী করছেন বিভিন্ন মহল। পরিচ্ছন্নতার নামে ১০ টাকা চাঁদা আদায়ের ঘটনা জানে না জেলা পুলিশও।”
অথচ “সিলেটের জাফলংয়ে ‘প্রবেশ ফি’ চালু” এই শিরোনামে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এর ২৮ নভেম্বর ২০২১-এর এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে যে, ‘জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) দেশের পর্যটন খাতের অবদান ৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার বেশি।’
পর্যটন নিয়ে বিবিএস কর্তৃক প্রথমবারের মতো প্রকাশিত প্রতিবেদন ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট-২০২০ অনুসারে মোট কর্মসংস্থানের ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশের সুযোগ তৈরি করছে এই খাত। প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।
শুধু মিশর-গ্রিস-চীন বা ভারতের মতো প্রাচীন সভ্যতার দেশগুলোই নয়, পড়শি নেপাল বা শ্রীলঙ্কার আয়ের একটি বড় অংশও পর্যটন শিল্প থেকে আসে। কোভিডের দু’বছরে পর্যটনে আয় কমে যাওয়ার কারণে ইতিমধ্যে নেপাল বা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে বিপুল ধস নেমেছে। থাইল্যান্ড থেকে কিউবা অবধি নানা দেশেই পর্যটন রাষ্ট্রীয় আয়ের একটি বড় খাত।
মালয়েশিয়ায় বিচক্ষণ শাসক মাহাথির মোহাম্মদ সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের তাদের সব ধর্মীয় রীতি-নীতি পালনের সুযোগ দানের পাশাপাশি পর্যটন এলাকায় বিদেশি টুরিস্টদের জন্য কিন্তু তারা পানাহার বা পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সময় অতিবাহিত করতে পারেন, সেই সুযোগ দিয়েছেন।
বলা বাহুল্য, এটুকু রাষ্ট্রীয় কোষাগারের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যেই করা হয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটনের বিকাশে ততটুকু যৌক্তিক, উদার ও আধুনিক কি আর কোনোদিনই হতে পারবে?
অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক