গ্রহাণুবিরোধী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ার চীনা পরিকল্পনা
প্রকাণ্ড একটা গ্রহাণু প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে। সংঘর্ষ অনিবার্য। পৃথিবীকে, পৃথিবীর মানবসভ্যতাকে বুঝি আর বাঁচানো গেল না! শেষ চেষ্টা হিসেবে মহাশূন্যে একদল অকুতোভয় নভোচারীকে পাঠালেন বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। নভোচারীরা সঙ্গে নিলেন যথেষ্টসংখ্যক পারমাণবিক বোমা। উদ্দেশ্য, বোমা ফাটিয়ে গ্রহাণুকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে পৃথিবীকে, পৃথিবীর প্রাণীকুলকে রক্ষা করা।
কিন্তু সবকিছু পরিকল্পনামাফিক ঘটল না। কয়েকটি বোমা গ্রহাণুতে স্থাপন করার পর টেকনিক্যাল কারণে নভোচারীরা নভোযান নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসতে বাধ্য হলেন। ওদিকে, বোমা ফেটে গ্রহাণু দু-টুকরো হলো বটে, তবে এর একটি তুলনামূলকভাবে খুবই ছোট। অর্থাৎ মূল গ্রহাণুর আকারে তেমন কোনো হেরফের হলো না, এর গতিপথেরও কোনো পরিবর্তন ঘটল না।
গ্রহাণুর ছোট টুকরা এসে পড়ল পৃথিবীর মহাসাগরে, সৃষ্টি করল এক ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেল নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বড় শহর; ধ্বংস হয়ে গেল হোয়াইট হাউস, লুটিয়ে পড়ল স্ট্যাচু অব লিবার্টি।
আসল বিপদ এখনো বাকি। ধেয়ে আসছে গ্রহাণুর মূল অংশ। এটি পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! শেষমেশ অকুতোভয় নভোচারীরা নিয়ে ফেললেন এক কঠিন সিদ্ধান্ত, বাকি সবকটি পারমাণবিক বোমাসহ নভোযান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন গ্রহাণুর মূল অংশের ওপর। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে লক্ষ-কোটি ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে গ্রহাণু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল মহাশূন্যে; রক্ষা পেল পৃথিবী, রক্ষা পেল মানবসভ্যতা।
পাঠক ঠিকই ধরেছেন, এটি হলিউডের একটি চলচ্চিত্রের গল্প। যতদূর মনে পড়ে, চলচ্চিত্রের নাম ‘ডিপ ইম্পেক্ট (Deep Impact, 1998)’। বহু বছর আগে মুভিটা আমি দেখি। দেখে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, সত্যিই কি একদিন কোনো এক প্রকাণ্ড আকারের গ্রহাণু আমাদের এই পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে? ধ্বংস হয়ে যাবে কি গোটা মানবসভ্যতা?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, তেমন আশঙ্কা আছে। ২০০২ সালের ৯ জুলাই বিজ্ঞানীদের নজরে আসে ‘২০০২ এনটি ৭’ নামক একটি গ্রহাণু। দুই কিলোমিটার লম্বা গ্রহাণুর গতিপ্রকৃতি দেখে বিজ্ঞানীরা আতঙ্কিত হলেন। এটি সত্যি সত্যি আছড়ে পড়তে পারে পৃথিবীর বুকে! কেউ কেউ সম্ভাব্য একটি তারিখও দিয়ে দিলেন! সেই তারিখ ছিল, পহেলা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯।
বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি, তবে ঘটতে পারে। ‘২০০২ এনটি ৭’ পৃথিবীতে আঘাত না-হানলেও, ভবিষ্যতে অন্য কোনো গ্রহাণু আঘাত হানবে না—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়েক লাখ বছরে একবার এমনটা ঘটতে পারে।
লক্ষ লক্ষ বছর আগে তেমনি এক গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এইতো সেদিন, ২০১৩ সালে, রাশিয়ার চেলিয়েবিনস্ক (Chelyabinsk) শহরে আঘাত হানে একটি ক্ষুদ্র উল্কাপিণ্ড। এতে ১৬ শতাধিক মানুষ আহত হয়। গত অক্টোবরে নাসা জানায়, আগামী একশ বছরে আমাদের জানা কোনো গ্রহাণুর পৃথিবীতে আঘাত হানার আশঙ্কা নেই। সমস্যা হচ্ছে, নাসার ভাষ্যমতে, যেসব গ্রহাণুর আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে টক্কর লাগার কমবেশি আশঙ্কা আছে, সেগুলোর ৬০ শতাংশই হয়তো আমাদের জানার বাইরেই রয়ে গেছে!
গ্রহাণুকে (asteroid) বলা হয় ‘নাবালক গ্রহ’ (minor planet)। আনুমানিক ৪৬০ কোটি বছর আগে সৌরজগত সৃষ্টির সময়ই এদের উদ্ভব। তবে এগুলো ঠিক গ্রহ হয়ে উঠতে পারেনি। গ্রহাণুগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘোরে। তবে, পূর্ণ গ্রহের মতো এগুলোর কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। কোনো কোনো গ্রহাণুর চাঁদ তথা উপগ্রহাণুও আছে।
নাসার তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ১,১১৩,৫২৭টি গ্রহাণু সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। আবার মাইনর প্ল্যানেট সেন্টারের চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সরবরাহকৃত উপাত্ত অনুসারে, সৌরজগতে মোট ১,১৯৯,২২৪টি গ্রহাণু আছে। এসব গ্রহাণুর মোট ভর আমাদের চাঁদের চেয়ে কম।
আমাদের জানা গ্রহাণুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ‘সিরিস’ (Ceres)। প্রায় এক হাজার কিলোমিটার ব্যাসের এই গ্রহাণুটিকে ‘বামুন গ্রহ’-ও ডাকা হয়। আগে বিজ্ঞানীরা পৃথিবী থেকেই গ্রহাণু পর্যবেক্ষণ করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাসার গ্যালিলিও নামক নভোযান খুব কাছ থেকে বৃহস্পতি গ্রহ ও এর চাঁদ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি, প্রথমবারের মতো, গ্যাসপ্রা (Gaspra) ও আইডা (Ida) নামক গ্রহাণুদ্বয়কে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে এবং সেগুলোর ছবি পৃথিবীতে পাঠায়।
পরে অবশ্য আরও বেশ কয়েকটি নভোযান খুব কাছ থেকে বিভিন্ন গ্রহাণু পর্যবেক্ষণ করেছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি গ্রহাণু থেকে নমুনাও সংগ্রহ করতে পেরেছে। গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা আছে চীনেরও।
সম্প্রতি গ্রহাণুকেন্দ্রিক আরেকটি নতুন পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে চীন। এ পরিকল্পনা অনুসারে, ভবিষ্যতে দেশটি গ্রহাণুর সম্ভাব্য আঘাত থেকে পৃথিবী ও পৃথিবীর প্রাণীকুলকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবে।
গত ২২ এপ্রিল চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসনের উপ-পরিচালক উ ইয়ানহুয়া বেইজিংয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থিত গ্রহাণুগুলোর শ্রেণিবিভাগ করতে এবং কোন কোন গ্রহাণু পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ, তা চিহ্নিত করতে হবে। এরপর সেসব গ্রহাণুর সম্ভাব্য আঘাত মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করতে হবে।
পরিকল্পনা অনুসারে চীন বিপজ্জনক গ্রহাণুর বিরুদ্ধে ভূমিভিত্তিক ও মহাকাশভিত্তিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এক্ষেত্রে চীন অন্যান্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবে এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তি আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে শেয়ার করবে।
উ ইয়ানহুয়া আরও জানান, ২০২৫ বা ২০২৬ সালে চীন পরীক্ষামূলকভাবে একটি নভোযান মহাকাশে পাঠাবে। এই মহাকাশযানের কাজ হবে কোনো একটি নির্দিষ্ট গ্রহাণুকে—যেটি পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ—খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা এবং সেটির গতিপথ পরিবর্তন করে দেওয়া। যদি চীন তেমন একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সফলভাবে গড়ে তুলতে পারে, তবে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো গ্রহাণুকে ঠেকাতে পারমাণবিক বোমা সমৃদ্ধ নভোযান পাঠাতে হবে না।
বস্তুত, চীনই একমাত্র দেশ নয় যে গ্রহাণুর সম্ভাব্য আঘাত নিয়ে চিন্তিত। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা ও পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক গ্রহাণু থেকে বাঁচতে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০২১ সালের নভেম্বরে নাসা ‘ডার্ট’ (DART) নামের একটি নভোযান মহাকাশে পাঠায়।
এই নভোযানটি একটি গ্রহাণুর চাঁদ তথা উপগ্রহাণুর উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে। এ মিশনের লক্ষ্য এটা পরীক্ষা করে দেখা যে, নভোযানের সাথে সংঘর্ষের ফলে উপগ্রহাণুর গতিপথ বদলে যায় কি না এবং পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো গ্রহাণুর গতিপথ বদলে দিতে একই পদ্ধতি কাজে লাগানো যায় কি না। আশা করা হচ্ছে, আগামী সেপ্টেম্বরে ‘ডার্ট’ লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাবে।
চীনও একাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ ও ভূমিভিত্তিক স্থাপনাদির মাধ্যমে এমন একটি ব্যাপক ‘ট্র্যাকিং অ্যান্ড আর্লি-ওয়ার্নিং নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলতে চায়, যার মাধ্যমে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা যেকোনো গ্রহাণুর হুমকি মোকাবিলা করা যাবে।
চীন মহাকাশ-গবেষণায় ও রকেট শিল্পে ইতিমধ্যেই অনেক উন্নতি করেছে। দেশটির পক্ষে এমন একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অসম্ভব হওয়ার কথা নয়। তবে, অসম্ভব না-হলেও, কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই।
বেইজিংয়ের মহাকাশ-শিল্প পর্যবেক্ষক ফাং চিহাও যথার্থই বলেছেন যে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে চীনকে অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা আয়ত্ত করতে হবে।
২০০১ সালে একটি গ্রহাণু পৃথিবীর মাত্র পঁচাত্তর হাজার মাইলের মধ্যে চলে এসেছিল। কিন্তু সেটি পৃথিবীকে আঘাত করেনি। আবার ২০১৯ সালেও কারো কারো ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে একটি গ্রহাণু পৃথিবীর ওপর আছড়ে পড়েনি। কিন্তু পৃথিবীর কাছাকাছি ঘুরপাক খাওয়া যে ৬০ শতাংশ গ্রহাণু সম্পর্কে আমরা জানি না, সেগুলোর যেকোনো একটা সময় আমাদের দিকে ধেয়ে আসবে না, এমন নিশ্চয়তাও নেই।
আর যতদিন এমন সম্ভাব্য মারাত্মক ঘটনা এড়ানোর ক্ষমতা মানুষ অর্জন না করবে, ততদিন ভয় আর আতঙ্ক থেকেই যাবে। তাই, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আর যেহেতু গ্রহাণু আঘাত হানলে গোটা বিশ্বই বিপর্যস্ত হবে, সেহেতু এই বিপদ মোকাবিলায় বিশ্বের সকল দেশকেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে বা করা উচিত।
আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)