শিক্ষার সংকটের একটি দিক
একটা রাষ্ট্র কতটুকু এগিয়েছে তা বোঝার জন্য দিল্লি-হিল্লি-তত্ত্বদর্শন করা লাগে না। ওই দেশের শিক্ষার দিকে তাকালেই যথেষ্ট। এ হচ্ছে হাঁড়ির ভাত টেপার মতো। সব টেপার প্রয়োজন হয় না। রাষ্ট্রের অন্যান্য সেক্টরের কী অবস্থা তা শিক্ষার অবস্থা দেখলে বোঝা যায়। কারণ, রাষ্ট্রের শিক্ষার ছাঁচে মানুষ তৈরি হয়ে তারাই রাষ্ট্রের সব অঙ্গে রক্তধারার মতো ছড়িয়ে পড়ে।
এজন্য উন্নতিকামী এবং উন্নত সব রাষ্ট্রই চায় তার জনগোষ্ঠীকে যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। বলা দরকার, শিক্ষা বলতে আমি অবশ্যই পাস করা বিদ্যাকে বোঝাচ্ছি না। আমি শিক্ষা বলতে বোঝাচ্ছি সেই ব্যবস্থাকে, যার মাধ্যমে দেহের, মনের, চিন্তাশক্তির একটা পর্যালোচনামূলক বিকাশ হয়।
একটা মানবশিশু যখন রাষ্ট্রের শিক্ষা পদ্ধতির স্পর্শে যায় তখন তার এই ঘটনা ঘটার কথা। তবে কেউ রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে থেকেও শিক্ষিত হতে পারে। এই লেখায় বাংলাদেশের শিশুদের স্কুলে ঢোকার আগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে বের হওয়া পর্যন্ত বিবর্তনের একটা পর্যবেক্ষণ হাজির করতে চাই। একইসাথে ওই বিবর্তনের ফলেরও একটা আভাস দিতে চাই।
এক.
সবার খেয়াল করার কথা যে, ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব শিশুই স্কুলে ঢোকার আগে ‘মেধাবী’ থাকে। আমি অন্তত কারো মুখে শুনিনি যে, তার শিশুসন্তান অমেধাবী। সবাই বলে তার সন্তানের যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাতে করে সে বড় হলে বিরাট কিছু হবে।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার, কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী গোছের কিছু একটা। কারণ হিসেবে সবাই উল্লেখ করেন তার শিশুর প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা, উপস্থিত বুদ্ধির কথা, ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতার কথা। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানের মধ্যে লক্ষ করেন আবিষ্কারের নেশা এবং এতটুকুন বয়সে গুরুতর কথা বলার বিস্ময়কর ক্ষমতা।
মোটকথা, জন্মের পর থেকে স্কুলে ঢোকার আগ পর্যন্ত সব শিশুই অপার সম্ভাবনাময় থাকে। এজন্যই কি শিশুদের বলা হয় ‘দেবশিশু’। এই দেবশিশুরা বিরাট একটা সম্ভাবনা নিয়েই দেশের বিদ্যালয়গুলোতে ঢোকে বিদ্যার্থী হিসেবে। কিন্তু স্কুলে ঢোকার পর ক্রমে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে মেধাবী-অমেধাবী বলে বর্গীকরণ শুরু হয়।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল, শিক্ষার্থীর বিবেচনাবোধের বিচিত্র চোখ খুলে দেওয়া। ক্রিটিক্যাল মনস্তত্ত্ব তৈরি করা। কিন্তু আমাদের শিক্ষা তো মূলত বিশুষ্ক বদনে কিছু প্রশ্ন মুখস্থ করার মহোৎসব। শিশুশ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একই হাল।
কিছু শিশু স্কুলে ‘ভালো ফল’ করে। আমরা তাদের বলি ‘ভালো ছাত্র’ বা ‘মেধাবী ছাত্র’। কিছু ‘মাঝারি’ আর কিছুকে বলি পড়াশোনায় ‘অতটা ভালো না’। সময় যাওয়ার সাথে সাথে কিছু অদলবদলও লক্ষ করা যায়। মাঝারি বা খারাপ বলে পরিচিতি পাওয়া শিশুরা উপরের ক্লাসে গিয়ে হঠাৎ যেন কোনো অদৃশ্য ইশারায় ভালো ছাত্র বনে যায় (আসলে স্কুল পাঠ্যে আগের চেয়ে অধিক মনোযোগ বাড়ানোর কারণে এমন হয়)।
ভালো অনেকেই আবার খারাপ বলে সাব্যস্ত হয় (পাঠে মনোযোগ কম, ফলে এই ঘটনা ঘটে)। শেষোক্তদের হাল-হকিকত দেখে অধিকাংশ শিক্ষক-অভিভাবক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, পড়াশোনায় তাদের ভবিষ্যৎ নেই। এভাবে ওই শিশুকালের অধিকাংশ অসাধারণ শিশু সাধারণ হতে থাকে। এক পর্যায়ে অসাধারণ শিশুটি নিজেও পড়াশোনার বিষয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে কোনো মতে গড়াতে গড়াতে শিক্ষাজীবন শেষ করে। কেউ কেউ শেষও করতে পারে না বা করে না।
আমি কলেজ পর্যায়ের অধিকাংশ ছাত্রকে দেখেছি খারাপ ছাত্রের গ্লানি নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনোমতে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখি থোকা থোকা বিষণ্ন ছাত্র ক্লাসে না-আসলে ভালো হতো মনে করে এসে বসে আছে। দেখে মনে হয়, তারা অনেকটা বাপে না জিঞ্জাসে মায়ে না সম্ভাষে কিসিমের। এই পরিস্থিতি শুধু কলেজ পর্যায়ে নয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়েও আছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও আছে। সেখানে বিষণ্নতার সাথে আরও লক্ষ করি আতঙ্ক। এই বিদ্যা লইয়া ভবিষ্যতে আমি কী করিব টাইপের আতঙ্ক।
আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ ‘ভালো ছাত্রদের’ নিয়ে নয়। আমি ভাবি ‘খারাপ ছাত্রদের’ নিয়ে। ভাবি, কী করে খারাপ ছাত্র বা গড়পড়তা ছাত্রের তকমা লাগল একদা অসাধারণ ওইসব দেবতুল্য শিশুর গায়ে! তাদের এই পরিস্থিতির সাথে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কি কোনো সম্পর্ক আছে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি অসংখ্য শিশুকে কাঠামোগতভাবে বিষণ্ন আর ধ্বংস করে! খতিয়ে দেখা দরকার।
মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবীতেই আনুষ্ঠানিক-একাডেমিক পড়াশোনা আরোপণমূলক। একাডেমি মানেই জবরদস্তিমূলক ব্যাপার। এই জবরদস্তির কথা মনে করেই পৃথিবীব্যাপী শিক্ষাকে এমনভাবে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয় যেন শিক্ষার্থীর জন্য তা বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়। আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শিক্ষার্থীর জন্য অধিক জবরদস্তিমূলক যাতে না হয় সেজন্য শিক্ষার্থীর ঝোঁক পর্যবেক্ষণ করা হয়।
প্রতিষ্ঠান আর অভিভাবকের মধ্যে পর্যাপ্ত সংলাপ ও সলা-পরামর্শের ব্যবস্থা করা হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে যখন তার আগ্রহের দিকে যেতে দেওয়া হয় তখন তার পড়ার সাথে যুক্ত হয় আনন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ততা। আসলে তাই-ই দরকার। কারণ, পৃথিবীতে সবাই একই কাজ করার জন্য একই চেতনা আর একই যোগ্যতা নিয়ে জন্মায় না। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মনে করে, সবাই একই ছত্রের নিচে গাদাগাদি করে যদি না দাঁড়াল তো সে আর ছাত্র কীসের!
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই ভয়াবহ আরোপণমূলকতা আর একরূপতার আকাঙ্ক্ষা তিলে তিলে একটা মেধাবী শিশুকে বিষণ্ন, হীনম্মন্য আর অযোগ্য করে তোলে। এই অযোগ্যতা, বিষণ্নতা আর হীনম্মন্যতার বিষবৃক্ষ জাতীয় জীবনকে কেমন কিম্ভূত ও বিকৃত করে তোলে তা বাংলাদেশ রাষ্ট্রপরিচালনার সাথে যুক্ত অধিকাংশ এজেন্সির মানুষের সাথে কথা বললেই বোঝা যায়।
দুই.
একমাত্রিক বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছে একতরফা মাতব্বরি-মাস্তানির কারখানা। যে কারণে দেখা যায়—বিশেষত সাম্প্রতিক দিনগুলোতে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, এমনকি সাধারণ মানুষের সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যেন খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক।
শিক্ষার্থীরা তাদের অনিচ্ছায় ও নিরানন্দে গলাধঃকরণ করা একতরফা মাস্তানি-শিক্ষার জবরদস্তির প্রকাশ ঘটায় হেলমেট পরে মানুষ হত্যার উৎসবে মেতে, কখনো শিক্ষককে পিটিয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেঙে, আবার কখনো সহপাঠীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। আমরা একেই আদর করে নাম দিয়েছি আন্দোলন, প্রতিবাদ, কখনো কখনো বেয়াদবি বা নির্মমতা। এর সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতির সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ওই স্বাচ্ছন্দ্যে মানিয়ে না নিতে পেরে অন্তর্গতভাবে ছিটকে পড়া শিক্ষারও সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল, শিক্ষার্থীর বিবেচনাবোধের বিচিত্র চোখ খুলে দেওয়া। ক্রিটিক্যাল মনস্তত্ত্ব তৈরি করা। কিন্তু আমাদের শিক্ষা তো মূলত বিশুষ্ক বদনে কিছু প্রশ্ন মুখস্থ করার মহোৎসব। শিশুশ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একই হাল। ফলে আপনি এমএ পাস একজন লোকের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারবেন না। লোকটাকে মনে হবে নেহায়েত ‘অশিক্ষিত’ ও ‘অবিবেচক’। সে তো একটা একমুখী পর্যালোচনাহীন বিশ্বাসী মনস্তত্ত্ব নিয়ে বেড়ে উঠেছে।
হুজুগে বাঙালি শব্দবন্ধের একটা উৎস এখানেও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। পিঠা তো ছাঁচ অনুযায়ীই হবে, নাকি! শিক্ষার ছাঁচ অনুযায়ী গঠিত এই মানুষেরাই তো নানাভাবে রক্তের ধারার মতো ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের দেহের ভেতরে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তো আলাদা কোনো আচরণ সেই, চিন্তা নেই, সংস্কৃতি নেই। এদের আচরণ-উচ্চারণ, আদব-লেহাজ, চিন্তা-ভাবনা, সংস্কৃতিই বাংলাদেশের আচরণ, চিন্তা ও সংস্কৃতি। এটাই বাংলাদেশ। এই-ই বাংলাদেশের শিক্ষা-কারখানায় উৎপাদিত পণ্য।
মানুষ যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত হলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে না। শিক্ষিত মানুষ নিজেই বোঝে বেশি সন্তান সমস্যা। ঠিক একইভাবে যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে পারলে ওই সমস্যাগুলোর সমাধান অনেকটা এমনিতেই হয়ে যাবে।
অনেকে তর্ক জুড়বেন এই বলে যে, বাংলাদেশে তাৎপর্যপূর্ণ মেধাবী লোকের সংখ্যাও কম নয়। বিশ্ব-কাঁপানো নানা মানুষ আছে এবং ছিল আমাদের। কথা মিথ্যা না। বিনয়ের সাথে শুধু এই মন্তব্যটুকু করতে চাই যে, এইসব বিশ্ব-কাঁপানো তাৎপর্যপূর্ণ ‘মানুষরতন’ সৃষ্টিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নেই বললেই চলে।
অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় অনেকের সাফল্য নিয়ে গর্ব করে। বলে থাকে, ওমুক তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সত্যি তাই। তিনি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রই ছিলেন বটে! শিক্ষকের ছাত্র তারা কমই ছিলেন। আসলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের ছাত্র ছিলেন। শিক্ষক বা শিক্ষাব্যবস্থার কেউ ছিলেন না।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, এদের অধিকাংশের বিকাশ ঘটে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর বাইরে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশের মাটিতে বা বিদেশি যোগ-যুক্ততায়; অথবা ব্যক্তিগত নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্চিত শিক্ষা-কাঠামোর মধ্যে থেকে বড় হয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া মুশকিল হবে।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষায় আরও দীর্ঘমেয়াদি মনোযোগ দেওয়া একান্ত জরুরি। শিক্ষায় মনোযোগ না দিয়ে রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে জঙ্গি বিরোধী, ইভটিজিং বিরোধী, মাদক বিরোধী সমাবেশ করে দীর্ঘমেয়াদে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। ওগুলো যথাযথ শিক্ষাহীনতার উপসর্গ।
মানুষ যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত হলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে না। শিক্ষিত মানুষ নিজেই বোঝে বেশি সন্তান সমস্যা। ঠিক একইভাবে যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে পারলে ওই সমস্যাগুলোর সমাধান অনেকটা এমনিতেই হয়ে যাবে।
সবার আগে পরিবর্তন আনতে হবে রাষ্ট্রের শিক্ষা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিতে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা আদর্শ নয় প্রয়োজন। বিচিত্র মানুষের বিচিত্র ক্ষমতা ও ঝোঁককে ব্যবহার করতে হবে।
একটা অসংবেদনশীল গোঁয়ার শিক্ষাব্যবস্থা চোখ-কান বুজে সবার ওপর একইভাবে চাপিয়ে দিলে একটা বড় জনগোষ্ঠী পড়াশোনা শেষ করে বলবেই, স্কুলে ঢুকেছিলাম একটা দেবদূত আর বের হয়েছি একটা ভূত হয়ে।
ড. কুদরত-ই-হুদা ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক
[email protected]