আবুল মাল আবদুল মুহিত : বর্ণাঢ্য জীবন যার
২৯ এপ্রিল রাতে ৮৮ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বর্ণাঢ্য জীবন ছিল মানুষটির। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া আবদুল মুহিত ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
১৯৫৬ সালে আবদুল মুহিত যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। সিএসপিতে যোগ দিয়ে তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সিএসপি হওয়ার পর মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে পরিকল্পনা সচিব হন।
১৯৮১ সালে অবসর নেওয়ার পর ১৯৮২ সালে সামরিক শাসক এরশাদের পরিকল্পনামন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এরশাদের মন্ত্রিসভায় দুই বছরের বেশি থাকতে পারেননি, বেরিয়ে আসেন।
২০০৮ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার বিপুল বিজয়ের পর ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ সময় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত এ পর্যন্ত ১২টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন, যার ১০টি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।
আবুল মাল আবদুল মুহিতের বিরাট কর্মময় জীবনকে তুলে ধরা এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়। তাকে আমরা হয়তো দেখব বর্তমান সরকারের আমলের তার অর্থনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র থেকে অর্থনীতিবিদ হয়ে নিজে দেখেছেন এবং জাতিকে দেখিয়েছেন অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ কেমন হয় সে দিকটি। দিন বদলের ইশতেহার নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য মুহিত পান অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ সময় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত এ পর্যন্ত ১২টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন, যার ১০টি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।
টানা দশ বছর সেই দায়িত্ব পালন করা মুহিত ২০১৮ সালে অবসরে যান। ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভার উত্তরসূরি আ হ ম মুস্তফা কামালের হাতে তুলে দেওয়ার দিনে মুহিত বলেছিলেন, ‘আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির দেশ হিসেবে জি টোয়েন্টিতে দাওয়াত পেয়ে অংশগ্রহণ করতে পারব বলে আমি আশাবাদী।’
মানতে হবে যে, তার আমলে অর্থনীতিকে, বাজেটকে বড় করে দেখবার চোখ হয়েছে বাংলাদেশের। যদিও বাজেটের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গুণগত পরিবর্তন তেমন ঘটেনি ওই সময়। এমনকি বাজেটের আকার আদতেই বড় হয়েছে কি না সে প্রশ্নও আছে। জিডিপির ১৭ বা ১৮ শতাংশের বেশি কখনো হয়নি। কিন্তু সেটিও কখনো সেভাবে বাস্তবায়িত হতে পারেনি তার আমলে।
সেই সময় করের আওতা বেড়েছে, কিন্তু রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কোনো বছরই পূরণ হয়নি। ক্রমাগত কমতে থাকা কর-জিডিপি অনুপাত নিয়ে আলোচনা আগেও ছিল, তার আমলেও ছিল এবং এখনো আছে। এই অনুপাত আফগানিস্তান বাদ দিলে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। প্রত্যক্ষ আয়কর কম হলেও বাংলাদেশের শুল্ক এবং ভ্যাটের হার এই অঞ্চলে প্রায় সর্বোচ্চ। ফলে পরোক্ষ করের বোঝা জনগণকে সইতে হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
অর্থনীতিতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও চাঁদাবাজির প্রশ্নের সমাধান তিনি করতে পারেননি। সাহস করে বলতে পারেননি, আমি রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক, উন্নয়ন প্রকল্প চাই না। তবে তিনি, বেতনের উৎসে কর সংগ্রহ ব্যবস্থার সংস্কারে সাফল্য দেখিয়েছেন।
মন্ত্রিত্বের শেষ সময়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছিলেন, ব্যাংক খাত খুব সমস্যায় আছে। একে এভাবে চলতে দেওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বিলুপ্ত হয়েছে দুইভাবে—বেসরকারি ব্যাংক সমূহে মালিকদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে এবং সেটা তিনি করে দিয়েছেন তাদের পক্ষে আইন করে। আর সরকারি ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশ্রয়ে। ঋণখেলাপি সংস্কৃতির বড় বিকাশ ঘটেছে এই সময়ে।
সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক লোপাট হওয়া, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি, ক্রিসেন্ট গ্রুপের জনতা ব্যাংকের তিন হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি সবই তার সময়ের ঘটনা। কিন্তু তিনি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আর সব আমলা বা রাজনীতিকের মতো ছিলেন না। তিনি সামাজিক নানা সংগঠন ও আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, লেখালেখি করতেন, সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ মানুষ ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা তার সময়েই এবং সেটাও তিনি জেনেছিলেন ২২ দিন পর। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পেশাজীবীর হাত থেকে তিনিই ফিরিয়ে দিয়েছেন আমলার হাতে এবং তার সময়েই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিলুপ্ত ব্যাংকিং শাখাকে পুনরুজ্জীবিত করে আর্থিক খাতে সরকারি হস্তক্ষেপ চিরস্থায়ী হয়েছে।
ব্যাংক খাতের নৈরাজ্য যে তার মনে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল সেটা বোঝা যায় তার এক সাক্ষাৎকারে। একটি পত্রিকাকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের শেষ দিকে বলেছিলাম ব্যাংক খাত নিয়ে কিছু ধারণা দিয়ে যাব। নতুন প্রশাসনের জন্য আমি তা পরামর্শ আকারে রাখতে চেয়েছিলাম, যাতে তারা প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করতে পারে। শেষ পর্যন্ত দিইনি। কারণ হচ্ছে, আমার ধারণাগুলো অনেকের কাছেই খুব গ্রহণযোগ্য হবে না।’
তার আমলে শেয়ার বাজারে ২০১০ সালে যে ধস নেমেছিল তা আর উঠতে পারেনি। যাদের নাম এসেছিল এই পতনের জন্য দায়ী হিসেবে তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা তিনি নিতে পারেননি। তার সময়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ‘প্রবৃদ্ধি’ এবং তিনি মনে করতেন যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা শহর-গ্রাম নির্বিশেষে হয়েছে। ধনী-গরিব নির্বিশেষেও হয়েছে।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ এত বড়, দেশের অর্থনীতি এখানে সমন্বিত হতে পেরেছে। ঢাকা ও পঞ্চগড়ের পণ্যমূল্যে খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায় না। এটাই তার বড় কৃতিত্ব বলে তিনি মনে করতেন। আমরা সেই কৃতিত্ব তাকে দিতে চাই।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আর সব আমলা বা রাজনীতিকের মতো ছিলেন না। তিনি সামাজিক নানা সংগঠন ও আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, লেখালেখি করতেন, সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ মানুষ ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
সরকার তাকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ, জনপ্রশাসন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিষয়ে মুহিত বই লিখেছেন ৪০টি।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি