শৈশব ও খেলার মাঠ
একজন শিশুর সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সুস্থ পারিবারিক পরিবেশের সঙ্গে প্রয়োজন কিছু সামাজিক উপাদান। চাই বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রগতিশীল শিশু সংগঠন, চাই খেলার মাঠ, চাই পাঠাগার। এক সময় প্রতিটি পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, ক্লাব, পাঠাগার দেখা যেত।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ অত্যন্ত প্রয়োজন। পরিকল্পিত সকল নগর পরিকল্পনায় কতগুলো ভবনের জন্য এলাকাভিত্তিক একটি খেলার মাঠ ও একটি জলাশয় রাখা হয়। খেলার মাঠে শিশুরা খেলাধুলা করে পাশাপাশি বড়দের সুস্থতার জন্য হাঁটার ব্যবস্থাও থাকে।
উপমহাদেশের বড় বড় শহরগুলোতে পাড়ার ধারণাটাই আজ হারাতে বসেছে। একসময় এ অঞ্চলের মহানগরগুলোতে বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ক্লাব, পাড়াভিত্তিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার প্রচলন ছিল।
আজ শহর জুড়ে সুউচ্চ অট্টালিকার অপরিকল্পিত চাষ ধীরে ধীরে কেড়ে নিচ্ছে আজকের শিশুদের অনাবিল শৈশব। সেই কবে নচিকেতা গেয়েছিলেন—‘ভিড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে / চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনা রোদ।’
একটা সময় ছিল, যখন স্কুল থেকে ফিরে কোনোরকমে ব্যাগটা রেখে নাকে-মুখে একটু খাবার গুঁজেই শিশুরা দৌড়ে মাঠে চলে যেত। ফিরত সন্ধ্যার নামার আগেই। এরপরে আর বাইরে থাকার অনুমতি ছিল না।
একজন শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য চাই মুক্ত পরিবেশ। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে যা কখনোই সম্ভব নয়। শারীরিক সুস্থতার জন্য ব্যায়াম, ছোটাছুটি, খেলাধুলা করা অত্যন্ত জরুরি। চিকিৎসকও শিশুদের বিভিন্ন রোগ থেকে দূরে থাকার জন্য খেলাধুলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
স্কুল মানে যে একটি মুক্ত পরিবেশ, ছোটাছুটির জায়গা, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা তা আজকের শিশুরা জানেই না।
সুস্থতার জন্য শরীরকে সচল রাখতে হয়। খেলাধুলা মানসিক সুস্থতাও দিয়ে থাকে। অবসর সময়ে ঘরে বসে থাকলে মানসিক নানা বৈকল্য আসে। তার নজিরও বর্তমান সময়ে আমাদের চারপাশেই দেখা যাচ্ছে।
আজকাল স্কুলগুলোর বিশাল মাঠেও দালান করে স্কুলের কলেবর বাড়ানো হচ্ছে; ফলে হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের জন্য বরাদ্দ খেলার মাঠ। একটি বাড়ির মধ্যে থেকে আরেকটি বদ্ধ ঘরে গিয়ে চেয়ার টেবিলে সময় কাটিয়ে আবার ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়িতে ফিরে আসে আজকের শিশুরা।
স্কুল মানে যে একটি মুক্ত পরিবেশ, ছোটাছুটির জায়গা, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা তা আজকের শিশুরা জানেই না। আজকের কোনো কোনো শিশু এসি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসি গাড়িতে চড়ে এসি ক্লাসরুমে এসে ঢুকে। রোদ-বৃষ্টি-হাওয়া তাদের স্পর্শ করার সুযোগই পায় না। তাহলে এ প্রজন্ম তো একটি নাজুক প্রজন্মই হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে বিশেষ সচেতন হয়েই বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিয়েছেন।
আমরা প্রতিনিয়ত শিশুদের দোষারোপ করি তারা সারাক্ষণ কম্পিউটার ও নানা ডিভাইসে ঢুকে থাকে। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছি কি এছাড়া আর কী করার সুযোগ আমরা তাদের দিচ্ছি? যে শিশু সারাক্ষণ ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে-শিশুতোষ সাইট ছাড়াও তার জন্য অনুপযোগী সাইটগুলোতেও সে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে তার শিশুমন নানা প্রভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন অপরাধের সাথেও জড়িয়ে পড়ছে শিশু। তার কোনো বন্ধু হচ্ছে না। একাকী শিশু ভালোমন্দের আলাপও করতে পারছে না কারো সাথে। অপরদিকে যে শিশু মাঠে তুমুল দৌড়াচ্ছে, বন্ধুদের সাথে খেলছে তার এসব নেতিবাচক দিকের সঙ্গে পরিচয়ই ঘটছে না। সমবয়সীর বন্ধুত্ব তাকে দিচ্ছে নির্মল শৈশব।
করোনা মহামারির সময় ঘরবন্দি শিশুদের অবসাদপূর্ণ জীবন তাদের কোন পথে নিয়ে গেছে-পত্রিকার পাতা জুড়ে সে খবর আমরা দেখেছি। সে অবসাদ আর বৈকল্য থেকে কিছুটা মুক্তি মিলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াতে। তারপরও পাড়া-মহল্লায় খেলার মাঠ না থাকায় সুষ্ঠু বিকাশ ঘটছে না। মননের বিকাশের জন্য পাঠাভ্যাস জরুরি। তাই পাঠাগার প্রতিষ্ঠার দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে।
খেলার মাঠ ছিল বলেই আমরা পেয়েছি আকরাম খান, হাবিবুল বাশার, সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মর্তুজা, তামিম ইকবাল, রুমানা আহমেদ বা মুর্শিদা খাতুনের মতো ক্রিকেটার...
খেলার মাঠে যদি শিশুরা না-ই খেলতে পারে, তবে ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার ক্রিকেটার তৈরি হবে কী করে? কী করে হাডুডু খেলায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ট্রফি ছিনিয়ে আনবে? দেশের ভবিষ্যৎ ক্রীড়াবিদ তৈরি করতে শৈশবের খেলার মাঠের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।
খেলার মাঠ ছিল বলেই আমরা পেয়েছি আকরাম খান, হাবিবুল বাশার, সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মর্তুজা, তামিম ইকবাল, রুমানা আহমেদ বা মুর্শিদা খাতুনের মতো ক্রিকেটার; পেয়েছি কাজী সালাউদ্দিন, শেখ আসলাম, মোনেম মুন্না কিংবা আজকের সাবিনা খাতুন, অংম্রাচিং মারমা বা জামাল ভূঁইয়া মতো ফুটবলার।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা খুব জরুরি। গত কয়েক বছর আগেই গোটা বাংলাদেশ জুড়ে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান আমরা দেখেছি। তরুণ প্রজন্মের একটি অংশের মধ্যে উগ্রবাদ ও জঙ্গি মানসিকতার যে ভয়াবহ বিস্তার আমরা তখন দেখেছি বা এখনো দেখি- তা আমাদের আতঙ্কিত করে তুলে।
তখন এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন মহল ও নাগরিক সমাজ।
জঙ্গিবাদ কেবল আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি নয়, একে একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে বিবেচনা করেই এর সামাজিক সমাধানের নানা উদ্যোগ নিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন সদস্যবৃন্দ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার সময় আরও নানা বিষয়ের সঙ্গে নিয়মিত মাঠে খেলতে যাওয়ার গুরুত্বও তুলে ধরেছিলেন। এটা খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। তখন সকলে একবাক্যেই খেলার মাঠের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করতেন।
কথাগুলো বলতে হচ্ছে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতেই। যে কারণে খেলার মাঠের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আজ এত আলোচনা হচ্ছে তার মূল কারণ ঢাকা মহানগরীর কলাবাগান এলাকার তেঁতুলতলা মাঠ।
...তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন সদস্যবৃন্দ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার সময় আরও নানা বিষয়ের সঙ্গে নিয়মিত মাঠে খেলতে যাওয়ার গুরুত্বও তুলে ধরেছিলেন।
গত ৫০ বছর ধরে এটি খেলার মাঠ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা বিভিন্ন ছোটখাটো সাংস্কৃতিক আয়োজনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সরকারের বিশদ পরিকল্পনায় এটি একটি উন্মুক্ত স্থান হিসেবেই উল্লেখ করা আছে। মাঠটিতে হঠাৎ একদিন কলাবাগান থানার একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়ে বলা হলো, এটি থানার জন্য বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, এর প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক থাকলেন সহযোদ্ধা সৈয়দা রত্না এবং তার সন্তান প্রিয়াংশু। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা ভুলে গেছেন, এই ক’বছর আগেও তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে গিয়ে, টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করে, খবরের কাগজে বিবৃতি দিয়ে শিশু-কিশোর আর তরুণদের মাঠে গিয়ে খেলার জন্য সদুপদেশ দিয়েছিলেন।
আজ খেলার মাঠ দখল করে তারা নিজেরাই সে সুযোগ সংকুচিত করে ফেলছেন। অথচ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনের ইশতেহারেও ব্লু ইকোনমি, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সুরক্ষা, এসডিজি বাস্তবায়ন কৌশল বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নানা জায়গায় জলাশয় ও মাঠ রক্ষার আলোচনা করা হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু কেন, কোন কারণে এর বাস্তবায়ন হয় না—সেটা আমরা বুঝতে পারি না।
নাগরিক সমাজ, পরিবেশকর্মীদের আন্দোলন ও সরকারের নানা উদ্যোগে জলাশয়গুলোর কিছু কিছু তবুও দখলমুক্ত করার পদক্ষেপ আমরা দেখেছি। কিন্তু খেলার মাঠগুলো পুনরুদ্ধারের বিষয়ে তেমন বলিষ্ঠ উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে দেখা যায় না।
কেবল তেঁতুলতলা মাঠই নয়, বিভিন্ন শহরের খেলার মাঠগুলো পুনরুদ্ধার করে শিশুদের ফিরিয়ে দিলে একটি সুস্থ, সুন্দর, সৎ, শক্তিশালী প্রজন্মের হাতে জন্মভূমি দিয়ে যেতে পারব বলেই আশা রাখি।
সঙ্গীতা ইমাম ।। শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী