বোহেমিয়ান, কবি, সাংবাদিক ও পণ্ডিত
খুব সকালে তার ফোন। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে জানতে চাইলেন, বিছানা ছেড়েছি কি না, না-এখনো বিছানায়। তারপরে চিত্রার খবর, ছেলের খবর জানতে চাওয়া। ধীরে ধীরে বেশ ধাতস্থ করে নিলেন আমাকে আরও অনেক কথা বলে। তারপরে ছোট্ট একটা বাক্য ‘ত্রিদিবটা (ত্রিদিব দস্তিদার) তো চলে গেল।’ রেডি হয়ে চলে এসো, আমি গাজী’র (গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ, সন্ধানী সম্পাদক) ওখানে যাচ্ছি।
খবরটা শুনে বিছানা ছাড়তে যেমন কষ্ট হলো তেমনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকি, কে বলে কবি বেলাল চৌধুরী বোহেমিয়ান। সংসারের কোনোকিছু বোঝেন না। খুব সকালে একটা মানুষকে প্রিয়জনের মৃত্যু’র খবর, এর থেকে সহনীয়ভাবে আর কে দিতে পারতো? যাদেরকে ঘোর সংসারী, বিবেচক বলি, তারাও কি সকলে পারতেন!
বোহেমিয়ান তাকে বলা হতো, খুব ছোটবেলায় বাড়ি ছেড়ে ছিলেন বলে। তবে আমার কাছে কখনো মনে হয়নি, বেলাল চৌধুরী উদ্দেশ্যহীনভাবে বাড়ি ছেড়েছিলেন। বোহেমিয়ান, তাকে এক জায়গায় আটকানো যেত না বলে তিনি বাড়ি ছেড়ে ছিলেন।
বেলাল চৌধুরী জাহাজের নিচের পদে একটা কাজ নিয়ে জাহাজে গিয়েছিলেন কৈশোরে। তার মতো বিরাট হৃদয়কে, বিশাল চোখকে যদি সাগর না টানে, তাহলে কে টানবে?
রবীন্দ্রনাথের বাবা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। যিনি রবীন্দ্রনাথের পিতা না হলে অনেক বড় লেখক হিসেবেই তাকে সকলে চিনতো। হারিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথের পিতা এই বিশাল পরিচয়ের আড়ালে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে ছোটবেলায় সাগরের কাছে নিয়ে গেছেন, পাহাড়ের কাছে নিয়ে গেছেন। যৌবনে জাহাজে জাহাজে সাগর ঘুরেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই রবীন্দ্রনাথকে কেউ বোহেমিয়ান বলে না।
কৈশোর না পেরুতেই বেলাল চৌধুরী পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। পঞ্চাশ দশকের কলকাতা। যে কলকাতায় শিল্প সাহিত্যের ওই সময়ে আরেকটি নবজন্ম হচ্ছে। সেখানেই গিয়েছিলেন তিনি।
আর এই সাগরের ডাক শুনে কৈশোরে থাকতে না পেরে প্রেমেন্দ্র মিত্র, বেলাল চৌধুরী, অতীন বন্দ্যোপধ্যায় এরা কৈশোরের নিজের শক্তিকে পুঁজি করে বেরিয়ে পড়েছিলেন সাগরের বুকে বুকে। সাগর থেকে সকলে তুলে এনেছিলেন, নিজের জীবনে সাগরের মতো বিশালত্ব, সাহিত্যকেও নিয়ে গিয়েছিলেন সাগর থেকে ফেরা একটা মানুষের হৃদয়ে। কোনো ঘরকুনো হৃদয়ে নয়। এই সাগরে যাওয়া কি বোহেমিয়ানের পরিচয় না অন্য কিছু?
কৈশোর না পেরুতেই বেলাল চৌধুরী পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। পঞ্চাশ দশকের কলকাতা। যে কলকাতায় শিল্প সাহিত্যের ওই সময়ে আরেকটি নবজন্ম হচ্ছে। সেখানেই গিয়েছিলেন তিনি। সাহিত্যের জন্যে তার মতো সঠিক সিদ্ধান্ত ক’জনে নিতে পেরেছিলেন? কারণ, বাংলা শিল্প সাহিত্যের রাজধানীতেই তিনি পৌঁছেছিলেন।
তখন কলকাতায় অভাব ছিল, অনটন ছিল। রাজনীতির টানাপোড়েন ছিল। রিফিউজির কান্না ছিল। আবার তার পাশাপাশি ছিল, চলচ্চিত্রের ফর্ম ভেঙে নতুন বাংলা চলচ্চিত্র হচ্ছে। কবিতার নতুন নতুন জন্ম হচ্ছে। ছোট গল্প কখনো শানিত তরবারি কখনো প্রেমের কবিতার থেকেও স্রোতস্বিনী। আবার বাংলা গানের এক নতুন যুগ শুরু হয়ে গেছে। ছবি আঁকার টানে নানান প্রদেশ থেকেও শিল্পীরা চলে আসছেন কলকাতায়। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁও অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছেন কলকাতাতেই।
না, কলকাতায় গিয়ে কোনো গলিপথে হারিয়ে যাননি বেলাল চৌধুরী। একেবারে সাহিত্যের বড় রাজপথেই ছিলেন তিনি। সাংবাদিকতারও। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কৃত্তিবাসের সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি এক পর্যায়ে। আর সাংবাদিকতা! দুই হাতে লেখেন তখন বেলাল চৌধুরী। নাম ছাড়া তার কত লেখা হারিয়ে গেছে। আবার সাংবাদিকতার বিশেষ করে ফিচার লেখার এক নতুন যুগ শুরু করেন তিনি আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় মিলে ভারতের পথে পথে ঘুরে ঘুরে।
বাংলা সাহিত্যের সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের রাজধানীতে থাকাতে সাহিত্যের রাজপুত্রই হয়েছিলেন বেলাল চৌধুরী। একেবারে রাজপুত্রদের মতোই। শিকারে বেরিয়ে নিষাদের মতো যা খুশি তাই শিকার করেননি কখনো। লিখেছেন, অনেক। তবে জনপ্রিয়তার দৌড়ে নয়, ভালোবাসার তাগিদে।
স্বাধীনতার পরে বন্ধুবান্ধবদের চাপে, পরিবারের জোর, সর্বোপরি নতুন দেশের টানে চলে এসেছিলেন নিজ দেশের রাজধানীতে। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তখন তিনি ভেবেছিলেন, বাংলায় সীমান্ত হলেও সাহিত্যে সীমান্ত থাকবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে যখন আস্তে আস্তে পাকিস্তানি কায়দায় সাহিত্যেও সীমান্ত তৈরি হতে থাকে, তখন ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে যেতে থাকেন বেলাল চৌধুরী।
কৈশোর ও তারুণ্য রাজপুত্র হিসেবে পেরিয়ে যখন একটি সীমান্ত ঘেরা, গণ্ডিবদ্ধ জ্ঞানের, চিত্তের চারপাশে দেয়াল তোলা সংবাদপত্র অফিসের এক ধরনের কেরানি সাংবাদিক হতে হলো জীবিকার টানে, তখন থেকে তার মনের অতলে এক হতাশার স্রোত বইতে শুরু করে। হতাশার স্রোত তিনি কখনো বাইরে আসতে দেননি। সদা হাসিমুখ, অন্যের কাজকে নিজের কাজের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে করা -এ সবকিছু দিয়ে তিনি ঢেকে রাখতেন তার হতাশা।
তবে তখনো ঢাকা শহর আজকের মতো এতটা শুকিয়ে যায়নি। তখনো ফুল ফোঁটার মতো অজস্র স্রোতধারা ছিল। তাই বেলাল চৌধুরীকে থাকতে হয়নি কখনো সঙ্গীহীন। বরং সে সময়ে বসে যখন বাংলা সাহিত্যে অনেকেই আঠারো শতকের ইংরেজি কবিতাকে আধুনিক ধরে আধুনিক কবিতা লিখছেন সে সময়ে উনিশ শতক, বিশ শতকের কবিদের কবিতার ছাপ বেলাল চৌধুরীর কবিতায়। এমনকি বব ডিলানের শব্দ ও ছন্দও মাঝে মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় তার কবিতায়।
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কৃত্তিবাসের সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি এক পর্যায়ে। আর সাংবাদিকতা! দুই হাতে লেখেন তখন বেলাল চৌধুরী। নাম ছাড়া তার কত লেখা হারিয়ে গেছে।
শুধু সাহিত্য নয়, বহুমাত্রিক পাণ্ডিত্য ছিল তার। আজকের যে পোর্টাল সাংবাদিকতা বা লেখালেখি শুরু হয়েছে। যেখানে শব্দকে শাসন করে প্রকাশকে বেশি করার যোগ্যতাই সব থেকে বড় যোগ্যতা- এটা অবাক বিস্ময়ে দেখেছি ১৯৯৬ সালে প্রথম বাংলা পোর্টাল, বাংলা লাইভ ডট কম করতে গিয়ে। সৈয়দ আলী আহসান আর বেলাল চৌধুরী। দুজনের কলম যেন বড় তীরন্দাজ তেমন নিজের বানকে শাসন করার ক্ষমতা রাখতেন, তারাও ঠিক তেমনি। বিষয়ের জন্যে তিনশ শব্দ হলে তিনশ শব্দ। ছয়শ হলে ঠিক ছয়শ শব্দ। না প্রকাশে কোনো ঘাটতি নেই।
আবার এর আগে আশির দশকে এ দেশে ম্যাগাজিনে আধুনিকতা অনেকইে এনেছেন কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে যে একটা অন্য মাপের রুচির ছাপ সেখানে বেলাল চৌধুরী একটু এগিয়েই থাকতেন। অবশ্য একা কিছু হয় না। তিনি ছিলেন সচিত্র সন্ধানীতে। সন্ধানী তো আসলে একটা সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল ঢাকা শহরে। তাই তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটতো ওই পত্রিকায়। তারপরেও কারিগর হিসেবে বেলাল চৌধুরীকে তো পেছনে ফেলা যাবে না।
২৪ তারিখ কবি বেলাল চৌধুরীর মৃত্যু দিবস গেল। দুপুর অবধি কাজের চাপে ভুলেই ছিলাম। দুপুরের পরে নিজেকে একটু হালকা করার জন্যে ফেসবুকে মাসুক হেলালের স্কেচসহ শ্রদ্ধা নিবেদন দেখে মনটা অনেক দূর চলে গেল। স্মৃতিগুলো যেভাবে এসে নাড়া দিচ্ছে, তাতে কয়েকশ পৃষ্ঠা লেখা হয়ে যাবে। কিন্তু তার থেকে কষ্টটা তো আরও বেশি- বেলাল চৌধুরীর মৃত্যুদিন নীরবে কেটে যায়।
আসলে এজন্য কি নীরবতা হিরণ্ময়(!)। আসলে সব ভালোই এমনি নীরবতা দিয়ে ঢাকা থাকে। তিনি নিজেও নিজেকে মাঝে মাঝে নীরবতায় নিয়ে যেতেন। কোথায় যেন ডুব দিতেন। অনেক সময় কাছে ডেকে বলতেন, মাঝে মাঝে নিজেকে একদম একা করে ফেলতে হয়। বইয়ের ভেতর, পড়ার ভেতর ডুবে যেতে হয়। জানাটা অনেক বড় বিষয় রে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি পার হননি এমন অনেক লেখকের সঙ্গে জীবনে মেশার সুযোগ হয়েছে। তাদের ভেতর কয়েকজনকে দেখেছি দাপটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে অধ্যাপকদের কেয়ার না করে বক্তব্য রাখতেন, সাংবাদিক ও লেখক আবু জাফর শামসুদ্দিন, বেলাল চৌধুরী এমনি কয়েকজন। তাদের পাণ্ডিত্য ছিল এমনই সীমাহীন যা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই খাপে আটতো না তাই বুঝেই তারাও হয়তো ওইদিকে পা বাড়াননি। তবে শব্দের ব্যবহার থেকে জ্ঞানের বিষয়কে সহজ করে দেওয়া এ দুটোতেই ছিল বেলাল চৌধুরীর মুনশিয়ানা।
বেলাল চৌধুরীর সৃষ্টি আসলে ছড়িয়ে আছে কলকাতার নানা পত্রপত্রিকায়। আছে তার নিজ দেশেও। কোনোদিন কেউ খুঁজে সংরক্ষণ করবে কি না তাও বা কে জানে! তবে তার এই মৃত্যুদিনে কষ্টের থেকেও তাকে মনে করে অন্য একটা গর্ব হয়, আসলে আমরা ভাগ্যবান, তাদের সঙ্গে নানান আড্ডায়, নানান শহরের গলিতে, বাড়িতে, শহরতলির নদীর তীরে বা দূর্বাঘাসের বিছানায় বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছি কৈশোর, তারুণ্য ও যৌবনে।
বেলাল ভাই, সবার ওপরে ছিলেন একজন সত্যিকার অর্থে ভালো মানুষ। যা সমাজে এখন খুঁজে পাওয়া বড়ই ভাগ্যের বিষয়।
স্বদেশ রায় ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব