পুরোনো সংক্রামক : জনস্বাস্থ্যে নতুন হুমকি
প্রতি বছর ২৫ এপ্রিল বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে। ২০২২ সালে এই দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘উদ্ভাবনী কাজে লাগাই-ম্যালেরিয়া রোধে জীবন বাঁচাই’। বিশ্বের মানুষকে ম্যালেরিয়ার বাহক ও ম্যালেরিয়া রোগ সম্পর্কে সচেতন করা এবং ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এ দিবস পালিত হয়ে থাকে।
ম্যালেরিয়া সমস্যাকে সমাধান করতে পারে এমন কোনো একক হাতিয়ার বর্তমানে নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাই এ বিষয়ে বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবনের আহ্বান জানাচ্ছে, যা ম্যালেরিয়া সমস্যা সমাধানে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এ বছরের প্রতিপাদ্যে ম্যালেরিয়া বাহক মশা নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
ম্যালেরিয়া রোগের পাশাপাশি পৃথিবীতে অনেক সংক্রামক রোগ পুনরায় আবির্ভূত হচ্ছে এবং হবে। আদিকাল থেকে-বর্তমান পর্যন্ত সংক্রামক রোগ মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে আসছে।
প্রাচীন কালে বাইবেলের প্লেগ এবং এথেন্সের প্লেগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের ব্ল্যাক ডেথ, ১৯১৮ সালের ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ মহামারি এবং অতি সম্প্রতি, ডায়রিয়া ও এইচআইভি/এইডস, ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া মহামারি, সংক্রামক রোগগুলো ক্রমাগতভাবে উত্থিত এবং পুনরুত্থিত হয়েছে। এই রোগগুলোর পুনরুত্থান রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সকল অনুমান ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বেশকিছু রোগ জনস্বাস্থ্যের প্রধান সমস্যা। কিছু কিছু রোগ সাম্প্রতিক সময়ে বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক পটভূমি কিছু রোগের বিস্তার এবং সংক্রমণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বেশকিছু রোগ জনস্বাস্থ্যের প্রধান সমস্যা। কিছু কিছু রোগ সাম্প্রতিক সময়ে বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক পটভূমি কিছু রোগের বিস্তার এবং সংক্রমণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং রোগের প্যাথোফিজিওলজি ভালোভাবে না জানার কারণে কিছু কিছু রোগ পুনরায় ফিরে আসছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়া, নাগরিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম এবং জীবন যাত্রার মান নিম্ন হওয়ায় বাংলাদেশের মতো মধ্যম এবং নিম্নআয়ের দেশগুলোতে সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে।
লিসম্যানিয়াসিস, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ইত্যাদি রোগগুলো বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের প্রধান উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বহু মানুষের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর কারণে হুমকির হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লেগ পুনরায় আবির্ভূত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে কারণ এটি ভারতীয় উপমহাদেশে হয়েছিল যা মানুষের অসুস্থতা মৃত্যু এবং বাণিজ্য ঘাটতিতে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। আমাদের দেশে লেপটোপাইরোসিস ধরা পড়েনি শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে।
নতুন এবং পুনরুত্থিত জীবাণু হুমকি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য এবং সংক্রামক রোগ গবেষণা সম্প্রদায়কে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে, নতুন উদীয়মান প্যাথোজেন, যেমন গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সিন্ড্রোম-সম্পর্কিত করোনাভাইরাস (SARS-CoV), হেনিপাভাইরাস (হেন্দ্রা এবং নিপা), এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এবং অতি সম্প্রতি সোয়াইন ফ্লু (H1N1) মহামারিতে বিবর্তনের হুমকির সাথে মানুষের অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
গত এক দশক ধরে, মাইকোব্যাকটেরিয়াম যক্ষ্মা রোগের মতো সাধারণ জীবাণুর স্ট্রেনগুলো ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে যা একসময় এর বিরুদ্ধে কার্যকর ছিল। এই ধরনের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল-প্রতিরোধী অণুজীব, প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে যেটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
প্লেগ পুনরায় আবির্ভূত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে কারণ এটি ভারতীয় উপমহাদেশে হয়েছিল যা মানুষের অসুস্থতা মৃত্যু এবং বাণিজ্য ঘাটতিতে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল।
নতুন উদ্ভাবনী চিকিৎসা পদ্ধতি, ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট গুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন।
সম্প্রতি বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এটি একটি বড় হুমকি এবং বাংলাদেশে একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা, ঢাকা জেলার দোহার ও নবাবগঞ্জ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জেও চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রাদুর্ভাব পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে ঢাকাতে এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
পুনরুত্থিত সংক্রামক রোগগুলো মরার উপায় খরার ঘা হয়ে অন্যান্য সংক্রামক রোগগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও গত এক দশকে সংক্রামক রোগের কারণে বার্ষিক মৃত্যু এবং জীবন হারানোর হার কমেছে। তবে বিশ্বব্যাপী সংক্রামক রোগের প্রভাব যথেষ্ট রয়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে, সংক্রামক রোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে রয়ে গেছে।
গবেষক বিজ্ঞানী এবং ওষুধ তৈরি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ভ্যাকসিন আবিষ্কার। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন, এই অগ্রগতির আরেকটি কারণ। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। মিউটেশন এবং বিবর্তনের মাধ্যমে ভাইরাস পরিবর্তিত হয়ে দিনদিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে।
আমরা ধরে নিতে পারি, জীবাণুর অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতা কখনো শেষ হবে না। সফলভাবে এই জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদেরকে জোরালোভাবে মৌলিক গবেষণা জোরদার করতে হবে। গবেষণার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রস্তুতি রাখতে হবে যেন যেকোনো ধরনের রোগ আক্রমণকে মোকাবিলা করা যায়।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়