চাই জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের শিক্ষা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শুধুমাত্র রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতিই স্বাস্থ্য নয় বরং স্বাস্থ্য হলো এমন একটা অবস্থা যেখানে সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা বজায় থাকে [১]। আর স্বাস্থ্য শিক্ষা সম্পর্কে তারা জানাচ্ছে, স্বাস্থ্য শিক্ষা শুধুমাত্র তথ্য যোগাযোগের সঙ্গেই জড়িত নয়, বরং স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির সঙ্গেও জড়িত। স্বাস্থ্য শিক্ষার মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তারকারী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অবস্থা। সেই সঙ্গে আছে স্বতন্ত্র ঝুঁকির কারণ, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ব্যবহার [২]।
জাতীয় পুষ্টিসেবা, জনস্বাস্থ্য পুষ্টিপ্রতিষ্ঠান এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে; ইউনিসেফের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় অক্টোবর ২০২০ তারিখে প্রকাশিত ‘কৈশোরকালীন পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়নে গাইডলাইন ২০২০’- এ ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি তোমু হোজুমি বলেন, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ একই সঙ্গে তিনভাবে আমাদের উপকার করে থাকে। প্রথমত, কিশোর-কিশোরীদের বর্তমান সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে, দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে উৎপাদনশীলতা এবং তৃতীয়ত, তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসের ব্যাপারে [৩]।
মূলত কৃমি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদারের জন্য ১৯৯১ সালে উদ্বোধন করা হয় ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম। এ কার্যক্রমে কিছু শিশুকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারা নিজেরা পরিচ্ছন্ন থাকে এবং সহপাঠীদেরও পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দেয়
শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ একটি মানবগোষ্ঠী সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে অবদান রাখবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এসব কর্মপরিকল্পনার মধ্যে আছে ক্ষুদে ডাক্তার কর্মসূচি যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে সারাদেশে পরিচালিত হচ্ছে। মূলত কৃমি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদারের জন্য ১৯৯১ সালে উদ্বোধন করা হয় ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম। এ কার্যক্রমে কিছু শিশুকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারা নিজেরা পরিচ্ছন্ন থাকে এবং সহপাঠীদেরও পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দেয়। দাঁত ও নখ পরীক্ষা করে পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দেয়। দৃষ্টিশক্তি ঠিক আছে কি-না, সেটাও পরীক্ষা করে। এছাড়া সহপাঠীদের ওজন ও উচ্চতা মেপে লিখে রাখে, যাতে কেউ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে কি-না, জানা যায়।
[১. WHO remains firmly committed to the principles set out in the preamble to the Constitution; ২. WHO. Health Education and Health Promotion; ৩. unicef. কৈশোরকালীন পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়নে গাইডলাইন ২০২০ ]
২০১৯ সালের হিসাবে, সারাদেশে এক লাখ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুই কোটি ৫০ লাখ (২৫ মিলিয়ন) শিক্ষার্থীর জন্য ১৫ লাখের (১.৫ মিলিয়ন) বেশি ক্ষুদে ডাক্তার কাজ করছে [৪]। শিশুদের মাঝে পরিচ্ছন্নতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার নিঃসন্দেহে এটি চমৎকার উদ্যোগ। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ২১ হাজার মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষার্থী আছে এক কোটিরও বেশি। সম্প্রতি এসব কিশোর-কিশোরীদের মাঝে বয়ঃসন্ধিকালে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এবং লিঙ্গ সমতার বিষয়গুলো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বা ইউএনএফপি-এর তৈরি করা ‘শাহানা’ কার্টুন [৫]।
১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নির্দিষ্ট পুষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম নিশ্চিতকরণ; কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে তাদের অবহিত করা; হাড় ও পেশির শক্তি বৃদ্ধির জন্য সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন শারীরিক ব্যায়াম এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করাসহ আরও বেশকিছু সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গাইডলাইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়
অক্টোবর ২০২০ সালে জাতীয় পুষ্টিসেবা, জনস্বাস্থ্য পুষ্টিপ্রতিষ্ঠান এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে; ইউনিসেফের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ‘কৈশোরকালীন পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়নে গাইডলাইন ২০২০’ তৈরি করা হয়। ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নির্দিষ্ট পুষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম নিশ্চিতকরণ; কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে তাদের অবহিত করা; হাড় ও পেশির শক্তি বৃদ্ধির জন্য সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন শারীরিক ব্যায়াম এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করাসহ আরও বেশকিছু সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গাইডলাইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় [৩]।
বাংলাদেশে মোট এক লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৬৫৫টি [৬]। এখানে যারা লেখাপড়া করে বিশেষ করে শহরাঞ্চলের সিংহভাগ শিশু আসে দরিদ্র পরিবার থেকে। শহরের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষরা সাধারণত বস্তিতেই বেশি থাকেন।
[৪. Reducing Dietary Related Risks associated with NonCommunicable Diseases in Bangladesh (RDRNCD); ৫. যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা : বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্কুলের এক কোটি শিক্ষার্থীকে কী পড়ানো হবে?, রাকিব হাসনাত; বিবিসি বাংলা, ঢাকা; ৬. Annual-Primary-School-Census-Report-2021]
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শহরে বসবাসকারী জনগণের ৪৭ শতাংশ বস্তিতে বাস করেন [৭]। বস্তিগুলোতে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত নেই, নেই নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা। চারদিকে অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশ। এমন পরিবেশে এক কক্ষের ছোট একটা ঘরে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকছে শিশুরা। পান করছে অস্বাস্থ্যকর পানি। শুধু ক্রিমি নিরোধক ঔষধ সেবন করে আর হাতের নখ ছোট রেখে এসব শিশু রোগ-জীবাণু থেকে কতটা নিরাপদ থাকবে তা ভেবে দেখা দরকার।
দুর্মূল্যের বাজারে সীমিত আয়ের বস্তির মানুষের পক্ষে যেখানে সন্তানদের জন্য তিনবেলা খাবার জোগাড় করাই কষ্টসাপেক্ষ, সেখানে পুষ্টিকর খাবার দেবার সামর্থ্য তাদের আছে কি-না, তাও ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীগণ। একদিকে যেমন এক শ্রেণির শিশুদের খাবার নেই, অধিকাংশ সময় না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়; অন্যদিকে আরেক শ্রেণির শিশুরা খাদ্যাভাবে সেভাবে না ভুগলেও ঠিকই নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যাভাবে ভুগছে। তারা প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও জাঙ্ক ফুডে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
দুর্মূল্যের বাজারে সীমিত আয়ের বস্তির মানুষের পক্ষে যেখানে সন্তানদের জন্য তিনবেলা খাবার জোগাড় করাই কষ্টসাপেক্ষ, সেখানে পুষ্টিকর খাবার দেবার সামর্থ্য তাদের আছে কি-না, তাও ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীগণ
শিশুরা শ্রেণিকক্ষে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে শিখছে কিন্তু খাচ্ছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও জাঙ্ক ফুড। ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় তিন থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শতকরা ১৭.৯ জন স্থূল এবং শতকরা ২৩.৬ জন বেশি ওজনের শিশু [৮]। শ্রেণিকক্ষে শিশুদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের কুফল সম্পর্কে জানানোই শেষ কথা নয়, এসব খাদ্যের উৎপাদন কমিয়ে আনা যায় কি-না, সে ব্যাপারেও ভেবে দেখতে হবে বলে মতামত জানিয়েছেন বিজ্ঞজনেরা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কিশোররা খুন, জখম, মারামারিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। রয়েছে ধূমপান আর মাদকের ভয়াল থাবা। নিয়মিত খেলাধুলা না করার কারণে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞগণের অভিমত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং পাওয়ার পার্টিসিপেশন রিসার্স সেন্টার কর্তৃক এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় মাত্র ২ শতাংশ শিশুর মাঠে খেলার সুযোগ আছে [৯]। নগরের উন্নয়ন বাড়ছে প্রতিনিয়ত। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ভবন, ঝলমলে বিপণিবিতান ও ফ্লাইওভার। অথচ, হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। আমাদের শিশুরা ঘরে বন্দি হয়ে মোবাইল গেমিংয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ক্ষীণ হয়ে আসছে দৃষ্টিশক্তি, হারিয়ে ফেলছে উদ্যম, কমে যাচ্ছে একাগ্রতা। বিভিন্ন সামাজিক গবেষণায় এমনটাই দেখা গেছে।
তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ভবন, ঝলমলে বিপণিবিতান ও ফ্লাইওভার। অথচ, হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। আমাদের শিশুরা ঘরে বন্দি হয়ে মোবাইল গেমিংয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ক্ষীণ হয়ে আসছে দৃষ্টিশক্তি, হারিয়ে ফেলছে উদ্যম, কমে যাচ্ছে একাগ্রতা
[৭. Hossain B. Slum of Bangladesh: An Overview. 2020. doi:10.13140/RG.2.2.28678.52800; ৮. Obesity and overweight in Bangladeshi children and adolescents: a scoping review. 2014; ৯. Only 2pc of Dhaka children have access to playgrounds: Survey]
আজকের শিশুরাই আগামীতে দেশের হাল ধরবে। দেশকে আরও উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ওদের মধ্যে থেকেই বেরিয়ে আসবে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী। তাই শিশুরা বড় হোক পরিচ্ছন্ন পরিবেশে, নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিক, সকল শিশু পুষ্টিকর খাবার পাক, বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাক, শ্রেণিতে শেখানো পুষ্টি ও পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনে চলুক, মোবাইল নয় মাঠে খেলার সুযোগ পাক। সকল শিশু সুস্থ শরীরে ও সুস্থ মনে বেড়ে উঠুক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট; গবেষণা সহকারী : শাম্মি আখতার ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান