দুর্ভোগ নয়, ঈদযাত্রা যেন আনন্দের হয়
নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা—বছরের পর বছর বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অনিবার্য শিরোনাম। ঈদ এলেই মানুষ বাড়ি ফিরতে ব্যাকুল হয়ে যায়। এই অনিবার্য শিরোনামের আরও কিছু অনিবার্য অনুষঙ্গ আছে—বাড়ি ফিরতে পথে পথে দুর্ভোগ, দুর্ঘটনায় মৃত্যু। এ যুগের নন্দলালেরা বলতে পারেন, এত কষ্ট করে বাড়ি যেতে হবে কেন, না গেলেই হয়। মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান নয়। সমস্যা হলে তার সমাধান বের করতে হবে, এটাই হলো সুশাসনের লক্ষণ। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এবারও বাড়ি যেতে মানুষকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, দীর্ঘ ভোগান্তি সইতে হবে।
এই যে ঈদে-পার্বণে বাড়ি ছুটে যাওয়া, এটা হলো বাংলাদেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশ একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র। ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়াশোনা, চাকরি-সবকিছুর কেন্দ্রে ঢাকা। গ্রাম থেকে মানুষ প্রথম পড়াশোনার জন্য ঢাকায় ছুটে আসেন। তারপর পড়াশোনা শেষ করে সুবিধামতো ঢাকায় থিতু হয়ে যান। ঢাকা মানেই যেন সম্ভাবনা, সমৃদ্ধি; ঢাকায় এলে কিছু না কিছু করে ভাগ্য বদলে ফেলা যাবে।
আবার কিছু মানুষ আসে একদম টিকে থাকার লড়াই করতে। নদীভাঙনসহ নানা কারণে জলবায়ু উদ্বাস্তু বা সাধারণভাবে দরিদ্র মানুষেরা আর কোনো উপায় না পেয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন। এভাবে আসতে আসতে ঢাকা এখন মানুষের ভারে ন্যুব্জ।
পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর একটি ঢাকা। মানুষ বেশি, তাই সমস্যাও বেশি। এক কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন যত মানুষ আসেন, বিশ্বের অনেক দেশের জনসংখ্যা তার চেয়ে কম। কিন্তু এই যে জীবিকার সন্ধানে, ভাগ্য বদলাতে, টিকে থাকতে বাধ্য হয়ে ঢাকায় ছুটে আসা মানুষের সবার নাড়ি কিন্তু গ্রামের মাটিতে পোতা। তাই কোনো সুযোগ পেলেই মানুষ ছুটে যায় সেই নাড়ির টানে। বাধ্য হয়ে ঢাকায় থাকা মানুষও প্রতিদিন হাহাকার করে গ্রামের জন্য, প্রকৃতির জন্য, মায়ের হাতের রান্নার জন্য।
আমাদের সবার দেশ বাংলাদেশ। তারপরও কারো সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করি, আপনার দেশের বাড়ি কোথায়? ঢাকা কারো দেশ নয়, সবার কাছেই দেশ মানে গ্রামের বাড়ি। তাই তো ঈদ এলেই বাড়ি ফেরার ঢল নামে। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, বিমানে, নিজের গাড়িতে, পারলে পায়ে হেঁটে; যে যেভাবে পারেন ছুটে যান গ্রামে।
করোনার কারণে গত দুই বছর সরকারি নানা বিধিনিষেধের সবাই বাড়ি ফিরতে পারেননি। বেপরোয়া অনেকে তবু সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে, করোনার চোখ রাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। দুই বছর পর এবার আবার বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল নামবে। সেই ঢল সামলানো সত্যি কঠিন।
ঢাকা কারো দেশ নয়, সবার কাছেই দেশ মানে গ্রামের বাড়ি। তাই তো ঈদ এলেই বাড়ি ফেরার ঢল নামে। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, বিমানে, নিজের গাড়িতে, পারলে পায়ে হেঁটে; যে যেভাবে পারেন ছুটে যান গ্রামে।
প্রতিবছরই ঈদের সময় মানুষ বাড়ি ফেরে এবং প্রতিবছরই তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ঈদে মানুষ বাড়ি যাবে, এটা সাধারণ মানুষ যেমন জানে, সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকেরাও তো জানেন। তাহলে তারা মানুষের ভোগান্তি দূর করার ব্যবস্থা নেন না কেন? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা নেই। দায়িত্বশীলরা কি সাধারণ মানুষের ভোগান্তিকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন নাকি এটা তাদের ব্যর্থতা?
একটি সরকার ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। এতদিনেও তারা কেন মানুষের বাড়ি ফেরাকে আনন্দদায়ক করতে পারছে না। কথায় বলে না, যার হয় না নয়ে, তার হয় না নব্বইয়ে। ১৩ বছরে সরকার যেটা পারেনি, এবার পারবে বা নিকট আগামীতে পারবে তেমন সম্ভাবনা দেখছি না। তাই বাড়ি ফিরতে চাইলে দুর্ভোগকে নিয়তি মেনে নিয়েই রওনা দেবেন। তবে এবার যে অসহনীয় গরম, মানুষের বাড়ি ফেরার ভোগান্তির কথা ভেবে আমার নিজেরই ভয় লাগছে।
এর মধ্যেই গণমাধ্যম বাড়ি ফেরা মানুষের ভোগান্তি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে। ১৬ এপ্রিল ২০২২। দৈনিক যুগান্তরের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘পথে পথে যানজট শুরু, ঈদযাত্রায় ভোগান্তির শঙ্কা’। দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ‘ঈদ যাত্রা: মহাসড়কে ১৭ স্থানে ভোগান্তির শঙ্কা’। দুটি পত্রিকার রিপোর্টাররা সরেজমিনে রাস্তার অবস্থা দেখেই শঙ্কার কথা লিখেছেন।
এটা মানতেই হবে, গত একযুগে অবকাঠামো এবং সড়ক যোগাযোগে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু রাস্তা বানালেই হবে না, সেটার ব্যবস্থাপনাও জরুরি। আপনি বড় বড় মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে বানালেন; কিন্তু সেখানে যদি একসাথে সব গতির যান চলে, যানজট হবেই, দুর্ঘটনা হবেই।
১০০ কিলোমিটার গতিতে চলা কোনো বাসের সামনে যখন উল্টা দিক আসা রিকশা বা ইজিবাইক পড়ে যায়, তখন দুর্ঘটনা এড়ানোর সুযোগ থাকে না। ঢাকা-মাওয়া সড়ক মানেই এক্সপ্রেসওয়ে, আসলে সেখানে সবই চলে। যে দুটি পত্রিকার শিরোনামের কথা লিখলাম, তাদের রিপোর্টাররা গিয়ে গিয়ে দেখেছেন, মহাসড়কের কোথায় কোথায় সমস্যা। রিপোর্টাররা যদি জানে বা সমস্যাটা খুঁজে বের করতে পারে; বড় বড় মন্ত্রীরা পারে না কেন?
ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এমনিতে ঠিক আছে, কিন্তু জায়গায় জায়গায় যানজট অবধারিত। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক আসলে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। কারণ উত্তরা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত যেতে আপনার শরীরের কলকব্জা ঠিক থাকবে না। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত রাস্তায় কত বছর ধরে উন্নয়ন কাজ চলছে, আমার ধারণা সংশ্লিষ্টরাও তা ভুলে গেছেন।
পথের দুর্ভোগ নিয়ে কিছু লিখলেই নীতিনির্ধারকেরা বলেন, উন্নয়নের প্রসব বেদনা। কিন্তু বেদনা যতই হোক, প্রসবের পর্যন্ত মা ও শিশুকে বেঁচে তো থাকতে হবে। এই রাস্তা কবে শেষ হবে, কেউ কি জানেন? গাবতলী-নবীনগর-ধামরাই, উত্তরা-আশুলিয়া-বাইপাইল সড়কেও উন্নয়ন কাজ চলছে। ঈদের সময় এই উন্নয়ন আমাদের কত যে দুর্ভোগের কারণ হবে, স্রষ্টা জানেন।
মূল সমস্যাটা হয় ঢাকা বা তার উপকণ্ঠে। অর্থাৎ ঢাকা থেকে বেরুতেই যত সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের অযোগ্য আমি মনে করি না। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো মনে করেন, একবার বাড়ি যাওয়া আর ফেরার জন্য অত উদ্যোগ নিয়ে কী হবে। তারচেয়ে ভালো কানে তুলো, পিঠে কুলো বেধে বসে থাকি। মানুষ, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সপ্তাহখানেক ট্রল হবে। তারপর সবাই সব ভুলে যাবে। সবাইকে আবার উন্নয়নের বড়ি গিলিয়ে দেওয়া যাবে।
গত একযুগে অবকাঠামো এবং সড়ক যোগাযোগে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু রাস্তা বানালেই হবে না, সেটার ব্যবস্থাপনাও জরুরি। আপনি বড় বড় মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে বানালেন; কিন্তু সেখানে যদি একসাথে সব গতির যান চলে, যানজট হবেই, দুর্ঘটনা হবেই।
ঢাকা থেকে কষ্টেসৃষ্টে বের হলেও ফেরিঘাটে গিয়ে আবার বসে থাকতে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মহাসড়ক স্থবির হয়ে থাকে যানজটে। শুধু সড়ক পথ নয় ভোগান্তি সর্বত্র। বিমানের টিকেট এরইমধ্যে শেষ। ট্রেনের আগাম টিকেট দেওয়া শুরু হবে ২৩ এপ্রিল থেকে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার পাঁচগুণ বেশি যাত্রী বহন করতে হবে ট্রেনকে।
বাড়তি ট্রেন, বাড়তি বগির ব্যবস্থা হচ্ছে বটে, তবে সবাই বলছেন, প্রয়োজনের তুলনায় তা নগণ্য। ফলে ট্রেনের ওপর বিশাল চাপ পড়বে। ট্রেন যাত্রার আগে অনেক ভোগান্তি টিকেট কাটা। অনলাইনে ট্রেনের টিকেট বিক্রি নিয়ে ভোগান্তি দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশ ডিজিটাল হলেও ট্রেন এখনো পারেনি। প্রায়ই শুনি সার্ভার ডাউন। এবার আবার শুনছি এনআইডি ছাড়া টিকেট কাটা যাবে না। আমার ধারণা এই ব্যবস্থা মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়াবে। একই অবস্থা লঞ্চেও। জীবনের ঝুঁকি জেনেও মানুষ লঞ্চে চড়ে।
পথে পথে এতসব দুর্ভোগ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরমে ঘেমে প্রাণ ওষ্ঠাগত; তারপরও মায়ের কাছে যেতে পারলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মানুষ তখন সব ভুলে যায়। ঈদের সময় যানবাহনের চাপে, যাত্রীর চাপে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এবার ঈদে ছুটি একটু লম্বা হতে পারে। তাই মানুষের ঢলও বাড়বে। তবে সবাই যদি একদিনে না গিয়ে আগে পরে যান, তাহলে যাত্রা কিছুটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে।
এখনো দশদিনের বেশি সময় বাকি আছে। এই সময়ে সব সমস্যা মিটিয়ে ফেলা হয়তো সম্ভব নয়। উন্নয়ন কাজও শেষ হয়ে যাবে না। তবু নীতিনির্ধারকেরা যদি আন্তরিকতা নিয়ে, মমতা নিয়ে মানুষের পাশে থাকেন; তাদের যাত্রাটা আরেকটু স্বস্তির হবে হয়তো। ঢাকা থেকে বেরুনোর পথগুলো, মহাসড়কের চিহ্নিত স্থানগুলো, ফেরিঘাটে নজরদারি বাড়িয়ে যানজট কমিয়ে রাখা অসম্ভব নয়। তবে যানজট বা দুর্ভোগের চেয়েও আমার চাওয়া মানুষ যেন বাড়ি ফিরতে পারে।
দুর্ঘটনা ঠেকাতে মহাসড়কগুলোতে কড়া নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। মহাসড়কের পাশে যেন বাজার বসতে না পারে। মহাসড়কে যেন কম গতির গাড়ি চলতে না পারে। উল্টোদিক থেকে যেন কোনো যান চলতে না পারে। আর মালিকেরা যেন তাদের চালকদের বলে দেয়, বেপরোয়া না হয়ে সাবধানে যেন গাড়ি চালায়। নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষের যাত্রা যেন দুর্ভোগের নয়, আনন্দের হয়, স্বস্তির হয়, নিরাপদ হয়।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ