বটমূলে বোমা হামলা, শফিকুরের গ্রেফতার ও সংস্কৃতির বিকাশ
পহেলা বৈশাখ আবহমান কৃষি ও সমাজ জীবনাচরণের এই প্রারম্ভ দিন ধারণ করে আছে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নিজস্বতার জগৎ। তাই বৈশাখ বরণ বাংলার প্রাণের উৎসব।
এই উৎসব কালক্রমে আনন্দ উদযাপন ও চিরায়ত চর্চায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির সর্বজনীন উপলক্ষ হয়ে উঠেছে যেমন; তেমনি ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে এই উৎসব আজ অবিনাশী প্রতিজ্ঞায় মিলিত হওয়ার কেন্দ্র। বিশ্বমঞ্চে পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা বাঙালি জাতির অনন্য প্রতীক।
সব ধর্মের মানুষের সম্মিলনে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই উৎসব এক সময় উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হয়। উদ্দেশ্য কথিত ধর্মের দোহাই দিয়ে উৎসবকে ম্লান করে দেওয়া। সে লক্ষ্যেই কিন্তু ২০০১ সালে ১৪ এপ্রিল রমনাপার্কে আয়োজিত ছায়ানটের অনুষ্ঠানে পরিকল্পিতভাবে জঙ্গিরা হামলা চালায়। হামলার ঘটনায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
যে উৎসব সবার মঙ্গলের কথা বলে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলে সেখানেই এ ধরনের বর্বরোচিত হামলা মানেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যাত্রা শুরু হওয়া। শুধু হামলার ঘটনার মধ্য দিয়েই সবকিছু কিন্তু থেমে থাকেনি। এ আতঙ্ক দেশের মানুষের হৃদয় ভেদ করে ছড়িয়েছে গোটা বিশ্বে থাকা বাঙালিদের মধ্যে। গোটা সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও প্রচণ্ড রকমের ধাক্কা লাগে।
হামলার পর দেশে বিদেশে প্রতিবাদ হয়েছে। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে একাট্টা দেখেছি সবাইকে। কিন্তু ২১ বছরেও রমনার বোমা হামলার সব মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। সকল আসামিদের গ্রেফতার পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। থামেনি সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান। বাংলাদেশকে ঘিরে ষড়যন্ত্র চলমান। তেমনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার যত সর্বজনীন উৎসব রয়েছে সেগুলোকেও নস্যাৎ করার অপচেষ্টাও একেবারেই বন্ধ হয়নি।
প্রশ্ন হলো, রমনা বটমূলে হামলার অনেক বছর কেটেছে। কেন এখনো পর্যন্ত পরিকল্পনাকারী, ঘটনার মূল হোতারা গ্রেফতার হলো না? তেমনি বাঙালি সংস্কৃতিতে আমরা কতটুকু নির্ভয়ে সামনে এগিয়ে নিতে পেরেছি?
যে উৎসব সবার মঙ্গলের কথা বলে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলে সেখানেই এ ধরনের বর্বরোচিত হামলা মানেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যাত্রা শুরু হওয়া। শুধু হামলার ঘটনার মধ্য দিয়েই সবকিছু কিন্তু থেমে থাকেনি...
সাংস্কৃতিক বিকাশ কতটুকু অগ্রসরমান? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ বিজ্ঞানমনস্ক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য অসাম্প্রদায়িক চেতনার শেকড় আমরা কতটুকু বিস্তার করতে পেরেছি এ নিয়ে ভাবনার সময় আসছে।
২০০১ সালে পয়লা বৈশাখে রাজধানীর রমনা বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ১৪ এপ্রিল ২০২২ মুফতি শফিকুর রহমানকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই ব্যক্তি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলারও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলার তদন্তে গতি সঞ্চারিত হয়।
২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর মুফতি হান্নানসহ ১৪ জনকে আসামি করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে দুটি অভিযোগপত্র দেয়। এর একটি হত্যা এবং অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। হত্যা মামলার রায় হয় হামলার প্রায় ১৩ বছর পর ২০১৪ সালের ২৩ জুন।
রায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলাটি ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এখনো বিচারাধীন। সব মিলিয়ে মামলার বিচারকাজ যেমন শেষ হয়নি তেমনি আসামিদের সাজাও কার্যকর করা যায়নি।
যে ঘটনা আমাদের সংস্কৃতি, সংবিধানকে আঘাত করেছে এর বিচার এত বিলম্বিত কেন হবে? এ কারণেই তাদের বিচার ত্বরান্বিত করা জরুরি—তারা দেশ জাতির শত্রু। তারা যতদিন বিচারের মুখোমুখি না হবে ততদিন পর্যন্ত ষড়যন্ত্র চলবে। বিচার হওয়া মানেই অপরাধীরা ভয়ে থাকবে। সংস্কৃতির গতি আরও ত্বরান্বিত হবে।
গান-বাজনা হারাম বলে তারা ওয়াজ করে। তাদের মূল লক্ষ হলো, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে কথিত ধর্ম ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্যে কিন্তু এখনো কাজ চলছে। এবার নতুন করে জাগ্রত হয়েছে উগ্র ধর্মান্ধ চেতনা।
আকাশ সংস্কৃতির চাপ, উগ্রবাদীদের নতুন নতুন চোখ রাঙানি, সরকারের চাপিয়ে রাখার মানসিকতা, রাজনৈতিক আপসকামিতা, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অর্থনৈতিক সংকট, শেকড়ের প্রতি বিমুখ হওয়া সব মিলিয়ে একটি প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
তবে অপশক্তির চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে সবাই কমবেশি একাট্টা থাকলেও সংস্কৃতি আমরা এগিয়ে নিতে পারিনি। আকাশ সংস্কৃতির চাপ, উগ্রবাদীদের নতুন নতুন চোখ রাঙানি, সরকারের চাপিয়ে রাখার মানসিকতা, রাজনৈতিক আপসকামিতা, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অর্থনৈতিক সংকট, শেকড়ের প্রতি বিমুখ হওয়া সব মিলিয়ে একটি প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বলতে গেলে সময় ভালো যাচ্ছে না।
শেষ ভরসার জায়গা হলো আমাদের আত্মশক্তি। দৃঢ়তা। সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবারের পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছেন তা অন্ধকার অনেকটাই দূর করবে বলে বিশ্বাস। জাগিয়ে তুলবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষদের।
তিনি বলেছেন, ‘সকল সঙ্কীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পয়লা বৈশাখ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। মনের ভেতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যমে বাঁচার শক্তি জোগায়, স্বপ্ন দেখায়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়’
তিনি বলেন, ‘বাঙালির মুখের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে উপজীব্য করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একদিন এদেশে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল। যার উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা মানে আমাদের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা’।
এটি সবার জন্য খুবই আশার কথা। আমরা যারা নানা কারণে থেমে যাওয়ার চিন্তা করছি প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর একটু হলেও সবার মধ্যে গতি সঞ্চারিত হবে বিশ্বাস করি।
শেষ কথা হলো যতোই কালো মেঘ থাক তা ভেদ করে এগিয়ে যেতে হবে। অপশক্তির কাছে বাঙালি কোনদিন মাথা নত করেনি, করবেও না। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে চাই,
‘জীবনের এই পথ, কে বলিতে পারে
বাকি আছে কত?
মাঝে কত বিঘ্নশোক, কত ক্ষুরধারে
হৃদয়ের ক্ষত?
পুনর্বার কালি হতে চলিব সে তপ্ত পথে,
ক্ষমা করো আজিকার মতো--
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।’
রাজন ভট্টাচার্য ।। সাংবাদিক ও কলাম লেখক