মিলিত প্রাণের কলরবে ‘সংক্রান্তি ও বৈশাখ’
সংস্কৃতি বনাম, ভাষা বনাম, ধর্ম। একই সংস্কৃতির লোক যেমন ভিন্নভাষী, ভিন্নধর্মী হতে পারে, তেমনি সমভাষী লোক পালন করতে পারে ভিন্ন ধর্ম কিংবা অনুসরণ করতে পারে ভিন্ন সংস্কৃতি।
ভাষা ও সংস্কৃতির সৃষ্টি হয় দই পাতার মতো করে। কুসুম গরম দুধের সঙ্গে পূর্বের কিছু দই মিশিয়ে, বিশেষ উত্তাপে কিছু সময় রেখে দিলে সেই দুধ জমে দইয়ে পরিণত হয়। একাধিক সংস্কৃতিও বিশেষ পরিস্থিতিতে পরস্পরের সঙ্গে মিশে কিছুকাল পর বিচিত্র ও নতুন স্বাদের এক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।
এমন এক সময় ছিল, যখন দুই মানবগোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র একে অপরকে মেরে ফেলাই ছিল আচরণীয় সংস্কৃতি। নির্বিচারে অন্যকে খুন করতে সক্ষম বা ‘কাবিল’ ছিল যে সব প্রাইমেট, তারাই আগে পরে টিকে গেছে। নৃশংসতম প্রাইমেটরাই আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ।
ঘৃণা মানুষের সহজাত একটি প্রবৃত্তি, পক্ষান্তরে ভালোবাসা একটি অর্জিত প্রবৃত্তি। সভ্যতার পূর্বেও ঘৃণা ছিল, সভ্য হতে হতে মানুষকে ভালোবাসা শিখতে হয়েছে, কিংবা হয়তো ভালোবাসতে শিখেই মানুষ সভ্য হয়েছে।
মানুষ কেন পরস্পরকে ঘৃণা করে? ঠিক যে কারণে এক পাড়ার কুকুর অন্য পাড়ার কুকুরকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে খেঁকিয়ে আসে, সেই একই কারণে। কেক ছোট, খানেওয়ালা বেশি। আমি, আমার গোষ্ঠীর লোক যদি কেকের পুরোটা খেয়ে ফেলতে পারি, তবে আমার, আমাদের গোষ্ঠীর পুষ্টি।
আমার বা আমাদের কেকে যদি অন্য কেউ ভাগ বসাতে আসে, তবে আমার বা আমাদের পুষ্টির সম্ভাবনা কমে যায়। অন্যকে কেকের ভাগ না দিতে চাইলে তাকে মেরে ফেলাই সবচেয়ে সুবিধাজনক। উপমহাদেশ এবং অন্যত্র সংখ্যালঘু নির্যাতনের মূলে আছে অন্যের কেক কেড়ে খাওয়ার সহজাত তাড়না।
সভ্যতার ইতিহাসে দ্বন্দ্ব শুধু নয়, সমন্বয়েরও প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। আপনি চান বা না চান, ধর্ম, ভাষা এবং সংস্কৃতি—গোষ্ঠী গঠনের প্রধান এই তিন নিয়ামক উপাদান পরস্পরের সঙ্গে মিশতে বাধ্য। বিদ্যমান ভাষাকে নতুন ধর্ম কখনোই উপেক্ষা করতে পারে না।
সভ্যতার ইতিহাসে দ্বন্দ্ব শুধু নয়, সমন্বয়েরও প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। আপনি চান বা না চান, ধর্ম, ভাষা এবং সংস্কৃতি—গোষ্ঠী গঠনের প্রধান এই তিন নিয়ামক উপাদান পরস্পরের সঙ্গে মিশতে বাধ্য।
ইসলাম ধর্মকে আরবি ভাষা, হিন্দু ধর্মকে সংস্কৃত ভাষা অবলম্বন করতে হয়েছিল। নতুন ধর্মকে বিদ্যমান সংস্কৃতির উপাদানগুলোও কমবেশি মেনে নিতে হয়, বিশেষ জনগোষ্ঠীর কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রয়োজনে।
জাহিলিয়া যুগের সংস্কৃতির একাধিক উপাদান, যেমন জ্বীন, হজ্ব, হজরে আসওয়াদ ইত্যাদি ইসলামে অঙ্গীভূত হয়েছিল। ভারতবর্ষের বৃক্ষপূজা, নদীপূজা, ব্রত ইত্যাদিকে মেনে নিতে হয়েছিল বহিরাগত আর্যধর্মকে।
সংস্কৃতি ও ধর্ম উভয়কে ধারণ করে ভাষা। বাঙালি হিন্দু যেমন ‘বিসমিল্লায় গলদ’ বলে, বাঙালি মুসলমানও ‘গোঁয়ার-গোবিন্দ’ কিংবা ‘ঘরের লক্ষ্মী’ বলে ফেলে। ভাষা সহাবস্থানে বিশ্বাসী। ‘বিয়েশাদী’, ‘জল-হাওয়া’, ‘নামাজ-কালাম’ ইত্যাদি শব্দে ভিন্ন ভাষার কৃতঋণ শব্দ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘আল্লাহ-পাক’ শব্দের দ্বিতীয় অংশে লুকিয়ে আছে আর্য অগ্নিদেবতা ‘পাবক’ শব্দের অপভ্রংশ। সেলাই করা পোশাকের অনারব সংস্কৃতি গ্রহণ করে আরবেরা জেল্লাবা বা পাজামা পরে আসছে, যে পোশাক হজরত ওমরেরও নাকি পছন্দ ছিল না। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র সপ্তাতে দুই দিন হাট ছিল, কিন্তু আরব সংস্কৃতির ‘বাজার’ এবং ‘দোকান’ পৃথিবীর কোথায় নেই এখন?
মাঝেমধ্যেই মনের আদিম, সহজাত ঘৃণার তাড়নায় এক মানবগোষ্ঠী অন্য একটি প্রতিযোগী গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার অজুহাত খোঁজে। যেকোনো পার্থক্য, যেমন গাত্রবর্ণ, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা সেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের জন্যে কোন পরিবেশ সহায়ক হতে পারে, ঘৃণা নাকি ভালোবাসা? সংস্কৃতি ও ধর্মের সমন্বয়, নাকি অন্য ধর্ম বা অন্য সংস্কৃতির প্রতি বিরোধ-বিদ্বেষ?
ইউরোপে জ্ঞানের বিকাশে ভূমিকা রেখেছিল ৮ম-১৫শ শতকের আন্দালুসিয়ার আরব শাসন। এই জ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছিল অনুবাদ দিয়ে, আরবি থেকে ল্যাটিন, ল্যাটিন থেকে আরবি। এই অনুবাদ ও জ্ঞানচর্চায় মূল ভূমিকা রেখেছিল ‘মোজারাব’ নামক একটি গোষ্ঠী, যাদের বেশিরভাগ ধর্মে ছিলেন খ্রিস্টান, কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতিতে ছিলেন আরব।
সংস্কৃতিকে সংস্কৃতির জায়গায় থাকতে দিন, ধর্মকে থাকতে দিন ধর্মের জায়গায়। প্রত্যেকে যার যার ধর্ম পালন করুন, কিন্তু বাঙালি হিসেবে চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখও পালন করুন।
ভারতবর্ষেও প্রায় সাতশ বছরের মুসলমান শাসনে শিক্ষিত হিন্দুরা ফার্সি শিখেছিলেন, যার প্রমাণ, উত্তর ভারতের ভাষাগুলো এখনো ‘যাবনিমিশাল’, অর্থাৎ প্রচুর আরবি-ফার্সি শব্দে ভাষাগুলো সয়লাব।
সুতরাং সংস্কৃতিকে সংস্কৃতির জায়গায় থাকতে দিন, ধর্মকে থাকতে দিন ধর্মের জায়গায়। প্রত্যেকে যার যার ধর্ম পালন করুন, কিন্তু বাঙালি হিসেবে চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখও পালন করুন। অন্ততপক্ষে নিজে পালন করতে ইচ্ছে না হলে অন্যকে পালন করতে দিন। সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করেই ইতিহাসে ধর্মকে টিকে থাকতে হয়েছে সবসময়।
ভাষা ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্বে লাভের চেয়ে ধর্মের ক্ষতিই বেশি হয়। সংস্কৃতির পুষ্টি প্রধানত প্রদর্শন ও আচরণে আর ধর্মের পুষ্টি প্রধানত অনুভবে। অনুভব নয়, বরং অন্যকে দেখানোর জন্যে যারা ধর্ম পালন করে, তারা অনেকটা সুপারম্যানের মতো প্যান্টের উপর জাঙ্গিয়া পরে থাকে। এই জাঙ্গিয়া কিংবা জঙ্গিপনা—দুটোই অন্যকে কেক থেকে বঞ্চিত করার রাজনৈতিক কৌশল মাত্র।
সংস্কৃতির মিশ্রণের অন্যতম উদাহরণ পহেলা বৈশাখ। এ তথ্য মোটামুটি স্বীকৃত যে, মোঘল সম্রাট আকবর হিজরি চান্দ্র বৎসরের পরিবর্তে অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত সৌর ফসলি সন প্রবর্তন করেছিলেন।
আন্দালুসিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যেও চান্দ্রসনের পরিবর্তে সৌরসন ব্যবহৃত হতো। অনুরূপ একটি সন সম্ভবত অনাদি কাল থেকেই দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত ছিল, আকবর সেই সনকে বৈধতা দিয়েছিলেন মাত্র। এই সনের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসব।
এই জাতীয় উৎসবকে ‘হিন্দুয়ানি’ বলা মানে ইসলামকে অনর্থক, খামাকা বাঙালি সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া। এটা অনেকটা ফাজিল, মন্দবুদ্ধি লোকজনের মতো কোনো অবোধ শিশুকে জিজ্ঞেস করার মতো, ‘বলোতো বাবু, কে বেশি ভালো, বাবা নাকি মা? শিশু বুদ্ধিমান হলে জবাব দেয়, ‘দুজনেই ভালো, দুজনকেই আমি ভালোবাসি।’ কিন্তু সব শিশুর মাথায় যে অনুরূপ সুবুদ্ধি থাকবেই, তার এমন কি নিশ্চয়তা আছে? প্রায়ই দেখা যায়, ধর্ম আর সংস্কৃতির মধ্যে একটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে মানুষ দুটোকেই হারায়।
শিশির ভট্টাচার্য্য ।। অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়