গণমাধ্যম ততটাই সাহসী, যতটা তার সম্পাদক
১
অনেকেই গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের কাছে নিরপেক্ষতা আশা করেন। কিন্তু বিবেক-বিবেচনা আছে, প্রজ্ঞা আছে; এমন কোনো মানুষ নিরপেক্ষ হতে পারে না। শুধু রোবটের পক্ষেই নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব। একজন সাংবাদিক সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশের সদস্য। তিনি সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, ন্যায্য-অন্যায্যের পার্থক্য নিজে বুঝবেন; মানুষকে বুঝতে সহায়তা করবেন এবং অবশ্যই তিনি সত্যের পক্ষে, ভালোর পক্ষে, ন্যায্যর পক্ষে থাকবেন। এখানে নিরপেক্ষতার কোনো সুযোগ নেই। আপনার সম্পাদিত পত্রিকা বা গণমাধ্যমই জানান দেবে আপনি কোন পক্ষে। তবে এইসব কথা লেখা যত সহজ, বলা যত সহজ; বাস্তবে ততই কঠিন। তারচেয়ে বড় কথা হলো ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায্য-অন্যায্য মাপার কাঠিটা কে ঠিক করবে? আমার কাছে যেটা ভালো, আপনার কাছে তো সেটা ভালো নাও মনে হতে পারে। এই যেমন ধরুন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা আমার চাওয়া। আবার বিপুল সংখ্যক মানুষ আছেন, যারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা মনে করেন। এখন আপনার সিদ্ধান্ত আপনি কোন পক্ষে থাকবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি সবসময় ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে থাকবো। কারণ আমি জানি, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষতা সব ধর্মের মানুষের ধর্মপালনের স্বাধীনতা দেয়।
আমরা মুখে যাই বলি, সাংবাদিকতা একটি কঠিন পেশা। এরমধ্যে কঠিন কাজ হলো সম্পাদকের। পুরো প্রতিষ্ঠানের দায় নিতে হয় তাকে। মন্ত্রী-এমপিদের শপথে বলতে হয়, ‘আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’ এই শপথ আসলে প্রতিটি পেশাজীবী, আসলে প্রতিটি মানুষেরই মেনে চলা উচিত। তবে যারা শপথ নেন, তারাই এটা মেনে চলেন না; আর যারা নেন না, তাদের কাছে তো আশা করাই অবান্তর। বাংলাদেশের অনেক পেশারই কিছু পূর্বশর্ত আছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবীদের একাডেমিক যোগ্যতা তো লাগেই, নিজস্ব অ্যাক্রিডিটেশন প্রতিষ্ঠানের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সাংবাদিক হতে কোনো যোগ্যতা লাগেই না, কোনো লিখিত-অলিখিত শপথও নিতে হয় না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের শপথের উদ্ধৃত অংশটুকু প্রত্যেক সাংবাদিকের জন্য অবশ্য মান্য। ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সকলের আচরণ করাটা একজন সাংবাদিকের মৌলিক পাঠ। কিন্তু বাংলাদেশে এইটুকু মেনে চলা প্রায় অসম্ভব। হয় ভীতি, নয় অনুগ্রহ; হয় অনুরাগ, নয় বিরাগের আমাদের বিবেচনা বোধের সূর্যকে আড়াল করে দেয়। বলাই হয়, একজন ভালো সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই। কিন্তু বন্ধু না থাকলে তিনি সমাজে থাকবেন কীভাবে? খবর পাবেন কীভাবে? এখানেই বলা হয়, একজন ভালো সাংবাদিক বা সম্পাদক তার বন্ধুত্বের, সামাজিকতার সীমাটা জানবেন এবং সেটা মেনে চলবেন। বলা হয়, একজন সাংবাদিক কারো ততটা কাছে যাবেন না, যতটা কাছে গেলে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হবে। আবার ততটা দূরেও থাকা যাবে না, যতটা দূরে থাকলে আপনি সংবাদ থেকে বঞ্চিত হবেন। সমস্যা হলো, আমরা সীমাটা জানি বটে, কিন্তু মানি না। সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি সামাজিক। সব আড্ডায় তাদের দেখা যায়। এসব আড্ডায় অনেক নিউজ যেমন পাওয়া যায়, আবার অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠতাও সীমা ছাড়িয়ে যায়। তখনই সৃষ্টি হয় স্বার্থের সংঘাত, অনুরাগ, কখনো কখনো বিরাগ।
সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি সামাজিক। সব আড্ডায় তাদের দেখা যায়। এসব আড্ডায় অনেক নিউজ যেমন পাওয়া যায়, আবার অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠতাও সীমা ছাড়িয়ে যায়। তখনই সৃষ্টি হয় স্বার্থের সংঘাত, অনুরাগ, কখনো কখনো বিরাগ।
বাংলাদেশে অনেকে টাকার জোরে ভাগ্যক্রমে সম্পাদক হয়েছেন। আবার অনেকেই আছেন, ধাপে ধাপে নিজ যোগ্যতায় সম্পাদকের আসন অলঙ্কৃত করেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে তিনি সামাজিকতার নানান জালে জড়িয়ে যান। সব মহলের যোগাযোগ থাকাটা যেমন একজন ভালো সম্পাদকের যোগ্যতা, তেমনি অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগের কারণে অনেক অনুরোধও তাকে রাখতে হয়। কখনো ভীতি বা অনুগ্রহে, অনুরাগে বা বিরাগে তাকে অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হয়। সমস্যা হলো সব অনুরোধ উপেক্ষা করার মত সাহস, সততা আমাদের সব সম্পাদকের নেই। ভুল নিউজ ছাপানো যেমন অপরাধ, সঠিক নিউজ না ছাপানোও তেমনি অপরাধ। আমি বলতে পারি, নিউজ ছাপানোর চেয়ে না ছাপিয়ে অপসাংবাদিকতা বেশি হয়। হাতে নিউজ নিয়ে সেটা না ছাপানোর জন্য দর কষাকষি করার ঘটনা প্রায়শই ঘটে। দর কষাকষির কথা বাদ দিন, কোনো লেনদেন ছাড়া নিছক ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব বা সম্পর্কের সুবাদেও অনেক নিউজ আলোর মুখ দেখে না। আগেই বলেছি, সব মহলের সাথে যোগাযোগ থাকাটা যেমন একজন সম্পাদকের যোগ্যতা, তেমনি বড় অযোগ্যতাও।
২
বেশ কয়েকবছর আগের কথা। আমার এক পরিচিত ব্যক্তি অভিযোগ করলেন, তিনি এক কোম্পানি থেকে ফ্ল্যাট কিনেছেন। পরে দেখেন, একই ফ্ল্যাট আরও অন্তত ছয় জনের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। শুধু তিনি নন, ঐ ভবনের সবগুলো ফ্ল্যাটই অনেকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। আমাদের এক রিপোর্টারকে বললাম খোঁজ নিতে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানালেন ঘটনা সত্য। সবার সাথে যোগাযোগ করে তিনি রিপোর্ট তৈরি করলেন। সবশেষে ফোন করলেন, সেই কোম্পানির মালিককে। ফোন করার দশ মিনিটের মধ্যে সম্পাদক জানালেন, অমুক কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট যাবে না। লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সেই বন্ধু হয়তো ভেবে বসে আছেন, আমার সাথে বা আমাদের রিপোর্টারের সাথে সেই কোম্পানির কোনো অনৈতিক আঁতাত হয়ে গেছে।
সাংবাদিকতা করতে চান, এমন তরুণ-তরুণীদের আমি প্রথমে ভয় দেখাই। সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ-ইত্যাদি কথা শিখে তারা বড় হয়, স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে দেখবে, যা করতে চায়, তার অনেককিছুই করা যাচ্ছে না। সেই তরুণ রিপোর্টার হয়তো কারো বিরুদ্ধে বিশাল এক দুর্নীতির রিপোর্ট নিয়ে আসলো। কিন্তু অফিসে আসার পর জানলো, রিপোর্ট ছাপা হবে না। কারণ সেই দুর্নীতিবাজ সম্পাদকের বন্ধু বা পরিচিত। এই সমস্যা অহরহ হয়। সম্পাদকের এই স্বার্থের সংঘাত মন ভেঙ্গে দেয় তরুণ রিপোর্টারের, ধ্বংস করে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা।
টাকার জোরে ‘আমার দেশ’এর সম্পাদক হয়েছিলেন প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান। সাংবাদিক হিসেবে তার প্রথম পদবী ‘সম্পাদক’। মাহমুদুর রহমান বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ২০১৩ সালে মাহমুদুর রহমান এবং ‘আমার দেশ’ সাংবাদিকতার নামে যা করেছে, তা বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে কলঙ্ক জনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশে সাংবাদিক হতেও কোনো যোগ্যতা লাগে না, সম্পাদক হতেও লাগে না। অবশ্য সাংবাদিক বা সম্পাদক হওয়ার যে সত্যিকারের যোগ্যতা তা কাগুজে সার্টিফিকেট দিয়ে হয় না। তাই নির্ধারিত যোগ্যতাও অপ্রাসঙ্গিক। আর এই সুযোগে মূর্খ দালালরাও সাংবাদিক বনে যান। আর অর্থ থাকলেই যেন সম্পাদক হওয়া যায়। অথচ সম্পাদক হতে হলে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে তিনি সম্পাদক হবেন। কিন্তু বাংলাদেশে টাকা থাকলে যিনি মালিক, তিনিই সম্পাদক বনে যান। ফলে ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান’র ধারণাটাই দাঁড়ায় না। টাকার জোরে ‘আমার দেশ’এর সম্পাদক হয়েছিলেন প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান। সাংবাদিক হিসেবে তার প্রথম পদবী ‘সম্পাদক’। মাহমুদুর রহমান বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পক্ষে থাকুন আর বিপক্ষে, আপনার প্রকাশিত তথ্য হতে হবে সঠিক। আর আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমাও সংবিধানে নির্ধারিত। ২০১৩ সালে মাহমুদুর রহমান এবং ‘আমার দেশ’ সাংবাদিকতার নামে যা করেছে, তা বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে কলঙ্ক জনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। তিনি সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের ধারণাকেই দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছেন। সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা, সংবিধান- সব যেন ছিল তার কাছে খেলনা। সেই মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতেও বিবৃতি দিয়েছে এডিটর্স কাউন্সিল। তবে এই এডিটরস কাউন্সিল এবং এডিটরস গিল্ডই পারে বাংলাদেশে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের ধারণাটি ফিরিয়ে আনতে। সম্পাদকরা মিলে বসে সাংবাদিকদের জন্য অবশ্য পালনীয় নীতিমালা, সম্পাদকদের মর্যাদা রক্ষায় করণীয় ঠিক করে নিতে পারেন। যাতে ‘সম্পাদক’ বললেই আমরা বুঝি, নীতি-নৈতিকতা, প্রজ্ঞা আর বিবেকের সর্বোচ্চ প্রয়োগের একজন ব্যক্তিত্ব।
৩
সম্পাদককে প্রজ্ঞায় সবার চেয়ে আলাদা থাকতে হবে। তার বিবেক-বিবেচনা হতে হবে প্রখর, তার সততা হতে হবে প্রশ্নাতীত। তাকে সাহসী হতে হবে, দায়িত্বশীল হতে হবে। তার প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মীর দায়িত্ব নিতে হবে, ছাপা হওয়া প্রতিটি অক্ষরের দায়িত্ব নিতে হবে। ভুল হতেই পারে। আর ভুল করলে তা শুধরে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করা যাবে না। লেখায়, চিন্তায় যেন নির্দোষ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। ভয় এবং পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে উঠে তাকে ভাবতে হবে। আমি কোনো সম্পাদকের কাছে নিরপেক্ষতা আশা করবো না। তবে আমি আশা করবো, তার চিন্তা বা বিবেক কোনো দলীয় আনুগত্যে আচ্ছন্ন থাকবে না। তার চোখ যেন দুটিই থাকে। সব দলের, সব মতের, সব মানুষের ভুল বা বিচ্যুতি যেন তার চোখে পড়ে।
সম্পাদক হিসেবে হওয়া উচিত পক্ষপাতহীন। আপনি শুধু সত্যটা লিখবেন। একজন সম্পাদকের চোখে যেন সব দলের-মতের ভালো-মন্দ সবটাই চোখে পড়ে। উন্নয়নের পেছনে যদি কোনো দুর্নীতি থাকে, সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্রহীনতা, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার খবরও আপনাকেই লিখতে হবে। তাহলেই আপনি ভালো সম্পাদক, সমাজের দর্পণ।
একটি গণমাধ্যম ততটাই সাহসী, যতটা তার সম্পাদক। একজন সম্পাদককে সবসময় মনে মনে শপথ নিতে হবে, ‘আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ