সাইবার বুলিংয়ের শিকার শিশু থেকে তারকা : সমাধান কোথায়?
ডিজিটাল প্রযুক্তি বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে বুলিং করা হলে সেটিকে আমরা সাইবার বুলিং বলে থাকি। সাধারণত কাউকে হয়রানি করা, ভয় দেখানো, রাগানো, লজ্জা দেওয়া, অপদস্থ করা, অসম্মান করা এ জাতীয় নানা ধরনের কর্মকাণ্ড বুলিংয়ের আওতায় পড়ে।
হেনস্থাকারীদের কাছে কিছু আচরণ স্বাভাবিক মনে হতে পারে, মনে হতে পারে, সেটি নিছক মজা করার উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে, কিন্তু হেনস্থার শিকার ব্যক্তির নিকট সেটি হয়তো অপ্রত্যাশিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত, সেরূপ আচরণ এবং সেটির পুনরাবৃত্তিও বুলিং হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে।
ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসারের কারণে বর্তমানে সাইবার বুলিং স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী তথা শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে ৩০টি দেশে ইউনিসেফ কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি তিনজন মানুষের একজন সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে এবং প্রতি পাঁচজনের একজনকে স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়েছে সাইবার বুলিং এবং তৎসংশ্লিষ্ট সহিংসতার কারণে।
আমাদের বাংলাদেশও বৈশ্বিক সেই ধারার বাইরে নয়। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগামী প্রায় ১২৮১ জন শিক্ষার্থীর উপর ইউনিসেফ কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক অন্য আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৩২ ভাগ শিক্ষার্থী সাইবার আক্রমণ, সাইবার বুলিংসহ নানাধরনের হয়রানির শিকার হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বুলিংয়ের শিকার হলে করণীয় কী? প্রযুক্তিগত সমাধানের বাইরে, ব্যক্তি কিংবা পারিবারিক পর্যায়ে কী করা যেতে পারে? প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে, কাউকে না কাউকে ঘটনা বলে সাহায্য চাওয়া।
সামনাসামনি হওয়া বুলিং আর ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে করা সাইবার বুলিংয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, ডিজিটাল পরিমণ্ডলে করা বুলিংয়ের প্রমাণ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিদ্যমান থাকতে পারে। সেটি ঘটনার শিকার ব্যক্তি বা শিশুর সারাজীবনের জন্য হয়রানির কারণ হয়ে থাকতে পারে, হতে পারে তার মানসিক কিংবা শারীরিক ক্ষতির কারণ।
বিভিন্ন ডেটা এবং পরিসংখ্যান বলছে, সাইবার বুলিংয়ের শিকার শিশুদের মধ্যে মাদকাসক্তির হার বেড়ে যায়, কমে যায় আত্মবিশ্বাস। বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা থেকে শুরু করে আত্মহননের ঘটনার উদাহরণও কম নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, বুলিংয়ের শিকার হলে করণীয় কী? প্রযুক্তিগত সমাধানের বাইরে, ব্যক্তি কিংবা পারিবারিক পর্যায়ে কী করা যেতে পারে? প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে, কাউকে না কাউকে ঘটনা বলে সাহায্য চাওয়া। সেটি পিতামাতা হোক, শিক্ষক হোক বা কাছের কোনো বিশ্বস্ত মানুষ হোক।
২০১৯ সালের আমেরিকার ন্যাশনাল ক্রাইম প্রিভেনশন কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী, প্রতারণা বা আক্রমণের শিকার টিনেজারদের প্রতি দশজনের মধ্যে মাত্র একজন অভিভাবক কিংবা বিশ্বস্ত কাউকে জানায়। বাকি নয়জনের না জানানোর কারণ উল্লেখযোগ্য এক কারণ হতে পারে বড়দের কাছ থেকে যথেষ্ট মনোযোগ না পাওয়া। এক্ষেত্রে অভিভাবকেরও দায়িত্ব হলো শিশুদের সাথে এগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা বা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন নিয়ে আন্তরিকতার সাথে জানতে চাওয়া।
তবে, প্রতিকার হিসেবে ইন্টারনেট বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার বন্ধ করা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এতে করে হেনস্থাকারী বরং উৎসাহিত হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়াতে বুলিং হয়ে থাকলে ব্লক করা, প্রাইভেসি সেট করাসহ ইত্যাদি নানা উপায়ে হেনস্থাকারীকে বিরত রাখা যেতে পারে।
কে মেসেজ পাঠাতে পারবে, কে পারবে না, কে কমেন্ট করতে পারবে, কে পারবে না, প্রাইভেসি সেটিংসের মাধ্যমে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা রিপোর্ট করার ব্যবস্থাও আছে। প্রয়োজন হলে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ (যেমন, স্ক্রিনশট) রেখে দিতে হবে, যাতে করে পরবর্তীতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার উপায় থাকে।
শিশুদের পাশাপাশি ব্যাপক হারে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে দেখা যায় তারকা বা খ্যাতিমান ব্যক্তিদের। পাবলিক ফিগার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পী, তারকা ব্যক্তিত্ব, খেলোয়াড়, সাংবাদিক, সম্পাদক এমনকি তাদের পরিবারের সদস্য পর্যন্ত বাদ থাকছে না।
এছাড়া, ডিজিটাল জগতে নিজের ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন, ঠিকানা, ফোন নম্বর, ভ্রমণকালীন অবস্থান ইত্যাদি শেয়ার করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বন্ধু-বান্ধবদের কেউ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, প্রয়োজনে তাদেরকে সাহায্য করতে পারে এমন কাউকে খুঁজে পেতে সহায়তা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দুঃসময়ে তাদের পাশে যে কেউ আছে, এই বোধটুকু তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলা খুব জরুরি।
শিশুদের পাশাপাশি ব্যাপক হারে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে দেখা যায় তারকা বা খ্যাতিমান ব্যক্তিদের। পাবলিক ফিগার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পী, তারকা ব্যক্তিত্ব, খেলোয়াড়, সাংবাদিক, সম্পাদক এমনকি তাদের পরিবারের সদস্য পর্যন্ত বাদ থাকছে না। অশ্লীল-কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, অযাচিত প্রচার-প্রচারণা থেকে শুরু করে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের স্পর্শকাতর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সাইবার বুলিং করে ভুক্তভোগী বানানো হয় প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় এই ব্যক্তিদের।
২০১৩ সালে পোলিশ তরুণ-তরুণীদের মাঝে পরিচালিত এক গবেষণা জরিপে (Pyżalski, 2013) দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ১৪ ভাগ কোনো না কোনোভাবে তারকাদের বুলিং করেছেন। স্কুলগামী কিশোরীদের মতামতের উপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালে বেলজিয়ামে করা অন্য একটি গবেষণা প্রতিবেদনে (Ouvrein et al., 2017) উঠে এসেছে যে, মতামত দেওয়া কিশোরীরা মনে করেন, তারকারা বিখ্যাত, আর বিখ্যাতদের বুলিং সামলাতে পারতে হবে বা মেনে নিতে হবে।
কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে, এই তারকা কিংবা তারকা ব্যক্তিরাও সমাজের অন্য আর সব মানুষজনের মতোই। তাদের, মানসিক সক্ষমতা সমাজের অন্য আর দশজনের চেয়ে আলাদা হওয়ার যৌক্তিক কারণ নেই। বুলিংয়ের শিকার হয়ে, বিভিন্ন দেশে তারকাদেরও আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার খবর মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায়। এ সমস্ত তারকা ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া বা তাদের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার উদাহরণ তো অহরহই দেখতে পাওয়া যায়।
আসলে শিশু হোক কিংবা তারকা হোক, অপ্রাপ্তবয়স্ক কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক হোক, সকল ক্ষেত্রেই চারপাশের মানুষগুলোর উচিত এই ধরনের অন্যায় হতে দেখলে সেগুলো সমর্থন না করা। প্রয়োজন ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানো।
২০১৯ সালের চিলড্রেন্স সোসাইটির জরিপ অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারী শতকরা ৬০ ভাগ তরুণ-তরুণী অনলাইনে সাইবার বুলিং দেখেও কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বা পদক্ষেপ নেয়নি। এই তথ্য আমাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক নয়।
সাইবার বুলিং বা সমজাতীয় সংকটের ক্ষেত্রে, পরিবার, বন্ধু, সমাজ, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্রের পাশে থাকা, সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
আক্রমণের শিকার ব্যক্তি, তিনি যেই হয়ে থাকুন না কেন, তিনি যেন উপলব্ধি করতে পারেন, ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড হোক আর ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড হোক, আমাদের চারপাশে আক্রমণকারী মানুষের চেয়ে উদ্ধারকারী মানুষের সংখ্যাই বেশি, বিদ্বেষ ধর্মী মানুষের চেয়ে সহমর্মী মানুষের সংখ্যাই বেশি।
ড. বি এম মইনুল হোসেন ।। সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়