গাঙ্গুবাঈ : নির্যাতিতা নারীদের বজ্রকণ্ঠ
গুজরাটের কাঠিয়াওয়ার গ্রামের একটি অতি সাধারণ মেয়ে নাম গঙ্গা। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতো বোম্বে (মুম্বাই) সিনেমার একজন বড় নায়িকা হবে। কিন্তু নিয়তি তাকে নিয়ে আসে মুম্বাইয়ের স্টুডিওর পরিবর্তে কুখ্যাত এক রেড লাইট এলাকা কামাঠিপুরায়। মুম্বাইয়ের সেই রেডলাইট এলাকা কামাঠিপুরার উন্নয়নের জন্য রাজনীতিতেকেই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার মনে করেছিলেন বদলে যাওয়া গঙ্গা।
যৌনপল্লির পতিতা নারীদের লড়াই, যন্ত্রণা, তাদের সন্তানদের যোগ্য সম্মানের দাবিতে সরব হতে গিয়ে গঙ্গা থেকে হয়ে ওঠেন গাঙ্গুবাঈ। ইতিহাসের পাতা নাড়লে দেখা যায়, এলাকার ম্যাডামজি নামেই পরিচিত ছিলেন গাঙ্গুবাই। বলা হয়, ১৯৬০-এর দশকে মুম্বাইয়ের রেড লাইট এলাকা কামাঠিপুরার সবচেয়ে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন গাঙ্গুবাঈ। কীভাবে গুজরাটের এক গ্রামের সাধারণ মেয়ে হয়ে উঠল কামাঠিপুরার ম্যাডামজি।
মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সমস্ত খবর থাকে যার নখদর্পণে। যার দাপটে সিঁটিয়ে গিয়েছিল সমাজের তৎকালীন কথিত ভদ্রলোকেরা। তা এবার রূপালি পর্দায় তুলে ধরে দর্শকদের সামনে নিয়ে এলেন পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালি। বিপরীতে থাকা রাজিয়া বাঈকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন বা কামাঠিপুরের মাফিয়া কুইনের নাভিশ্বাস হয়ে ওঠা প্রতিটা মুহূর্তকে পর্দায় জীবন্ত করে তোলার আলিয়া ভাটের অক্লান্ত প্রয়াস যেন চারদিকে আলোচনা উসকে দিয়েছে।
ছবিতে সেই মাফিয়া কুইন গাঙ্গুবাঈয়ের চরিত্রেই দেখা যায় আলিয়াকে। সাধারণ কিশোরীর নির্মমতা ভেদ করে গণিকালয়ের মালকিন হয়ে ওঠার জীবন সফর বানসালি তারমতো করে ফুটিতে তোলার চেষ্টা করেছেন এই গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি (Gangubai Kathiawadi) ছবিতে।
সঞ্জয় লীলা বানসালির সাদা, সবুজ এবং সেপিয়ার টিন্ট রঙ দিয়ে আঁকার প্রচেষ্টায় দৃশ্যের ফ্রেমগুলি মিলে তৈরি হওয়া ছবিটিতে দর্শকদের আগ্রহ বাঁচিয়ে রাখতে অবিরাম সংগ্রাম করতে হবে ঠিকই কিন্তু দর্শক এর পরিণতিটাও দেখতে আগ্রহী হবে। যদিও বানসালি এখানে গাঙ্গুবাঈয়ের মৃত্যু দেখাননি। একটি সুবিশাল সেটের মধ্যে ছবিটি আধুনিক যুগের কামাঠিপুরায় শুরু হয়ে দর্শকদের ফ্ল্যাশব্যাক প্রকিয়ায় নিয়ে যায়। যেখানে সকলের গঙ্গার সঙ্গে পরিচয় হয়, যিনি নায়িকা হওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি পেয়ে প্রেমিকের সাথে ছোট শহর ছেড়ে মুম্বাই চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু আসল জীবনে গঙ্গা তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে প্রথমে বিয়ে করেছিলেন। সঞ্জয় লীলা বানসালি এখানে গঙ্গার বিয়ে বা সংসার করা দেখাননি।
পড়াশোনার সুবাদে আমি যখন কলকাতায় ছিলাম তখন ১৯৯৬ সালে সঞ্জয় লীলা বানসালির মিউজিক্যাল কমেডি ধারার প্রথম ছবি খামোশি (১৯৯৬) দেখেছিলাম। তখনি তার সম্পর্কে আবেগ, ঐশ্বর্য এবং পরিপূর্ণতার ছোঁয়ার একটি আভাস অনুমান করেছিলাম। পরবর্তীতে বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তার ২৬ বছরের সিনেমার জগতে একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণের নৈপুণ্যে দর্শককে মাতিয়ে রেখেছেন।
বলা চলে, তার নিখুঁত কাজের জন্য আজকের দিনে সঞ্জয় লীলা বানসালি শুধু একজন পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার নন তিনি একটি ঘরানা। বলা বাহুল্য তার চলচ্চিত্রের একটি স্বতন্ত্র স্টাইল রয়েছে যা তাকে অন্য চলচ্চিত্রকারদের থেকে আলাদা করে তোলে। তার কিছু স্বকীয় ভিন্ন সিনেমাটিক উপাদান দর্শকদের এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়, তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে এবং আরও কিছুর জন্য এক আকাঙ্ক্ষার ব্যঞ্জনা তৈরি করে।
তার হ্যাম দিল দে চুকে সানাম (১৯৯৯), দেবদাস (২০০২) বা বাজিরাও মাস্তানি (২০১৫) চলচ্চিত্রগুলো বৃহৎ আকার, সুইপিং স্কোপ এবং চমক নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের শৈলীতে এক ধরনের জাদুকরী আবহ তৈরি করে। এই বড় বাজেটের চলচ্চিত্র নির্মাণের সমার্থক শাস্ত্রীয় সাহিত্যিক অর্থে মহাকাব্যের মতো এটি প্রায়শই এপিকে পরিণত করে।
লেখক ও সাংবাদিক এস হুসেন জাইদির 'মাফিয়া কুইন্স অফ মুম্বাই (Mafia Queens of Mumbai)' বই অনুসারে, গাঙ্গুবাই ১৯৩৯ সালে গুজরাটের কাঠিয়াওয়ারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আসল নাম ছিল গঙ্গা হরজীবনদাস। গাঙ্গুবাইয়ের পরিবার খুব সচ্ছল থাকাতে গঙ্গার স্বপ্ন ছিল একটু অন্যরকম। পড়াশোনায় ভালো ও স্মার্ট হওয়ার পাশাপাশি গঙ্গার মনে ছিল একজন সফল অভিনেত্রী হওয়ার বাসনা।
গঙ্গার বাবার একটি দোকান ছিল এবং সেই দোকানে রমনিক লাল নামের একজন নতুন হিসাবরক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। স্বপ্ন পূরণ করতে হলে গঙ্গাকে যেকোনো উপায়ে বোম্বে যেতে হবে। যখনই তিনি জানতে পারলেন যে তার বাবা একজন নতুন কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়েছেন এবং তিনি বোম্বেতে থাকতেন তাই গঙ্গা রমনিক লালের সাথে বন্ধুত্ব করার কথা ভাবলেন।
গঙ্গা রমনিকের সাথে বন্ধুত্ব করে এবং ধীরে ধীরে এই বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হয়। প্রেম এতটাই গভীরে পৌঁছায় যে, তারা দুজনেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। গঙ্গা যখন তার বাবাকে তাদের সম্পর্ক ও বিয়ের কথা বলে তখন তার বাবা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর দুজনেই সিদ্ধান্ত নেন পালিয়ে বিয়ে করবেন। কাথিয়াওয়াড়ের মতো ছোট গ্রামের ১৬ বছর বয়সী একজন অবুঝ মেয়ে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তারচেয়ে বড় রমনিকের সাথে পালিয়ে বিয়ে করে সোজা বোম্বে চলে যায়।
গঙ্গা বিশ্বাস করতে পারছিল না সে এখন বোম্বেতেই আছে যেখানে বহুদিন ধরে তার স্বপ্ন পূরণ করতে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই গঙ্গার স্বপ্নভঙ্গ হতে থাকলো তার স্বামীর বিরূপ আচরণে। তারা ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়তো। গঙ্গা তার পরিবার সমাজ সবকিছু ত্যাগ করে শুধু স্বপ্ন পূরণ করতে বোম্বে এলেও তার স্বামী কোনো কাজ বা মাথা গোঁজার জন্য ছোট্ট একটু আস্তানার ব্যবস্থা করতে পারছিল না।
পকেটে টাকা না থাকলে মানুষ যখন ভেঙে পড়ে তখন সে যেকোনো কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। একপর্যায়ে স্বামী রমনিক গঙ্গাকে কাজের সন্ধানে যাচ্ছে বলে কিছুদিন তার মাসির সাথে তার বাড়িতে থাকতে বলে। কাজ পেয়েই তারা মাসির বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়িতে উঠবে বলে রমনিক গঙ্গাকে আশ্বস্ত করলে সে নীরবে মেনে নেয় কিন্তু গঙ্গা আসলে জানতেও পারে না যে ওটা রমনিকের মাসির বাড়ি নয়, পতিতালয়। রমনিক তার স্ত্রী গঙ্গাকে মুম্বাইয়ের একটি বিখ্যাত পতিতালয় কামাঠিপুরার শীলা মাসির (সীমা পাহওয়া) মালিকানাধীন একটি কোঠায় মাত্র ৫০০ টাকায় বিক্রি করেন।
কয়েকদিন থাকার পর সে জানতে পারে রমনিক আর কখনোই তাকে নিতে আসবে না এবং এখন এই অবস্থার পর সে তার গ্রামেও ফিরে যেতে পারবে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েই শিখতে হয় দেহ ব্যবসার নানা কৌশল। অতঃপর গঙ্গা এই পতিতালয়কেই নিজের বাড়ি হিসেবে গ্রহণ করেন।
এখন সবাই তাকে নতুন নাম গাঙ্গু বলেই ডাকে। গাঙ্গু এখন তার ভাগ্যকে মেনে নিয়ে নিজের অধরা অতীতেই শান্তি পেতে চায়। গাঙ্গুর নির্দোষ মনোভাব এবং দুর্বলতাকে চিত্রিত করার দৃশ্যগুলো শিগগিরই বদলে যায় সহিংসতা এবং ধর্ষণে। বুদ্ধিমতী গাঙ্গু অনেক খোঁজ খবর নিয়ে স্থানীয় মাফিয়া প্রধান করিম লালার (অজয় দেবগন) কাছে সাহায্য চান। ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হচ্ছে—গঙ্গা থেকে গাঙ্গু, লালার সাহায্যে 'গাঙ্গুবাই' হয়ে ওঠা।
তারপর গাঙ্গুবাইয়ের আধিপত্য এতটাই বেড়ে বেড়ে যায় যে, কামাঠিপুরার কোঠা (গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি কামাঠিপুরা) তার নামে নামকরণ করা হয়েছিল। তার আধিপত্যপূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে তিনি বেশ্যালয়ে কাজ করা পতিতাদের জন্য অনেক ভালো কাজ করেছিলেন। বাইরের লোক ঢুকে ওখানে হিংসা করতে ভয় পেত। পতিতার সন্তানদের লেখাপড়ারও দায়িত্ব নেন যেটি সেই সময়ে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
তার সম্মতি ছাড়া আসা মেয়েদের তিনি তার ঘরে না রেখে স্বাভাবিক সমাজে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। গাঙ্গুবাই পতিতালয়ে বসবাসকারী মেয়েদের জন্য 'গাঙ্গু মা' ছিলেন। তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। গাঙ্গুবাইয়ের প্রতিপত্তি এতটাই ছিল যে, কামাঠিপুরায় কোনো কাজই তাকে না জানিয়ে করা যেত না। যেকোনো ছোট কাজ করার জন্যও বাইরের কাউকে তার বাড়িতেই আসতে হতো।
ক্ষমতাকে পুঁজি করে অনেকের কথায় রাজনীতিতে এলেও তার প্রাধান্য ছিল কামাঠিপুরার পতিতালয়। এর স্বার্থ রক্ষায় এক পরিচিত সাংবাদিকের সহায়তায় ১৯৬০ সালের তার এক বক্তৃতা শুনতে পুরো আজাদ ময়দান ভরে গিয়েছিল। আমরা সিনেমার দৃশ্যে দেখি বন্ধু সাংবাদিকের লেখা বক্তব্যটি ছিঁড়ে ফেলে নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আশা কথাগুলোই এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, পুরো বোম্বের মানুষই সেই ভাষণে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং পরের দিন সেটি সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় খবর হিসেবে ছাপা হয়েছিল।
সঞ্জয় লীলা বানসালির প্রায় সকল চলচ্চিত্রেই নারী চরিত্রগুলো কোনো না কোনো ভাবে ট্র্যাজেডির স্বীকার হয়। চরিত্রগুলো শক্তিশালী এবং হিংস্র হয়ে থাকে। তারা শক্তি ধরে রাখে এবং সিনেমার অন্যান্য চরিত্রের গতিপথ প্রভাবিত করে। এই নারী চরিত্র তাদের ক্ষমতা প্রমাণ করে এবং গল্পে পুরুষ চরিত্রদের ভাগ্য নির্ধারণ করে। গাঙ্গুবাঈয়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না।
গঙ্গা, গাঙ্গু বা গাঙ্গুবাঈ হওয়ার মাধ্যমে সকল চরিত্রগুলোই তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। জাঁকজমক আবহ, জীবনের চেয়ে বড় সেট এবং ওভার-দ্য-টপ পোশাক প্রভৃতি পর্দায় নান্দনিকভাবে একধরনের আনন্দদায়ক ভিজ্যুয়াল প্লেজার তৈরিতে বানসালি বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যারজন্য তার চলচ্চিত্রগুলো স্বপ্নের মতো দেখায় এবং দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে।
দেবদাস, বাজিরাও মাস্তানি, হ্যাম দিল দে চুকে সানাম বা গুজারিশের মতো গাঙ্গুবাইও দেখে দর্শক যেমন বলে সঞ্জয় লীলা বানসালির সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমই যেন একটা পেইন্টিংয়ের মতো দেখায়। পাশাপাশি কপালে লাল টিপ, চোখে মোটা করে টানা কাজল, তীক্ষ্ণ চাহনি, ক্যামেরার কাজ, ব্যাকগ্রাউন্ড সংগীত, ভিন্ন আলোক সম্পাত এবং সংলাপের জন্য চলচ্চিত্রটি অন্য যেকোনো বায়োপিক থেকে কিছুটা ভিন্ন মাত্রা পৌঁছে দেয়।
নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক