সন্জীদা খাতুন : স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা
সঙ্গীত ও সাহিত্য সাধক সন্জীদা খাতুন। তার জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। আজ তিনি ৮৯ বছর পূর্ণ করেছেন, আগামী বছর নব্বই-এ পদার্পণ করবেন। সারাজীবন তিনি বাঙালি সংস্কৃতির সাধনা করেছেন, প্রধানত সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে কিশোর বয়স থেকে সর্বজনের হৃদয়ে বাঙালি জাতিসত্তা ধারণের জন্য স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা করেছেন।
তার পিতা ড. কাজী মোতাহার হোসেন সে যুগে মুক্তচিন্তার অগ্রপথিক শিখা গোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, পরিবারে সঙ্গীত শিক্ষার আবহ ছিল, বাসায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রায়ই আনাগোনা হতো। সঙ্গীত শিক্ষার শুরুটি তাই নজরুল সঙ্গীতে, সঙ্গীতগুণী সোহরাব হোসেনের তত্ত্বাবধানে।
বালিকা বয়সে সাইকেলে বন্ধুগৃহে চলাফেরা। ভাষা আন্দোলনে যোগ ঘটেছে ১৯৫২ সালে এবং ১৯৫৩ সালে ছেলেমেয়েদের মিছিলে, তবে ভাষা সৈনিক বিশেষণ উনার প্রচণ্ড অপছন্দ।
সে সময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা-সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের সাথে পরিচয়, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার জন্য নিয়মিত যাতায়াত করেন সঙ্গীত শিক্ষক আফসারী খানমের কাছে। সে সময়কাল থেকে তিনি সঙ্গীত শিক্ষার নিবেদিত-প্রাণ মানুষ।
বিনোদন তারকা নয়, শিল্পী সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন, ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে নববর্ষের নাগরিক আয়োজন। এ সকল আয়োজনে প্রধান ভূমিকা সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের।
পাকিস্তান আমলে যখন অভিন্ন ধর্মের বাধনে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা বিস্মৃত করার ষড়যন্ত্রে ধারাবাহিক আঘাত আসে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর, তখন ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালনের আয়োজনে সন্জীদা খাতুন নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।
১৯৬১-এর শীতে জয়দেবপুরে এক পিকনিকে জন্ম দেন ছায়ানটের। তার সূত্র ধরে ১৯৬৩ সালে বিনোদন তারকা নয়, শিল্পী সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন, ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে নববর্ষের নাগরিক আয়োজন। এ সকল আয়োজনে প্রধান ভূমিকা সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের।
তবে, সন্জীদা খাতুন সরকারি চাকরি করেন বিধায় তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ছায়ানটের কোনো পদ গ্রহণ না করেও সম্পূর্ণ কর্মসম্পাদন তাকে করতে হয়েছে। তাতে অবশ্য তিনি রেহাই পাননি, তাকে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর বদলি করা হয় সুদূর রংপুর কারমাইকেল কলেজে, তিনি নিয়মিত ধর্মপালন করেন কি না, সেটি নজরদারিতে থাকে।
সন্জীদা খাতুনের নিরন্তর সংগ্রাম এই বয়সেও সজীব। শরীর কিছুটা অসমর্থ কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, এমনকি তিনি অনলাইনে নিয়মিত নিবিড় সঙ্গীতশিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি অন্যান্যদের সহায়তায় গড়ে তোলেন দেশান্তরি শিল্পীদের নিয়ে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা, যার সদস্যরা বাংলা গান গেয়ে শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে সকলকে উজ্জীবিত করে তুলেছেন। সমগ্র পাকিস্তান আমল জুড়ে আরোপিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি কিংবদন্তি যোদ্ধা।
স্বাধীনতার পর বাঙালি সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা নির্বিঘ্নে হয়েছে। তবে পঁচাত্তরের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর সাম্প্রদায়িক ভাবধারার পুনরুত্থান, আর গত কয়েক দশকে বিশ্ব পরিসরে ধর্মের মর্মবাণীকে উপেক্ষা করে উগ্রবাদী ব্যাখ্যা বহুজনের মনোজগতে আস্তানা গেড়েছে।
পাশাপাশি বিশ্বায়নের যুগে তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে জাতীয় সাংস্কৃতিক সুরক্ষা জটিল হয়েছে। আর তাই সন্জীদা খাতুনের নিরন্তর সংগ্রাম এই বয়সেও সজীব। শরীর কিছুটা অসমর্থ কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, এমনকি তিনি অনলাইনে নিয়মিত নিবিড় সঙ্গীতশিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আশির দশকে যাত্রা শুরু করেছে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, পরে ব্রতচারী সংসদ এবং তার সাথে রয়েছে সংস্কৃতি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা নালন্দা বিদ্যালয়। সকল কার্যক্রমেই তিনি নেতৃত্ব প্রদান করে চলেছেন, সাথে চলছে সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা ও গ্রন্থ রচনা। সবকিছুর মধ্যেই তার আন্তরিকতা সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আলোকিত করে তোলে। তাই তার জন্মদিনে প্রার্থনা, শতায়ু হোন সন্জীদা খাতুন।
সারওয়ার আলী ।। ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর