হাসান আরিফ : অশ্রু জলে ভাসি আমি একা একা
হাসান আরিফ। এমন একজন প্রিয় মানুষ, যার চলে যাওয়ার শোক সংবাদ লেখা যে কতখানি কষ্টের তা বোঝাতে পারব না। গত ক’দিন ধরেই দেশ-বিদেশের বন্ধুরা ফোন করছে আর কাঁদছে... একটাই প্রশ্ন, আমরা কি আরিফ ভাইকে ‘বিদায়’ বলার প্রস্তুতি নেব?
অঝোরে কাঁদছিল লিসা, লন্ডন থেকে। কানাডায় শাহিন, ক্যালিফোর্নিয়ায় শীলা, শুভপ্রকাশ দা, মানস দা, সৌমেন ভারতীয়া—সবাই গত চারমাস ধরে যখন তখন ফোনে একটু ভালো কথা শুনতে চেয়েছেন, আরিফ ভাইয়ের ভালো কথা।
মানে উনি সুস্থ হয়ে ফিরছেন তো? হাসান আরিফকে নিয়ে আমি নিয়মিত আপডেট দিতাম। আমার স্ট্যাটাস থেকে নাকি এক ধরনের আশা জাগানিয়া বার্তা পেতো তারা।
মেডিকেল সায়েন্স আর বন্ধুর বায়াসড বিশ্বাসের টানাহেঁচড়া তো হতোই। কিন্তু আমার কলম রায় দিতো বেঁচে ফেরার পক্ষে। তাই হয়তো, আরিফ ভাইয়ের প্রিয়জনেরা আশায় বুক বাঁধত।
আমি আইসিইউতে ঢুকলেই, নার্স—ডাক্তাররা মিষ্টি করে আরিফ ভাইকে বলতেন, আঙ্কেল...আপনার বন্ধু মুন্নী সাহা এসেছে, দেখেন। মিষ্টি করে হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিতেন।
চার মাস তিনি হাসপাতালে ছিলেন। এই সময় কতবার যে গিয়েছি, তিনি কতবার যে তুলি আপা বা ডাক্তারের কাছে উইশ লিস্ট পাঠিয়েছে—যেন আমি যাই!
কেন আমি এক সপ্তাহ যাইনি, আমি কি দেশে নাকি, এসব কৈফিয়ত ডাক্তারদেরও দিতে হতো। ডিউটি ডাক্তাররা প্রায় সবাই আমার পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। ঠাট্টা করতেন, আরিফ ভাইয়ের ছেলেমানুষি নিয়ে।
আমি আইসিইউতে ঢুকলেই, নার্স—ডাক্তাররা মিষ্টি করে আরিফ ভাইকে বলতেন, আঙ্কেল...আপনার বন্ধু মুন্নী সাহা এসেছে, দেখেন। মিষ্টি করে হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিতেন।
যতক্ষণ থাকতাম ততক্ষণ হাতটা ধরে থাকতেন। ট্রকেস্টমির পরে তো গলার আওয়াজ ছিল না, তাও অনর্গল কথা বলতেন, আওয়াজহীন কথা তার ঠোঁট নাড়ানিতেই বুঝে নিতাম—তার সে কী আনন্দ।
...আপনি কারো কারো কাছে কথাবাজ, কারো কাছে প্রিয় আবৃত্তিকার। কারো শিক্ষক, কারো মেন্টর, কারোবা মিছিলের প্রতিবাদী হাত।
অনেক কথা বলা আরিফ ভাই শুধু ট্রকেস্টমির নলটার দিকে হাতটা দিয়ে অভিমানের চাহনিতে দুয়েকবার বলেছেন, কেন এটা করতে দিলি? কথা ছাড়া কি বাঁচবো? যদি আর আওয়াজ না ফিরে পাই!
মাথায় হাত রেখে কতবার বোঝাতে চেয়েছি, আপনি কারো কারো কাছে কথাবাজ, কারো কাছে প্রিয় আবৃত্তিকার। কারো শিক্ষক, কারো মেন্টর, কারোবা মিছিলের প্রতিবাদী হাত।
কিন্তু এর বাইরে হাজারো মানুষ দাঁড়িয়ে, যারা আপনার সান্নিধ্য পেয়েছে, কাউকে একটু এগিয়ে দিয়েছেন, কাউকে একটা শার্ট কিনে দিয়েছেন হয়তো ভালবেসে—তারা হাসান আরিফের বুকের ভেতরে গভীর অস্ফুট আওয়াজের খাঁটি-মানবিক হাসান আরিফকে খোঁজে—তাদের সংখ্যাই তো বেশি। তাদেরকে মায়ার কবিতার পরশ কে জোগাবে আরিফ ভাই?
জানি না... বিশ্বাস করেছে কি না। কিন্তু আমি তো এইসব মায়ামুগ্ধ সুহৃদদের আহাজারি দেখে বিস্মিত! আসলে, আরেকটা কেন হাসান আরিফ নেই? কেন হয় না আরেকটা হাসান আরিফ?
মুন্নী সাহা ।। প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন নিউজ